বাজেয়াপ্ত নজরুল কাব্যগ্রন্থ এবং তাঁর কারাজীবন এর কথা
-আদনান সৈয়দ
নজরুল ছিলেন সাম্যবাদী কবি,প্রেমের কবি। জাতি,বর্ণ, ধর্ম,গোষ্ঠীর এসব কিছুর উর্ধে তিনি তাঁর সাহিত্য কে স্থান দিয়েছিলেন মানব প্রেম আর জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে ধমকেতুর মত নজরুল বাংলার কাব্য আকাশে হাজির হয়ে আবার হঠাৎ করেই যেন মিলিয়ে গেলেন। ৪২ সাল থেকেই কবি বাকরুদ্ধ! কিন্তু জীবনের এই অল্প সময়েই নজরুল তাঁর বাংলার কাব্যমোদিদের জন্য রেখে যান বিষে ভরা এক চির বিদ্রোহের বাণী। গোটা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীরা যখন বন্দুকের নল উঁচিয়ে চর দখলের লড়াইয়ে ব্যাস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে নজরুলের মত এক বিদ্রোহীর আত্বপ্রকাশটা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ছিল না। একদিকে গোটা ভারত বর্ষে শুরু হয়েছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন,বেঙ্গল প্যাক্ট, সাইমন কমিশন,নেহরু রিপোর্ট আবার পাশাপাশি রুশ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় বিপর্যয় সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে চলছিল এক নিদারুন মানবিক অস্থিরতার লড়াই। মানবতার পতনের সেই অস্থির দিনগুলোতে আগুন ঠিকরে বের হয়ে আসা বাংলার আপোষহীন মানুষের মাঝে বিদ্রোহের মন্ত্র নিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মত আবির্ভাব হয়েছিল বাবড়ি দোলানো এক নতুন কবির। সেটা ছিল ১৯২১ সাল।
১৯১৭ সালে নজরুল যখন ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে সৈনিকের খাতায় নাম লিখেন তখন তিনি ছিলেন নিতান্তই একজন বালক। এই বালক বয়সেই পল্টনের সৈনিক জীবনের পাশাপাশি নজরুলের মনোজগতে চলতে থাকে জীবনে আরেক লেনদেন। পরাধীনতা , ভারতবর্ষে উপর জেকে বসে থাকা বৃটিশ ভুত আর সাম্যবাদী চিন্তার শক্ত আঘাত আসে সৈনিক নজরুলের মনন আর চেতনার চৌকাঠে। একদিন সৈনিক জীবনের পাতা মুড়িয়ে বিদ্রোহী নজরুল চলে এলেন কলকাতায়। মোসলেম ভারত এবং বিজলীতে একযোগে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অগ্নিঝরা কবিতা ’বিদ্রোহী’।
’মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভুমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।’
’বিদ্রোহী’ কবিতাটি আগুনের গোলার মত যেন ছড়িয়ে পরল বাংলার সবখানে। সবার মুখে তখন একই জপমালা, ” আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিস”। নজরুলের এই বিদ্রোহী মন্ত্রে জেগে উঠলো গোটা বাংলা। বৃটিশ রাজের লাল ইটের শক্ত দালানেও এই বিষাক্ত মন্ত্র বার বার ধাক্কা খেল। এবার সচকিত হয়ে উঠলো রাজশক্তি। রাতারাতি নজরুলের উপর সরকারী আমলাদের খবরদারির বেড়ে গেল । একে একে পাঁচটি নজরুল কাব্যগ্রন্থ সরকারি ভাবে বাজেয়াপ্ত হল । ১৯২২ সালে বাংলা ফৌজদারী বিধির ৯৯এ ধারায় সরকার নজুুরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’যুগবাণী’ নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।
’যুগবাণী’ নিষিদ্ধ হওয়ার বছর দুয়েকের ভেতরই ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় ’বিষের বাঁশি’ । তবে নিষিদ্ধ করেও বইটির প্রচার বন্ধ রাখা যায় নি। বইটি উপরের মলাট ছাড়াই কলকাতার বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকে। বিপাকে পরে যায় সরকারি গোয়েন্দার দল। এদিক তরুনদের মাঝে এই নিষিদ্ধ কবিতার বইটি পড়ার উৎসাহও কম নয়। সবার পকেটেই তখন ’বিষের বাশি’। এর কিছুদিন পরই নিষিদ্ধ হয় ’ ভাঙার গান’। বইটি বাজায়াপ্ত হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর।। ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ হয় ’ প্রলয় শিখা’। এই কাব্যগ্রন্থটিতে ফৌজদারী বিধির ৯৯এ ধারায় সরকার বিরোধী বিভিন্ন রকম উসকানি মুলক রসদ পাওয়ার অভযোগ পাওয়া যায়। তবে এই প্রথম বারের মত শুধুমাত্র বইটি বাজেয়াপ্ত করেই সরকার থেমে থাকে নি, এর মুদ্রন এবং প্রকাশনার অপরাধে নজরুল ইসলাম কে ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় এবং কবি গ্রেপ্তার হোন। কবি রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন এবং গান্ধী –আরউইন চুক্তির পরপরই কবি এই দণ্ড থেকে মুক্তি পান। নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও বইটির উপর বাজেয়াপ্ত আদেশ ঠিকই থেকে যায়। ১৯৩১ সালে নিষিদ্ধ হয় কবি নজরুল ইসলামের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে আর শ্ল্যাষেপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ’চন্দ্রবিন্দু’।
’ মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুন চন্দ্রবিন্দু”।
