কবি শহীদ কাদরী এবং তাঁর কবিতা

                                      (কবির ৬৫তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে)

আদনান সৈয়দ 

শহীদ কাদরী নামটি যেন কোন গ্রহ থেকে খসে পড়া এক উজ্জল নক্ষত্রের মতনিজ গ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু উজ্জ্বল আলোয় তিনি ঠিক মিটিমিটি জ্বলছেন আরেক ভুবনেতাই শহীদ কাদরীর জীবন ও তাঁর কাব্য আমাদের নিত্য ভাবায় এবং বিস্ময় সৃষ্টি করে  

শহীদ কাদরীকে যাঁরা জানেন তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন যে তিনি আড্ডা দিতে যত ভালোবাসেন তার চেয়ে কম ভালোবাসেন তার লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করতেএরকম প্রচারবিমুখ কবি আমাদের আশে-পাশে খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন লেখালেখির প্রসঙ্গ এলেই তাঁর নির্লিপ্ত উত্তর, ” আরে দুর, ওসব বাদ দাওতবে অবাক বিষয় তিনি নিজের লেখালেখি নিয়ে উসাহ না দেখালেও বাংলাদেশের বর্তমান লেখকদের সম্পর্কে অনেক বেশি আগ্রহ দেখানকিন্তু পর্দার আড়ালে তিনি নিজেকে যতই গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করুন না কেন একথাতো সত্য যে পঞ্চাশ উত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিক মননের ছাপ এবং জীবনবোধ সংযোগ ঘটিয়ে কবিতার উকর্ষে যাঁরা নিমগ্ন ছিলেন কবি শহীদ কাদরী ছিলেন সে দলের অন্যতম একজন কারিগর 

একথাতো সবারই জানা যে তিনি লিখেছেন খুব কম কিন্তু মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ( উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা এবং কোথাও কোন ক্রন্দন নেই) দিয়ে কবি শহীদ কাদরী বাংলা কাব্য আসনে একটি স্থায়ী আসন তৈরী করে নিয়েছেনকবি যখন বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, ঠিক তখনিই যেন তাঁর বিদ্রোহী মন বেঁকে বসলসবকিছু ছেড়েছুড়ে তিনি পাড়ি জমালেন ইউরোপে জার্মান, ইংল্যান্ড হয়ে তিনি এখন উত্তর আমেরিকায় স্বেচ্ছা প্রবাসবন্দীকিন্তু কেন এই বন্দিত্ব? না, আমরা সে খবর কেউ জানি না, আর তা জানা হয়ত সম্ভবও নয়তবে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে নিশ্চয় এর পেছনে কোন কারণ ছিলহয়ত বুকচাপা কোন অভিমান অথবা বড্ড এলোমেলো পরিতোষন সমাজের গুমোট আলো-হাওয়ায় কবির মনকে বিক্ষিপ্ত করেছিলঅথবা হয়তো কিছুই নয়শহীদ কাদরীর বাউল মনই তাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরিত করেছিলশহীদ কাদরী নিজেই তার উত্তরাধিকার কাব্যগ্রন্থে এর জবাব দিয়েছেন এইভাবে,

না শহীদ সেতো নেই; গোধুলিতে তাকে

কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায় নি, পাবে না”(অগ্রজের উত্তর)

তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে কাদরীকে কি সেই অনির্দেশ্য যন্ত্রণা যা কবিকে সবসময় তাড়িত করে বেড়ায়? কেন এই পলায়ন বা আত্বনিমজ্জন? একজন মানুষের ভেতরে আরেকটি অচেনা মানুষকে নিরন্তর খোঁজার এক অতৃপ্তি থেকেই কি কবির এই সহজ- সরল স্বীকোরক্তি? কি সেই অদেখা সত্বা যাকে আমরা নিত্য খুজে বেড়াই? অথবা সত্যিই কি তাকে কি খুজে পাওয়া সম্ভব? তারপরও আমাদের নিরন্তর চেষ্টা চলে মনের সেই গহীন কূপে বাস করা সেই অদৃশ্য, মৃয়মান, অদেখা, প্রজ্জলিত, নিবীর সত্বাটাকে নিত্য আবিস্কার করাআর এই আবিস্কার করতে যেয়েই শুরু হয় মনোজগতের এক নিদারুন তোলপারনা পাওয়ার এক অসমান্য হ্্রদয় ব্যাদনা, জন্ম নেয় ক্ষোভ আর ব্যার্থ আস্ফালোনেরতখন শহীদ কাদরী ব্যাক্তি মানুষটির ভেতর শুধুই কি একজন কাদরী বাস করে?

