কিভাবে (এবং কেন) আমি অবিশ্বাসী হলাম

আয়ান হারসি আলি

 

অনুবাদক: অগ্নি অধিরূঢ়

 

সোমালিয়ার হাসপাতালগুলোর মেটারনিটি ওয়ার্ডে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে গেছেন বলে আয়ান হিরসি আলি তার বই "অবিশ্বাসী" (Infidel) তে উল্লেখ করেছেন। খুব সম্ভবতঃ তার আন্দাজ সঠিক। তার বর্ণনা শুনলে যে কেউ এটা বুঝতে পারবেন। নিজ সমাজের বিভিন্ন উপাদান, যেমন অঙ্গচ্ছেদ, ভগাঙ্কুরের প্রতি নিষ্ঠুরতা (খনা), আদিম ধর্মীয় বর্বরতা এসব তার বইতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বারবার এসেছে। যে কেউ আয়ান হারসি আলির মন্তব্যের যথার্থতা বুঝতে পারবেন। তার জন্মভূমির পশ্চাপদ ইসলামি সমাজ থেকে পালিয়ে এসে হল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহন করেছেন।

 

হারসি আলি তার সহকর্মী "থিও ভ্যান গঘ (Theo Van Gogh) -কে আমস্টারডামের প্রকাশ্য রাস্তায় নিহত হতে দেখেছেন। ভ্যান গঘ ইসলামের অবমাননা করেছেন এই অজুহাতে সন্ত্রাসীরা কসাইয়ের মত তার গলা কেটে ফেলেছিল। হারসিকেও স্পষ্টাক্ষরে জানানো হয়েছে যে ধর্মীয় উন্মাদনার পরবর্তী শিকার হবেন তিনি নিজে। ইসলাম হয়ত নিজেকে আরও পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করার জন্য উদারতাবাদকে গ্রহন করবে- এরকমের একটি ভুল ধারনার প্রতি তিনি প্রাথমিকভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু বেশ দ্রুত তিনি বুঝতে পেরেছেন যে সমস্যাটা আসলে বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত। এটা বোঝার সাথে সাথেই তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসের অর্গল থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন (অন্যদেরকেও মুক্ত হবার জন্য আহবান জানিয়েছেন এবনং সে অনুযায়ী সাহায্য করছেন)।

 

ধর্মানুভূতি যে স্বৈরাচারী মনোভঙ্গির সৃষ্টি করে তা থেকে মুক্তির এক সাহসী বার্তা তিনি ঘোষণা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি অন্যদের মনের অন্ধকার দূর করতে সহায়তা করছেন। বাজে এবং অপগণ্ড মতবাদ "জিহাদ" (Jihad) এর অন্যান্য শত্রুর মত তিনিও এখন আত্মগোপনে থেকে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। সব ধরনের ঈশ্বরকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখা এই বিশেষ প্রবন্ধ দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। - ক্রিস্টোফার হিচেনস[*]

 

 

যখন আমি শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে স্বীকার করলাম যে, "আমি আসলে একজন অবিশ্বাসী", তখনই আমার চেতনা ফিরে আসলো, এর কারণ হল, - বিশ্বাসী বলে পরিচয় দিয়ে আমি আর কোন ভন্ডামী করতে চাইনি। আল্লাহকে পরিত্যাগ করা আমার জন্য এক দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া ছিল। আমি অবিশ্বাসী হওয়াকে ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেছি। আমি আমার গোত্রের চোখে একটি ভাল মেয়ে হতে চেয়েছিলাম। এর অর্থ হল যে, আমার একজন ভাল মুসলিম নারী হওয়া উচিত, যে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে শিখেছে। ভাল মেয়ে হওয়ার অনুশীলনীতে আমার ভাই, বাবা এবং পরে আমার স্বামীর বাধ্যানুগত থাকাকেও বোঝায়। যখন আমি শিশু ছিলাম, তখনই বিভিন্ন অনৈতিক বিষয়ে আমার শিশুমন আন্দোলিত হত। আমি কোনক্রমেই বুঝতামনা যে আল্লাহ যদি সত্যিই পরম করুণাময় এবং সর্বশক্তিমান হন, তাহলে কেন কিছু বিষয়কে তিনি সহ্য এবং উসাহিত করেন। যেমন: আমি মেয়ে বলেই নামাজের সময় আমার ভাইয়ের পিছনে দাঁড়াতে হবে কিংবা বা তার সমস্ত বাতিককে চোখ বন্ধ করে আমার মেনে নিতে হবে। কিংবা কোর্টে আমার মতামত এবং সাক্ষ্যকে তার মতামতের চাইতে কম গুরুত্ব দেয়া হবে ইত্যাদি। কিন্তু লজ্জা এবং বাধ্যানুগত থাকা আমার অন্তরে অনবরত গভীর যন্ত্রণার সৃষ্টি করত। ছোটবেলা থেকেই আমি নিজের মনে বিষয়গুলি নিয়ে ক্ষতবিক্ষত হতাম। আমি আমার গোত্র, ধর্মীয় শিক্ষক এবং পিতামাতাকে তো কম শ্রদ্ধা করিনি; কিন্তু এক পর্যায়ে আমি আমার প্রশ্নগুলো নিয়ে নিজের কাছেই লজ্জা পেতে শুর করলাম। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি আমার মুরুব্বীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি।

