নাস্তিকতার ইশতেহার

অনুবাদ: অগ্নি অধিরূঢ়

প্রথমত বলতে চাই, সব কারণগুলোই যে সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক তা হয়তো নয়। কিছু কিছু কারণ আছে যেগুলো বিষয়গতভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে। এই আলোচনায় নাস্তিক বলতে যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। 

১। আমি এখন পর্যন্ত ঈশ্বর বা দেবতাদের সাথে মানুষের দেখা হবার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাইনি। ঈশ্বরের সাথে মানুষের সাক্ষাতের যেসব ঘটনার কথা শোনা যায়, তার সবগুলোই ধোঁয়াশায় ঢাকা। আর এ ধরণের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘুমের মধ্যে অথবা অসংলগ্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে ঘটেছে। মানুষ যখন নিজে নিজে প্রভাবিত হতে চেয়েছে কিংবা মাদকাচ্ছন্ন ছিল তখন এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে। এই ধরণের ঘটনা পরিশেষে গুজবে পরিণত হয়েছে। বস্তুত: এ ধরণের ঘটনাগুলো সব অতিলৌকিক, অপরিমাপযোগ্য এবং অবিশ্বাস্য ধরণের। চোখ বন্ধ করে এই ঘরণের ঘটনাকে গ্রহণ করার চাইতে বরং অবিশ্বাস করা সহজ। 

২। পৃথিবীতে সহস্র রকমের ধর্মীয় বিশ্বাসের কাঠামো রয়েছে। এগুলো কখনও বেশি বা কখনও স্বল্প উপায়ে অন্যদের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে। সাধারণত: আত্মসমালোচনাহীন মানসিকতার কাছে সবগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে। এদের মধ্যে কোন কোনটা আবার দেবতাবিহীন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল কোনটা সঠিক? যদি কোন একটি হয়, তাহলে কেন? কেনই বা একটি ধর্ম প্রধানতম হবে? কোন একটির যথার্থতা কি সবগুলোর অসারতার কথা বলে না? 

৩। ইতিহাসের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাক্ষেত্রে  ঈশ্বরের প্রভাব কমে যাচ্ছে। যদি ঈশ্বর না থাকেন তাহলে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা যেসব বিষয় বুঝিনা শুধুমাত্র সেসব বিষয়ে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অন্যভাবে বললে, সম্ভাব্য অতিলৌকিক ঘটনা হিসেবে প্রচলিত ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। যাহোক, ৫০০ বছর আগে বেহেশতের সত্যতা নিশ্চিত করতে ঈশ্বরের দরকার ছিল। আর এখন আমরা জানি প্রকৃতির চারটি শক্তি ও বস্তুর তিন অবস্থা দ্বারা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আরও নতুন কোন আবিষ্কার এসে ধারণাগত ঈশ্বরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না করে ততক্ষণ পর্যন্ত এই নতুন ধারণা প্রচলিত না থাকার কোন কারণ আমি দেখি না। 

৪। যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকেন, তাহলে তার অস্তিত্বের স্বরূপ কি? বা ঈশ্বরের সৃষ্টির ঘটনাটা কিরকম? এ প্রসঙ্গে বিগ ব্যাং থিওরীর সহজবোধ্যতার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্টির স্বপক্ষে এ ধরণের কোন আইডিয়া এখন পর্যন্ত আমার কানে আসেনি। 

৫। যে সব মানুষ এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান রাখেন তারা জানেন এই মহাজগতকে সচল রাখার জন্য কোন কল্পিত ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। (যেমন: আলবার্ট আইনস্টান, আইজাক আসিমভ, ডেভিড সুজুকি, আর্থার সি ক্লার্ক প্রমুখ। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা দুর্বলতার পরিচায়ক। কিন্তু ধর্মপ্রচারকরা যেভাবে বিশ্বাস করার জন্য চাপ দেন তার চাইতে কর্তৃপক্ষ যখন নিজেকে খুঁজে পাবার জন্য আমাকে উপদেশ দেন সেটা আরও বেশি দুর্বল মনের পরিচয় প্রকাশ করে। আমি বিজ্ঞান এবং দর্শন সম্পর্কে অনেক বেশি জানেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করার জন্য পরকালের প্রয়োজনীয়তায় যে বিশ্বাস তা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অসুস্থতামাত্র। 