’চন্দ্রবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল দেশাত্ববোধক তীব্র ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে ভরা একটি কাব্যগ্রন্থ। বিশেষ করে বৃটিশদের পা চাটা দেশি সাহেবদের নিয়ে কৌতুক বিদ্রুপে মেশানো এই কাব্যগ্রন্থটি সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ’চন্দ্রবিন্দুর’ প্রতিটি কবিতায় ব্যাঙ্গ আর বিদ্রুপের বিষয় ছিল লীগ অব নেশন, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, সাইমন কমিশন রিপোর্ট, প্রাথমিক শিক্ষার বিল ইত্যাদি।
দেখা যায় নজরুলের মোট পাঁচটি কাব্যগ্রন্থগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত ঘোষনা করা হলেও পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি কাব্য গ্রন্থের উপর সরকারি আক্রোশ ছিল। অগ্নিবিণা,সঞ্চিতা,ফণিমনসা,সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল এইসব কটা গ্রন্থেই বিপ্লবের ঘ্রান পেয়েছিল সরকারী গয়েন্দা বিভাগ কিন্তু সবকটা গ্রন্থই খুব অল্পের জন্য সরকারীভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়।
মোট দুটো কাব্য গ্রন্থের জন্য নজরুল ইসলাম কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ’প্রলয় শিখা’ কাব্যে বৃটিশ বিরোধী উস্কানিমুলক কবিতার জন্য কবি ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন । দ্বিতীয়বার কবি দন্ডিত হোন তাঁর সম্পাদিত ধুমকেতুতে(১৯২২, ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যা) প্রকাশিত ’আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য। কবিতাটি ছাপার জন্য কবিকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা অনুসারে এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। কারাদন্ডের সময় নজরুল কে প্রথম প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তারপর কারাদন্ডের পর তাঁকে আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়। এই জেলে থাকা কালিন সময়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ’বসন্ত ’ নাটকটি নজরুল কে উৎসর্গ করেন। আলিপুর জেল থেকে কবিকে নজরুল যখন হুগলির জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন নজরুল জেলের বিভিন্নরকম বৈষম্যমুলক অবিচার আর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশন শুরু করেন। স্বাভাবিক ভাবেই অনশনে কবির শারিরিক অবস্থার অবনতি হয়। বাংলার জনগণ কবির এই শারিরিক বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পরে। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই নজরুলকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষেভে ফেটে পরেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্ট্রাল জেলে কবি কে অনশন ভাঙ্গার অনুরোধ জানিয়ে জরুরী তার পাঠান, ” গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।” শেষ পর্যন্ত কবির মাতৃস্থানীয়া বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে ৩৯ দিন অনশন থাকার পর ২২ শে মে ১৯২৩ সালে নজরুল তাঁর অনশন ভঙ্গ করেন। এর কিছুদিন পরই কবিেেক হুগলির জেল থেকে স্থানান্তরিত করা হয় বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়।
শিকল পরেই কবি শিকল ভাঙ্গার গান বাঁধলেন,
’শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল’
কবির জেল জীবন কেমন ছিল? জানা যায়, জেলের অন্যান্য কয়েদীদের সাথে সবসময় হেসে-খেলে, আনন্দে-মেতে থাকতেন কবি। কলকাতার জেল থেকে কবিকে হুগলির জেলে আনা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেঁধে। জেলে ঢুকেই কবির চিৎকার, ” দে গরুর গা ধুইয়ে।’ বলাই বাহুল্য জেলের অন্যান্য বন্দীরা সবসময়ই কবি কে কাছে পেয়ে গানে, আবৃত্তিতে, মেতে থাকতেন। নজরুল জেল-কারাগার কে কখনই ভয় পান নি, বৃটিশ রাজ শক্তিকে কখনোই আমল দেন নি। নজরুল ছিলেন প্রেমের কবি। অত্যাচারিতদের পক্ষ হয়ে তিনি সবসময়ই তাঁর প্রেমের বাঁশিটি যেমন বাঁজিয়েছেন আবার পাশাপাশি অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহীর সুর ভরা ছিল তার বিঁষের বাঁশিতে। ধুমকেতুতে প্রকাশিত ’ অনন্দময়ী আগমনের’ যে কবিতাটির জন্য কবির এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল সেই কবিতাটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
’’ আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূতি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব –শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ’ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..
’ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
তথ্যপুঞ্জঃ
বৃটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই- শিশির কর আমি যাঁদের দেখেছি- পরিমল গোস্বামী কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা- মুজাফফর আহমেদ