 

যখন আমি কৈশোরে পদার্পন করলাম, তখন আমার বিদ্রোহ আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু তখনও আমি ইসলামের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠিনি। ভাবতাম, আল্লাহ'র সাথে প্রতিযোগিতা করার আমি কে? কিন্তু আমি যে সোমালী গোত্র এবং আমার পরিবারের কাছে বন্দী এটা বেশ বুঝতে পারতাম। এখানে পারিবারিক সম্মানটাই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। এর দ্বারা নারীর কুমারীত্বকে নিয়ন্ত্রণ, ধরণ ও বিনিময় করাকে প্রধাণতম বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন পশ্চিমা বই পড়ে এমনকি নিম্নমানের রোমান্টিক বইগুলো থেকেও আমি এক ভিন্ন জগতের সন্ধান পেলাম। আমার অন্তর্দৃষ্টি যেন খুলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এই মহাবিশ্বে এমন জায়গাও আছে যেখানে নারীর নিজস্ব পছন্দকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

 

তখনও আমি নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। আমি স্বত:প্রবৃত্ত হয়েই কালো রঙের হিজাব পড়তাম। এটা আমার শরীরকে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখত। আমি দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তাম। কোরান এবং হাদীসের অসংখ্য কঠোর অনুশাসনকে নিয়মমতো মেনে চলার চেষ্টা করতাম। এইগুলো আমি যতটা সম্ভব বেশি বেশি করে করার চেষ্টা করতাম, কারণ ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত দোজখকে আমি খুব ভয় পেতাম। কোরানে যন্ত্রণাদায়ক দোজখের স্পষ্ট ও জীবন্ত বর্ণনা আছে। যেমন: শরীরে ক্ষত করা, ফুটন্ত পানি, চামড়া টেনে তোলা, আগুনে পোড়ানো, নাড়িভুড়ি গলিয়ে ফেলা ইত্যাদি। যতক্ষণ না দেহের মাংস পুড়ে কালো হয়ে যায়, গলে যাওয়া শরীর ফুটতে শুরু করে, সেরকম অনন্তকাল ধরে প্রজ্জ্বলিত আগুনে নাকি  পোড়ানো হবে। এরপর আবার নতুন হাড়-মাংস- চামড়া গজাবে, তখন আবার পোড়ানো হবে। আমি প্রত্যেক ধর্মগুরুকে এইসব বীভস দু:স্বপ্নকে সম্মোহিতের মতো বারবার বর্ণনা করতে দেখেছি। আমি তাদের বিস্তারিত বয়ান শুনে মানসিকভাবে আঘাত পেতাম, আতংকিত হতাম। আর ভাবতাম, এসব সত্যিই ভয়ংকর।

 


সিএনএন এর এন্ডারসন কুপারের সাথে সাক্ষাকারে আয়ান হারসি আলি

 

শেষপর্যন্ত আমার ধারণা, আমার প্রিয় বইগুলো আর ছেলেপিলেরা আমাকে রক্ষা করল। আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আমি কতভাবেই না নিজেকে সমর্পণ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারপরেও আমি আকাঙ্ক্ষাবোধ করেছি। যৌনাকাঙ্ক্ষা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি সত্যিকারের যৌনতৃপ্তি পেতে চেয়েছিলাম। এমনকি দোজখের আগুনের ভয়ও আমার এই আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারেনি। এই ভাবনার কারণে আমি  সে সময় নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম (কারণ ইসলামী সমাজে মেয়েদের এই ধরণের চিন্তাকরাও পাপ)। কিন্তু যখন আমার পিতা এক অজানা অচেনা লোকের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইলেন তখন আমি নিজেকে ভালমত চিনলাম। আমি বুঝতে পারলাম এমন কোন ব্যক্তির সাথে বিছানায় আটকে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যে নপুংশক আমাকে শীতল করে বিছানায় ফেলে রেখে বেঘোরে ঘুমাবে ।

