সেলিম আল দীনঃ বাংলা নাট্যজগতের এক অপার বিস্ময়

    আদনান সৈয়দ 

প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও দক্ষতায় যে কজন নিরলস সাংস্কৃতি ব্যাক্তিত্ব আমাদের সহজিয়া লোকজ বাংলার উর্বর সংস্কৃতিকে বহুমাত্রায় বহুদুর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন ছিলেন তাদের ভেতর অন্যতমবাংলার হাজার বছরের পুরোন লোকজ উপাদানকে ব্যাবহার করে জলজ এই ব-দ্বীপের পোড় খাওয়া, চির সংগ্রামী, সরল, স্বাধীনচেতা, আত্বনির্ভর, নির্ভিক, সাহসী মানুষদের জীবনকাব্যের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত সাবলিলভাবে  সেলিম আল দীন তাঁর প্রতিটি নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন চরিত্রের এই যুক্তিসংগত গ্রহণযগ্যতার কারনেই নাটক তখন শুধুই নিছক  মঞ্চের ভাষা হয়ে থাকেনি, তাঁর নাটকের প্রতিটি সংলাপ জীবন্ত হয়ে মিশে গিয়েছিল আমাদের সাধারন গার্হাস্থ জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্যে 

নাটক কী? এরিস্ট্যাটল সেই অনেক আগেই বলেছিলেন যে মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতি জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রতভাবেআর সে কারনেই মানুষ প্রকৃতসৃষ্ট এক উন্নত মনন পুষ্ট প্রাণীএই প্রাণী জীবনের অপার চাহিদা, আকাঙ্খা-ভালোবাসার অনু-পরমানুর বাস্তব-অবাস্তব প্রতিফলন হল নাটকআর সে কারনেই জীবনের দিনলিপির আয়নায় এই নাটকের প্রতিটি চরিত্র আমাদের সামনে ধরা দেয় বহুরুপি হয়েআমরা যারা সমাজবদ্ধ জীব এবং আমাদের তৈরী এই সমাজকে আঁকড়ে ধরেই যখন আমাদের বাঁচা-মরার হিশেব নিকেশ তখন আমরা জড়িয়ে পরি প্রতিদিনের জীবনের সাথে এক অস্তিত্বের লড়াইয়েএই লড়াই করতে যেয়ে আমাদেরকে কখনো নায়ক, কখনো খল নায়ক, কখনো হয়তো নীরব দর্শকের ভুমিকায় অবতীর্ন হতে হয়।  সেলিম আল দীন এমনি একজন সফল নায়কের নামতিনি আমাদের নাট্য অঙ্গনকে অলংকৃত করেছেন অত্যান্ত ভালোবাসা আর মর্যাদার সাথেঅপার উসাহ আর আকাশচূড়া স্বপ্ন নিয়ে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগ খুলে বাংলার নাট্য ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেননাটকের উপর বিভিন্ন ধারায় পরীক্ষা-নিরীক্ষাতো বটেই নাটকের মাধ্যমে সমাজের অপেক্ষাকৃত নষ্ট, ক্ষয়ে যাওয়া ঘুনে ধরার পচনশীল চিত্রটি যেমন তিনি তাঁর নাটকের মাধ্যমে আমাদের পাতে তুলে দিয়েছেন  পাশাপাশি মানুষের বিজয় গাঁথাও তার নাটকে ফুঠে উঠেছে অত্যান্ত দক্ষ আর বলিষ্ঠতার সাথেইআর সে কারনেই সেলিম আল দীন ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন বাংলার প্রতিটি আকা-বাকা প্রান্তরে, নোনা জল হয়ে হাটে-মাঠে-ঘাটে, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানুষের হদয় মন্দিরেতাঁর জনপ্রিয় নাটকগুলো হল হরগজ, হাত-হদাই, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, যৈবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, চাকা, মুনতাসীর ইত্যাদি 

সেলিম আল দীন আমাদের নাটক পাড়াকে শুধু সমৃদ্ধই করে দেন নি পাশাপাশি একটি নাট্যরিতী ও নাট্যশৈলীর শক্ত জমিন খুব শক্ত আর মজবুত করে বুনেও দিয়েছেনএখন আমাদের কাজ অনেকনাটকের এই উর্বর জমিনটাকে নিত্য চাষবাস আর পরিযর্যা করে ফুলে-ফলে আরো বহুদুর এগিয়ে নিয়ে যাওয়াএ কথা মানতে হবে যে সেলিম-আল দীনের মত এই বিরল প্রজাতিদের জন্ম সবসময়ই হয় নাতাঁর দক্ষ হাতের ছোওয়ায় আজ বাংলার নাটক বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার বাইরেও বেশ মর্যাাদার সাথে বেঁচে আছেসেলিম আল দীনদের কখনও মৃত্যু হয় নাতাঁদের মৃত্য হতে হতে পারে নাএই ক্ষন জন্মাদের মৃত্যু নেই বলেই তাঁদের স্বর্নীল যাত্রাপথ এক পলকের জন্যও কোথাও কখনো থমকে দাড়াবে না, এই আলোর নাচন মুহুর্তের জন্যও হলেও মিলিয়ে যাবে নাযে আলোর মশালটি তিনি আমাদের নাট্য সংস্কৃতিতে অত্যন্ত দীপ্রতার সাথে জ্বেলে দিয়েছিলেন সেই দীপ্তিটাকে আমাদের বহুদুর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে হবেসে কাজটি করতে হবে আমাদারকেই, হ্যাঁ, তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরসূরীদেরকেই

[email protected]