৬। আপাতদৃষ্টিতে বেশিরভাগ ধর্মগুলো নিখুঁত সাহিত্যকীর্তি বা নিছক কল্পনা প্রবণতাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর বয়স, মানুষের আদি উসের সময়কাল, সহস্য বসরের ইতিহাসে ইত্যাদি বিষয়ে ধর্ম থেকে ধর্মে অনেক পার্থক্য আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূবিজ্ঞানী, প্রাণিবিজ্ঞানী এদেরও অন্বেষণের সাথে ধর্মের বক্তব্যের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। 

৭। Monty Python বইটির অর্ধেকও আমি উপভোগ করতে পারিনি। হয়তো আমি নাস্তিক বলেই এমন ঘটেছে। কিন্তু MMPI এর পরীক্ষায় নিউইয়র্কের ক্যাথলিকদের মধ্যে অনেক ধর্মনেতাকেক Paranoid Schizophrenic পাওয়া গেছে (সম্ভবত ৬০% এর বেশি)। শুধু তাই নয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের মধ্যে মৃগীরোগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা কম নয়। অন্যভাবে বললে বলা যায় ধর্মীয় কার্যাবলীতে যারা নিয়োজিত তারা অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ। 

৮। সান্তা ক্লজ, ইস্টার বালি, ঈশ্বর, দানব এবং কিংবা গোলাপী শিংওয়ালা ঘোড়া (Unicorn), এদের মধ্যে আমি কোন পার্থক্য কখনও দেখিনি। যখন আপনি ছোট ছিলেন তখন আপনার পিতামাতা এই গল্পগুলো আপনার কাছে করেছিল। এমন কি এখনকার বাবা মায়েরাও এসব গল্প শিশুদের কাছে বলে থাকে। এখন আমি কেন খ্রিস্টান নই এ বিষয়ে নিদিষ্ট করে কিছু বলব। 

৯। অসংখ্য বিশ্বাসীর সাথে আমি ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করেছি (এর মধ্যে তিনজন আমার প্রভাবে নাস্তিক হয়ে গেছে)। এদের মধ্যে বেশির ভাগ সাধারণ অসঙ্গতিগুলোর কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে পারেনি। এটা ঠিক যে এদের অনেকে ধর্মের জন্য জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তারপর যখন আদর্শের কানাগলিতে আটকে গেছে তখন মানসিক বিভ্রান্তিতে ভুগেছে। এই ধরণের সমস্যায় পড়ে তারা বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কে চিন্তা করা বাদ দিয়ে দেয়। মানসিক বিভ্রান্তির খাত না ভোগ করার চাইতে সবকিছুকে সোজাসুজি বিশ্বাস করা বরং তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। কিন্তু এমনটা আরও বেশি বিভ্রান্তি তৈরি করে। তাই আমি মেনে করি খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদেরকে বিভিন্ন মতবাদে বন্দীত্ব দশা থেকে উদ্ধার করার জন্য ধর্মান্ধতাকে সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। 

১০। মনস্তত্ত্ব পড়ার কারণে আমি বুদ্ধিবৃত্তির সাথে স্নায়ুতন্ত্রের সম্পর্কের বিভিন্ন গতিপ্রকৃতি আমি চিনি। কয়েকরকমের অপারেশন আছে যার মাধ্যমে কারও নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বদলে ফেলা সম্ভব। ব্যক্তির নিজস্ব সচেতনতা, স্মৃতি, প্রতিক্রিয়া, চিন্তা সামর্থ্য, চিন্তা পদ্ধতি ইত্যাদি যেগুলোর সাথে মন বা আত্মার সচলতাকে মেলানো হয়, এর সবগুলো বিভিন্ন আধুনিক চিকিসা দ্বারা প্রভাবিত করা সম্ভব। মগজের বস্তুগত কাজকে কেন আত্মার সাফল্য বলে মনে করব? তার চাইতে এমনটা বিশ্বাস করা সহজ (এবং সঠিক) নয় কি যে এই ব্যক্তিত্বের সক্রিয়তা আসলে সরাসরি মগজের প্রভাব, কোন অলৌকিক আত্মার নয়। 

১১। ইতিহাস বলে যে, যে সব দৃষ্টিকোন বা মতবায় ভয়ংকর রকমের আক্রমণাত্মক সেগুলো শত শত বসর ধরে টিকে আছে। এই ধরণের হিংস্র আক্রমণাত্মক ধর্মের উদাহরণ হল খ্রিস্টান, ইহুদী এবং ইসলাম। আগ্রাসী আচরণের কারণে এখনও এগুলো প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এর অর্থ কি এমন যে অন্তত এই আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী মতবাদগুলোই সঠিক পথ? 