 

আমি পালিয়ে গেলাম। হলান্ডে গিয়ে থামলাম। অসংখ্য বন্ধুবসল ও সহানুভূতিশীল ডাচ মানুষের সহায়তায় আমি নিজের ভিতরে এই আত্মবিশ্বাস জাগাতে পেরেছিলাম যে নিজ গোত্রের বাইরে আমার একটা ভবিষ্য আছে। আমি মুসলিম সমাজকে আবিষ্কারের নেশায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি জানি যে, আল্লাহর নিজস্ব সমাজগুলো সব দারিদ্রপীড়িত ও সহিংস। অথচ ঘৃণ্য অবিশ্বাসীদের দেশগুলো ধনী ও শান্তিপূর্ণ। সেই দিনগুলোতে আমি তখনও মুসলমান ছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছাকে ব্যঙ্গ বা নিন্দা করার মন মানসিকতা আমার ছিল না। আমি শুধু এটাই আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলাম যে, এতকাল যা চলে আসছে তা পুরোপুরি ভুল ছিল।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আমি ধীরে ধীরে আমার বিশ্বাসকে হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি যে ধারণা ও ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছিলাম তা ছিল খুবই উত্তেজক ও শক্তিশালী। কিন্তু আমি যে দৃষ্টিকোন ধারণ করে বড় হয়েছি, তার সাথে এগুলো ভয়ানকভাবে বিরোধীতা করে। প্রথম দিকে যখন বিভিন্ন ধারণাগত অনৈক্য বেশ জোরালো হত তখন আমি মন থেকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিতাম। স্পিনোজা, ফ্রয়েড, ডারউইন, লক এবং মিলের ধারণাগুলোকে যেরকম আপন মনে হত, কোরানকেও আমার একইরকম সন্দেহাতীত সত্য বলে মনে হত। তারপরও মনের মধ্যে কিছু খচখচানি ছিলোই, একদিন আমি কোরানের সাথে অন্যদের পার্থক্যগুলো মিটিয়ে ফেলবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এই সময়ে আমি আমার পড়া বন্ধ করিনি। আমি জানতাম এই বিতর্ক দুর্বলতার পরিচায়ক, কিন্তু আমি নিজেকে বলতাম যে - আল্লাহ নিশ্চয়ই জ্ঞানের পক্ষে থাকবেন।

 

পাশ্চাত্যের গোত্রহীন সমাজের অনামা ও আনন্দময় জীবন, সংস্কারমুক্ত দার্শনিকদের ভাবনা আমাকে তখন সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। লম্বা লম্বা আলখাল্লা সদৃশ পোশাক আশাক পরে সারাদিন কাজকর্ম করা অসুবিধাজনক, তাই হল্যান্ডে পৌঁছার অব্যাবহিত পরে আমি মুসলিম পোষাক বাদ দিয়ে জিনস পরা শুরু করলাম। আমি প্রথমেই অন্যান্য সোমালিয়দের সাথে ওঠাবসা বন্ধ করলাম। এরপর মুসলমানদের সাথেও মেলামেশা বাদ দিলাম। এরা আমাকে সবসময় পরকাল নিয়ে ভয় দেখাত। আমি যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছি এ বিষয়ে তারা সাবধান করত। প্রায় এক বসর পরে আমি মদের প্রথম গ্লাসটি খালি করলাম। ভয়ে ভয়ে একজন বয়ফ্রেন্ডও জুটিয়ে ফেললাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, দোজখের আগুন কিংবা  কোন আসমানী বজ্রপাত আমাকে পোড়ায় নি। পরিণতি হিসেবে কোন খারাপ ঘটনাও ঘটে নি। মনকে শান্ত করার জন্য আমি নিজের ভিতরে আল্লাহর সাথে 'দরদাম' করার এক মানসিকতা তৈরি করলাম। আমি নিজেকে বলতাম -এগুলো ছোট পাপ, এসব কাউকে আঘাত করছে না। আমি নিশ্চিত আল্লাহও এইসবে খুব একটা মন খারাপ করবে না।

 

এই সময়ে আল্লাহ ও তার নবীর নামে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হল। আমি সেদিন গভীরভাবে অনুভব করলাম যে, আমাকে কোন না কোন একটি পক্ষ গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের সাথে রক্তপাতের ঘনিষ্ট সম্পর্ককে যারা প্রত্যাখ্যান করে সেইসব পশ্চিমা আশাবাদী চিন্তাবিদ এবং মুসলিম কর্তৃপক্ষদের গলাবাজির তুলনায় ওসামা বিন লাদেনের কর্মকান্ড কোরান ও সুন্নাহ'র নীতিমালার সাথে অনেক বেশি সঙ্গতিপূর্ণ মনে হল। আমি কি একজন মুসলমান হিসেবে বিন লাদেনের যুদ্ধপ্রেমকে সমর্থন করব? আমি কি একে আল্লাহ'র আদেশ হিসেবে গভীরভাবে বিশ্বাস করব? এবং যদি না করি, তাহলে আমি কি একজন মুসলিম?