 ”না,না, তার কথা আর নয়,সেই

বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো শহীদ কাদরী বাড়ি নেই

মিষ্টিক কবি লালনের গানেও আছে সেই একই আর্তিআমি একদিনও না দেখিলাম তারে, বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা পড়শী বসত করেকবির বহেমিয়ান মন যা তাঁর কবি চিত্তকে সবসময় অস্থির এবং অতৃপ্তির চাদরে ঢেকে রেখেছিলকিন্তু কি সেই অতৃপ্তী? কি সেই জীবনের লেনদেনের গোপন হিসেব-নিকেশ যা একজন কবিকে নিত্য অস্থিরতায় তাড়িত করে বেড়ায়? পরিশ্রান্ত জীবনের এই শ্রান্তি অন্বেষণ কি শুধুই কল্পনার ডুবসাতার খেলা?

বন্য শূকর খুজে পাবে প্রিয় কাদা

মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,

কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা

ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ(সঙ্গতি)

সন্দেহ নেই কবির এই সহজ সরল উক্তি  আমাদের কে আলোর পথ দেখায়, আশান্বিত করে এবং তমস জীবনের অজানা-অচেনা অলি-গলিতে আশার আলোর দ্যুতি ছড়ায়তখন মনে হয় সত্যিই প্রাণ আছে, আশা আছে, সুখ আছে, ভালোবাসা আছেকিন্তু সবকিছুর পরও শান্তি আছে কি? কাদরী কবিতায় তারই আভাস দিচ্ছে

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকের সাথে ঠিক-ই

কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...(সঙ্গতি)

তাহলে কি এবসোলুট শান্তি বলতে কিছুই নেই! এই নাএর মাঝেও হ্যাঁঅথবা হ্যাঁএর মাঝে নাএর অস্তিত্ব যেন  উতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছেআমরা যাকে সুখ বলে আপাত ভাবছি সেখানেও রয়েছে হাজার মাইল ব্যাবধানের শুণ্যতার এক বিষন্ন দেয়ালসেখানে শান্তি কখনও ধরা দেয় না বা খুঁজে পাওয়া যায় নাতাহলে এই না পাওয়ার আর্তির আরেক বিরহ নামই  কি জীবনের কঠোর বাস্তবতা, জীবন প্রবঞ্চনা যেখানে স্বপ্ন শুধু হাতছানি দিয়ে ডাকে আর নিত্য প্রলুব্ধ করে বেড়ায় নতুন সকালের

কেবল লতায় আর গুল্মে -ঠাসা এ এ্যাকুরিয়ামে মাছ নেই-এ-ও সত্য নয় পুরোপুরি-

আমাদের ভালোবাসার প্রাক্তন প্রহরগুলো আমার কামরার জলে

লাল,নীল,সোনালি মাছের মতো লেজ তুলে ঘুরছে, প্রিয়তমা।(্এ-ও সঙ্গীত)

এই তমস অন্ধকার ভরা জীবনের পরের বাকেই দেখি জীবনের আরেক গল্পমালা, সুদীপ্ত আকাশে সোনালি সূর্যের নির্মল আলোক ছটাজীবনের স্বাদ তখন প্রতিফলিত হয় জীবনের জয়গানে, অনুরনিত হয় আকুল জীবন বন্দনায়তারপরও কোথায় যেন শূন্যতার আভাস, অপূর্নতার ছবিসে শূন্যতায় ভেসে বেড়ায় জীবনের আর্তিকে যেন চীকার করছে প্রাণপণে গোলাপ! গোলাপ!’( বাংলা কবিতার ধারা) অডেনের কবিতাতেও  সেই একি সুর বাজে,