১২। মুসলমানরাসহ বিভিন্ন ধর্মের অসংখ্য মানুষ দৃঢ়তার সাথে বলেছে যে কোন একটি পরম শক্তি বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সত্যিই তারা অনুভব করেছেন। যখন তারা কোন বিশেষ ধর্মীয় আচরণে গভীরভাবে ডুবে যান, তখন এক অনন্য পরমানন্দ তারা অনুভব করেন। এমন অনুভূতি ঈশ্বরের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়। প্রসঙ্গক্রমে জানাচ্ছি যে, তারা যেমন বলেছে আমিও ঠিক একইরকম এক ভিন্ন অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। আমি একরাতে যখন পাহাড়ের চুড়ায় মেঘমুক্ত আকাশের নিচে শুয়েছিলাম, তখন আমার মনে হল এই পৃথিবীটা যেন এক বিরাট মহাকাশযান। আমাদেরকে নিয়ে এই পৃথিবী ছায়াপথ থেকে ছায়াপথে তুমুলবেগে ছুটে চলেছে। পরিপাশ্বের বিশালতা ও সৌন্দর্যে আমি এত বেশি অভিভূত হয়েছিলাম যে, কয়েক ঘন্টার জন্য আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। তা যা হোক, আমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের মূল সূত্রগুলো জানি। এর সৃষ্টির জন্য কোন ঈশ্বরের প্রয়োজন পরেনি। আর যদি কোন সৃষ্টিকর্তা থেকেও থাকে, তাহলে বলতে হবে যে তিনি সমকালে কিছুই করছেন না। 

১৩। কোন কিছুকে অপরাধবোধের সাথে বিশ্বাস করলে প্রশ্ন করাকে কঠিন করে তোলা হয়। এই ধরণের আত্মসমর্পণ আমার সামর্থ্যের অতীত। আমি এমনটা কোনক্রমেই করতে পারি না। আমার একটি অনুসন্ধিসু মন আছে। আমি আমার বিশ্বাসগুলোর ত্রুটি বুঝতে পেরেছি। আর এটা ভবিষ্যকালেও বহাল থাকবে। প্রশ্নাতীত কোন চরম শক্তিকে বিশ্বাস করা, সকলের প্রিয় দেবদূত বা ফেরেশতাকে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব। প্রশ্ন করাকে বাধা দেয় এই বিশেষ কারণটিই তাদেরকে অবিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট জোড়ালো কারণ।

১৪। নিকট অতীতে প্রায়ই মানুষকে মন্দ আত্মা বা মন্দ স্বভাব থেকে মুক্তির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হত। রাজারা ঐশ্বরিক অধিকার পেয়ে দেশ শাসন করছেন বলে অঙ্গীকার করতেন। আবার কখনও তারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের বংশধর বলে দাবী করতেন, কখনও বা নিজেকেই ঈশ্বর বলে ঘোষণা করতেন। নির্যাতন, গণহত্যা, জাতিবিদ্বেষ, দাসত্ব, বহুগামীতা, আক্রমণ, গণধর্ষণ এবং যুদ্ধগুলোকে ধর্মীয় সৃষ্টিকর্তার সমর্থণের কারণে নীতিসম্মত বলে মেনে নেয়া হত। এইসব কারণে ধর্মকে একটি ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র বলে আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে এইসব অপরাধের আমিও একজন ভাগীদার। ওই কুসিত, নোংরা, বীভস আচরণগুলোর কোন সহযোগী আমি আর হতে চাই না। 

১৫। ধর্মগুলো মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ইস্যূতে প্রায় ভুল করে। কখনো কখনো পিছু হটে যায়। যদি চার্চের নিয়ন্ত্রক্ষমতা সত্যিই পরমশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত, তাহলে এ ধরণের ভুল তারা করত না। পরম শক্তির ভাবমূর্তি রক্ষা করবার জন্য এ ধরণের আচরণ তারা করে। বস্তুত যে শাসনব্যবস্থা নিজেদের ভুলগুলোকে স্পষ্টভাবে হাস্যকর করে না তোলা পর্যন্ত সংশোধন করে না, সেই শাসনব্যবস্তার ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা তারা করে। যেমন গ্যালিলিও, বিবর্তনবাদ ইত্যাদি। 