 

আমি একটি বই হাতে তুলে নিলাম- "নাস্তিকের ইসতেহার (The Atheist Menifesto)", লেখক "হারম্যান ফিলিপস (Herman Philipse)"। ইনি পরে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হয়েছিলেন। আমি পড়া শুরু করলাম, লেখকের উদ্দীপনা ও স্পষ্টবাদিতা দেখে মুগ্ধ হলাম। কিন্তু আমার অতটা দরকার ছিল না। আমি শুধু একটু দেখে নিতে চেয়েছি। যা সন্দেহ করেছি তা ঠিক বুঝেছি কিনা তা পড়ে বুঝতে চেয়েছি। চার পৃষ্ঠা পড়ার আগেই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি বছরখানেক আগেই আসলে আল্লাহকে ত্যাগ করেছি। আমি ধীরে ধীরে একজন মুরতাদ বা অবিশ্বাসী হয়ে গেছি। আমি একটা আয়নার দিকে তাকালাম, এবং সোমালি ভাষায় চিকার করে বললাম -"আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি না"।

 

আমি ভারমুক্ত হলাম। আমি কোন বেদনাবোধ করলাম না বরং সবকিছু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। আমার বিশ্বাসের যে কাঠামো তার দোষত্রুটি নিজেই বিস্তারিত দেখতে পেলাম। বিশ্বাসের বিভিন্ন রকম দুর্বল ভঙ্গুর অংশগুলো আমি চিহ্নিত করতে পারলাম। কাঁচভাঙ্গার শব্দের মত ঝন ঝন করে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ার শব্দ নিজেই যেনো শুনতে পেলাম। বিশ্বাসের সামান্য অবশেষটুকুও আর আমার মধ্যে রইল না। আমার মনের গভীরে গেথে থাকা দোজখের আগুনের ধারণাটি উপড়ে গেল। আমার মনের দিগন্ত আরও প্রসারিত হল। আল্লাহ, শয়তান, ফেরেসতা এসব মানুষের কল্পনা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। মানুষের দুর্বলচিত্তের উপর জোর খাটানোর কিছু পদ্ধতি ছাড়া এসব আর কিছু নয়। আমি বুঝলাম আমার মনের শক্তি ফিরে এসেছে - এখন থেকে আমি আমার পায়ের নিচের মাটিতে দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ রাখতে পারব। আমার প্রতিটি আচরণ নির্ভর করবে যথাযথ কারণ ও আত্মসম্মানের উপর। আমার নৈতিক কম্পাস থাকবে আমার নিজের ভিতরেই, কোন বাহ্যিক পবিত্র গ্রন্থের মধ্যে নয়।

 

পরবর্তী মাসগুলোতে আমি বিভিন্ন জাদুঘরে যাওয়া শুরু করলাম। আমি মনে করি - বিভিন্ন শহরের ধ্বংসাবশেষ, মমি ও পুরনোকালের মৃত মানুষদের দেহাবশেষ দেখার দরকার আছে। মারা যাবার পর কেমন হয়ে যাব এটা ঐসব হাড়, কংকাল দেখে আমি বুঝতে পারব। আমি কিছু হাড়ের স্তুপে পরিণত হব। আমি লক্ষ্য করলাম জাদুঘরের কিছু কিছু হাড় ৫ শত মিলিয়ন বসরের পুরন। মৃতুদের আবার জীবিত করে তুলতে আল্লাহর যদি এর চেয়েও বেশি সময় লাগে তাহলে আমার জীবনকারের মধ্যে শাস্তিকে অনুসন্ধান করার চাইতে বরং স্পষ্টভাবে উপেক্ষা করা যেতে পারে।

 