Say This City has ten million souls,

some are living in mansions,some are

living in holes;

Yet there’s no place for us,my dear, yet

there’s no place for us(ten songs)

কিন্তু এই নিঃসার উক্তিইতো জীবন বন্দনার শেষ কথা হতে পারে না ভালোবাসা আর শান্তির কি কোথাও কোন জায়গা নেই? জীবনের আপাত সৌন্দর্য্যের আড়ালে শুধুই কি এই  ভয়াবহতার কঠোর পদচিহ্ন ? কিন্তু কবি আহ্বান করলেন সেই সুন্দরকেই আবিস্কার করার কঠোরতার আচল সরিয়ে কবি চোখ রাখতে চান সেই অনাগত সুন্দরের প্রতি

ঊরু আর নাভি অনেক খুঁড়লে

প্রেমের সঙ্গে একটা দিন

না হয় কিছু জমলো ঋণ”(একটা দিন) 

শহীদ কাদরী আধুনিক নগর ভাবনার কবিতার কবিতার শরীর জুড়ে শহরের ব্যাস্ত জীবনের ছাপ সুস্পষ্টকবির জন্ম, সোনালি কৈশর, যৌবনের সমস্ত আয়োজনই ছিল শহর কেন্দ্রিকআর সে কারনেই হয়তো তার কবিতায় শহর এসেছে স্বতস্ফুর্তভাবে, স্বাভাবিক নিয়মে

আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ

আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ(এবার আমি)

শহুরে জীবনের সুখ, দুঃখ, চিত্র, বৈচিত্র, ইট-কাঠ দালান কোঠার শক্ত বুননে ঠাসা মানুষের জীবন কবি কাছ থেকে দেখেছেন বলেই তার কবিতায় শহরের শব্দাবলি উঠে এসেছে অত্যান্ত কাব্যিক এবং সংগতভাবেইআর সেকারনেই নাগরিক পরিভাষা শহীদ কাদরীর কবিতার এক অনন্য অলংকারমটরের বনেট, পার্ক, সিনেমার কিউ, করাতকল, ল্যাম্পপোষ্ট, কারফিউ, রেঁস্তোরা, ট্রাফিক সিগন্যাল, ট্যাক্সি, ফুটপাত ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে কবি একাত্বতা বোধ করেছেন তার নাগরিক বোধ থেকেই।  তবে এই নাগরিক বোধের একদিকে যেমন রয়েছে দীপ্র আধুনিকতা আবার এর উল্টোপিঠে তিনি অনেক নিঃসঙ্গ এবং অসহায়সেখানে শুধু নগর জীবনের রুগ্নতা, হীনতা, নিঃসঙ্গতা, ক্লেদ আর শুন্যতার চিত্র

শহরের ভেতরে কোথাও হে রুগ্ন গোলাপদল,

শীতল,কালো,ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা(আলোকিত গণিকাবৃন্দ)

কিন্তু এই অন্ধকার থেকে পরিত্রান চান কবিকবি স্বপ্ন দেখেন সুন্দর সকালের, আলোকিত জোস্নাখচিত রাতের আকাশেরযেখানে সমাজ সৃষ্ট পাপ আর পাপ থাকেনা তা অবলিলায় মানবিকতায় উত্তির্ন হয়ে পূণ্যেতায় রুপ নেয়

সেই স্যাঁতসেতে ঠান্ডা উপাসনালয়ে পেতে দাও

জায়নামায, শুকনো কাঁথা, খাট, স্তুপ, স্তুপ রেশমের স্বাদ”(আলোকিত গণিকাবৃন্দ) 