১৬। খ্রিস্টিয় ধর্মের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা বা অপকর্মগুলি যখন আমি চিহ্নিত করি, তখন খ্রিস্টানরা সাধারণত বলে যে, ওহ আচ্ছা, ওরা সাচ্চা খ্রিস্টান না, আমি এবং আমার চার্চ অন্যরকম। এই ধরণের ঘটনা এতই সাধারণ যে, প্রত্যেকে নিজেকে সাচ্চা খ্রিস্টান বলছে, পক্ষান্তরে অন্য হাজারজন সেই তাকেই আবার ভিন্নপথের যাত্রী বলে মনে করছে। 

১৭। চার্চের শিক্ষা যৌন উত্তেজক, বিচারপ্রবণ, আক্রমণাত্মক, সামঞ্জস্যহীন। শুধু তাই নয়; এই শিক্ষা সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপনের দর্শন শেখানোর জন্য যথেষ্ঠ উপযোগী নয়। 

১৮। এক শিশুতোষ ও ভয়ঙ্কর ঈশ্বরের শত শত দ্ব্যর্থবোধক, পরস্পরবিরোধী, আরোপিত ও রক্তলোলুপ বাক্য দিয়ে বাইবেল ভর্তি। যারা এই তথ্যকে স্বীকার করে না, তারা হয় ভালভাবে বাইবেল পড়েনি, অথবা কোন জটিল মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। 

বাইবেল যে আসলে সংকীর্ণ চিন্তাধারার আকর- এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। এছাড়াও এই বইয়ের অকেন সংস্করণ আছে। এটা সবসময় আপডেট (পড়ুন নতুনভাবে লেখা) করা হচ্ছে। ধর্মীয় নেতারা নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে সবসময় এই কাজ করে যাচ্ছেন। 'বাইবেলের মত কোন কিছু নয়'_ এ ধরণের কথা বলাটা "অ্যাপল কম্পিউটার আইবিএমর এর চেয়ে ভাল" - এভাবে বলার মত। কারণ কোন অ্যাপল বা কোন আইবিএম এরকম করে প্রশ্ন তোলা যায় যে 'কোন বাইবেল'। নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীদের দ্বারা যখন পুরনো কোন গোঁড়ামী প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন ধর্মনেতারা বাইবেলে নানারকম পরিবর্তন আনেন। আর মজার ব্যাপার হল এই পরিবর্তনগুলো বেশিরভাগ সময় কোন পুরনো গোঁড়া মতবাদকে ঢাকার জন্য আরেকটি গোঁড়া মতবাদের জন্ম দেয়। 

১৯। মানুষের জন্য আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি খুব বিপদজনক। কিছু কিছু অবিশ্বাসী মানুষ আছেন যারা মনে করে কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছে। এ ধরণের দায়িত্ববোধ আসলে মূল্যহীন। নিজেদের প্রজাতিকে বাঁচানোর জন্য ব্যক্তিগত আমি মনে করি এটা বেশ ভাল সম্ভাব্য ধারণা। আমাদের বোঝা উচিত মহাকাশের অন্যান্য ধুলিকণার মত আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পূর্ণ উদাসীন। এমনকি আমরা যদি বংশবিস্তার করে এই বিশ্বকে ভরিয়ে ফেলি কিংবা আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে ফেলি তাতেও কোন যায় আসে না। আমরা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য দায়বদ্ধ। এ বিষয়ে আমাদের নিজেদের পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে। অতএব আমাদের কোন সর্বশক্তিমান পিতার কোন দরকার নেই। যদি প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের থাতে থাকে আর সেগুলো থেকে সঠিক শিক্ষা যদি আমরা নিতে পারি, তাহলে আমরাই ঠিকঠাক রাখতে পারব। এর সাফল্য আমাদের নিজেদের উপর নির্ভর করবে। ধর্ম মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক হতে উসাহিত করে। এটা মানবগোষ্ঠীর জন্য বরং অনেকাংশে আত্মঘাতী। এজন্য আমি খ্রিস্টিয় বা অন্য যে কোন আত্মকেন্দ্রিক ধর্মের সক্রিয় বিরোধীতা করি।