আমি মানসিকভাবে আল্লাহকে ছাড়া জীবন যাপন করার একটা ব্রত গ্রহন করেছিলাম। এর অর্থ হল - আমি স্বীকার করছি জীবনকে অর্থবহ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আমার নিজের। আমি এক সত্যিকারের গভীর নৈতিক বোধের অনুসন্ধান করেছিলাম। ইসলাম ধর্মে তুমি হলে আল্লাহর ক্রীতদাস মাত্র। আত্মসমর্পন করা ক্রীতদাস। এর অর্থ তোমার নিজস্ব কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই। তুমি স্বাধীন সত্ত্বা নও । আসলে তুমি দোজখের ভয়ে ভাল সেজে আছ। এটা আসলে এক ধরনের প্রতারনা, চরম ধোঁকাবাজী। এটা তোমার নিজস্ব কোন নীতিবোধ নয়।

 

এখন আমি নিজেকে বলতে পারি, স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের পথ প্রদর্শক। আমরা নিজেরাই ভাল ও মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারি। নিজেদের জন্যই আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। আমরা নিজেরাই নিজেদের নৈতিকতার দায়িত্বভার নিতে পারি। আমি শেষ পর্যন্ত একটা উপসংহারে পৌঁছেছি যে, আমি যদি নিজের কাছে স হতে না পারি, তাহলে অন্যদের কাছেও স হতে পারব না।

 

আরও ভাল ও উদার মানুষ হবার জন্য আমি ধর্মকে মেনে নিতে চাই; কিন্তু আমার ইচ্ছাকে দমন করে নয়। এক জটিল, দুর্বোধ্য এবং অমানবিক ও বিস্তারিত আইনের গোলক ধাঁধাকে মেনে আমার পক্ষে ধর্মকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। জীবনে আমি বহুবার মিথ্যা কথা বলেছি, প্রতারণা করেছি নিজের সাথেই। কিন্তু এখন আমি নিজেকে বলতে পেরেছি -"সেই দিন চলে গেছে"। একসময় অনেক মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন ছিল।

 

আমার স্মৃতিকথা "অবিশ্বাসী" (Infidel) (২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত) লেখার পর যুক্তরাষ্ট্রে এক Book Tour এ গিয়েছিলাম। যিশু খ্রিস্টের বাণীকে গ্রহন করব কি না -এই প্রশ্নটি সাক্ষাপ্রার্থীরা আমাকে প্রায়ই করেছে। এই ধরনের প্রস্তাবের উদ্দেশ্য এমন - ইসলামের চেয়ে আরেকটু ভাল, অধিকতর মানবিক এই ধর্মকে গ্রহন করা উচিত। বিশ্বাস না করার চাইতে এটা অনেকগুণ ভাল। সেই কথাবলা সাপ ও স্বর্গীয় বাগান, আদম হাওয়া গন্ধম ফলের রূপকথা থেকে যে ধর্মের জন্ম –সেই ধর্ম? এ ধরনের প্রসঙ্গ এলেই আমার কালাজ্বরে আক্রান্ত হবার মত অনুভূতি হয়। আমি যে ধরনের কল্পনা নিয়ে বেড়ে উঠেছি, সেই মুসলিম ধারনার চাইতে খ্রিস্টানদের দোজখের বর্ণনা একটু কম নাটকীয়। আমার পিতামহীর ফেরেসতা ও জ্বীনগুলোর চাইতে খ্রিস্টানদের জাদুকরী কল্পনাগুলো আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়নি।

 

কোনরকম আশংকা ছাড়াই নাস্তিকতাকে আমি গ্রহণ করেছি। এটা কোন ধর্মীয় মতবাদ নয়। বেহেশতের সুমধুর সঙ্গীত এবং দোজখের আতংক ছাড়াই মৃত্যু আসে। এই পৃথিবীর জীবন হল তার সমস্ত রহস্য, সৌন্দর্য ও বেদনাসহ আরও অনেকদিন বাঁচবার এক উদগ্র আকাঙ্ক্ষা। আমরা চলার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। আমরা দু:খী, আত্মবিশ্বাসী, নিরাপত্তাহীন, একাকীত্ব বোধ করি এবং আনন্দ করি ও ভালবাসি। পৃথিবীতে এর চাইতে বেশি কিছু নেই। আমি এর চাইতেও বেশি কিছু চাই না।


[*] আয়ান হারসি আলি ( AYAAN HIRSI ALI) রচিত How (and Why) I Became an Infidel শীর্ষক এই লেখাটি ক্রিস্টোফার হিচেনস ( CHRISTOPHER HITCHENS) সংকলিত THE PORTABLE ATHEIST বই থেকে নেয়া হয়েছে।

 ****

অগ্নি অধিরূঢ়, বাংলাদেশে বসবাসরত মুক্তমনার নিয়মিত লেখক। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।  ইমেইল - [email protected] িজস্ব ব্লগে লিখে থাকেন