দেশপ্রেম, স্বাদেশিকতা, আন্তর্জাতিকতাবাদ ঠাসা কবি শহীদ কাদরীর কবিতায় রাষ্ট্র জন্মের রক্তাক্ত ইতিহাস,সামরিকবাহিনীর অস্ত্রসজ্জা,যুদ্ধমহড়া এ সবকিছুর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট  কবির কবিতায় দেদিপ্যমান।  তাই হয়তো কবি তাঁর প্রিয়তমা দেশ কে অভিবাদন জানাচ্ছেন হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ,চকোলেট,টফি আর অ্যাকর্ডিয়ানের সুরের ভালোবাসা দিয়েতীব্র রাজনৈতিক চেতনাবোধ এই স্বাপ্নিক কবি এমন একটি প্রিয়তম স্বদেশ কে দেখতে চান যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের কূটকৌশলের সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে সেনাবাহিনি গোলাপের গুচ্ছ কাধে নিয়ে মার্চপাষ্ট করে চলে যাবে এবং স্যলুট করবে,       হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, আর্কেডিয়ান বাজাতে বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে

আমি এমন ব্যবস্থা করবো

নৌ,বিমান আর পদাতিক বাহিনী

কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে

নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।(তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা)

যুদ্ধ নয় শান্তি চাইএই মতবাদকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই একজন কবিই হয়তো এমনভাবে বলতে পারেন,

ক্যাপটেন, এবার  তুমি চিকার করে বলে ওঠো হ্যান্ডস আপ

টলে-পড়া গোলাপ দাঁড়িয়ে পড়ক তার ঝাড়ে,

হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাক ছুরি(কেন যেন বলছে)

কিন্তু কবির এই মর্মবাণী কতটুকুই বা পৌছতে পারে শোষকের কানে? শোষকের কাজইতো শোষন করা অন্যায়ভাবে মানুষের ভালোবাসা আর বিবেকের টুটি চেপে ধরাএই নিদারুন ব্যার্থতা কবির মন কে আশাহুত করে, উদ্বেলিত করে

তুমি গান গাইলে,

জাতিসংঘের প্রস্তাব লঙ্ঘন করে সারি সারি ট্যাঙ্ক

জলপাই পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে

খুব ভয়াবহভাবে যুদ্ধবিরতির সীমারেখা পার হলো”(তুমি গান গাইলে)

শত ব্যর্থতার পরও কবি ভালোবাসায় ভরা স্পপ্নের জাল বুনেনএই আশাবাদ আছে বলেই জীবনের সুন্দর মসৃন পথের বাঁকে বাঁকে হাজারো খানাখন্দ পেরিয়ে কবি জীবনের নতুন উজ্জল আলোটাকে ছুঁতে  চানএই হতাসা আর প্রাণের ব্যার্থতার মাঝেও এক ঝলক রুপালী জ্যেস্নায় নির্বিঘেœ বিচরন করেন

রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো

পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম,মন্ত্রীর বদলে কবি

মাইক্রোফোনের বদলে বিহ্বল বকুলের ঘ্রাণ?(রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন?) 

কখনো কখনো মনে হয় শহীদ কাদরী আমাদের কাছে উপন্যাসের অনেক না বলা কথা নায়কের মতোই রয়ে গেলেনতাঁর নিত্য পাইপ নিঃসৃত সাদা ঁেধায়া যেন ব্যাকুল আগ্রহে কবি শহীদ কাদরীকেও এক ঐন্দ্রজালিক আবরণে নিত্য আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়কবি শহীদ কাদরী কি সেই মিষ্টিক ধোঁয়া থেকে বের হয়ে কখনই আমাদের সামনে ধরা দিবেন না? কবিতো নিজেই বলেছেন,

হে আমার শব্দমালা, তুমি কি এখনও বৃষ্টি-ভেজা

বিব্রত কাকের মতো

আমার ক্ষমতাহীন ডাইরির পাতার ভেতরে বসে নিঃশব্দে ঝিমুবে(কবিতা, অক্ষম অস্ত্র আমার) 

শহীদ কাদরী কি জানেন যে বাংলার কাব্যমোদীরা তাঁর কবিতার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে? কবির কবিতা আবার জেগে উঠুক