২০। ইতিহাসে ধর্মের বেশ কিছু বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক প্রভাবক হিসেবে ধর্ম একাধিক সূত্রে মানুষকে সমাজবদ্ধ করেছিল। বিভিন্ন জটিল মহাকালিক বাঁকে মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু এখন আমরা অর্থা এই গোটা মানবজাতি শৈশবকাল অতিক্রম করেছি, কৈশোরে পৌঁছেছি। এখন আর শিশুতোষ রূপকথার জগতে বাস করা আমাদের শোভা পায় না। আমাদের খুব দ্রুত বয়প্রাপ্ত হওয়া উচিত। আরও নানারকম বালখিল্যচিত ঘটনার মুখোমুখি (যেমন: আত্মঘাতী প্রবণতা) আমাদের হতে হবে। আমি শৈশবকে ধরে রাখা নয়, ক্রমান্বয়ে বড় হবার পক্ষে। 

২১। পরকাল বা একটি আত্মার প্রত্যাশা মানুষ কেন করে তা আমাকে কেউ কখনও ব্যাখ্যা করে বলেনি। আমরা কখন একটি আত্মার অধিকারী হয়েছি? জন্মের সময়, নাকি যখন মায়ের ডিম্বাণুকে পিতার শুক্র যখন নিষিক্ত করে ঠিক তখনই? ব্যাপ্টিজমের সময় নাকি কখনই না? ডলফিনদের আত্মা নেই কেন? অনেক প্রশ্নের ব্যাপারে খ্রিস্টান ধর্ম নিরুত্তর থেকে গেছে। রেফ্রিজারেটর, টোস্টার বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করা উচিত কি অনুচিত? এই সব বিষয়ে তথকথিত 'ঈশ্বরের শব্দাবলী'তে কিছু লেখা নেই। যদি ঈশ্বর 'পবিত্র শব্দ'গুলো লিখে থাকে, তাহলে কেন সেখানে অস্পষ্টতা আছে? কেন তিনি কিছু কথা বলতে প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন আর কিছু কথা বলেছেন সোজাসুজি। কেন তিনি রূপক অংশকে সহজবোধ্য ভাষায় বর্ণনা করেন নি। যদি বাইবেল জীবনের ম্যানুয়াল হিসেবে গণ্য হয়, তাহলে বলতে হবে এটা খুব দুর্বল লেখকের লেখা, জীবন ও জগতের বিভিন্ন বিশেষ পয়েন্ট সম্পর্কে এখানে যা আছে তা বিভ্রান্তিকর এবং অস্পষ্ট। আমি নিশ্চিত একজন ঈশ্বরের এর চাইতে আরও ভাল কাজ করতে পারা উচিত ছিল। ধর্মগ্রন্থের বিভ্রান্তিগুলো আমাদের মনে এমন ধারণা তৈরি করে যে এগুলো ঈশ্বরের তৈরি নয়, বরং কিছু মানুষের দলবাজি করার কিছু বিধিবিধান মাত্র। 

২২। শুরু থেকে ধর্মগুলো বিভিন্ন বিষয়ে ভবিষ্যত বাণী করত। এর বেশিরভাগ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। তথ্যসূত্র অনুযায়ী ধর্মীয় নেতারা অনবরত শুভ-অশুভের যুদ্ধ ও ভবিষ্যতের জাগতিক ঘটনা নিয়ে বক্তব্য দিযে থাকে (যেমন: ডাইনী স্ত্রীদের পুনর্জীবনপ্রাপ্তি, কিছুদিন আগে অস্ট্রিয়াতে এটা নিয়ে বেশ শোরগোল হল)। কিছু ইভানজেলিক ঘরাণার নেতারা তাদের দলভুক্তদের বলেছিল-"ঈশ্বর আগামী সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সংখ্যা বাড়িতে ০৩ (তিন) মিলিয়ন করতে বলেছে।" এসব এক ধরণের ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু না। 

২৩। উপরের যুক্তিগুলোর কোনটার পাল্টাযুক্তি আপনারা হয়ত দিতে পারেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যুক্তিগুলো বিশ্বাস ও অবিশ্বাস এই দুয়ের মধ্যে যে কোন একটি বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তের পক্ষে এক জোরালো শক্তি দেয়।