ধর্ম সবকিছুকে বিষাক্ত করে তুলছে

ক্রিস্টোফার হিচেনস

অনুবাদক: অগ্নি অধিরূঢ়

ধর্মের বিরুদ্ধে চারটি পুরনো অভিযোগ আছে। প্রথমত: মানুষ ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ধর্ম সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দেয়। দ্বিতীয়ত: এটা ভুল যে নির্বাণ লাভের জন্য আত্মগত উপলব্ধিকে শক্তি যোগায় একমাত্র ধর্ম। তৃতীয়ত: যৌনতাকে অস্বাভাবিক ও বিপদজনকরূপে উপস্থাপনের কারণ ও ফলাফল। চতুর্থত: ধর্ম সম্পূর্ণভাবে শুভচিন্তার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। 

আমার বালকোচিত কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হওয়ার আগেই আমি এই অভিযোগ চারটি আবিষ্কার করেছিলাম। শুধুমাত্র এই কারণে আমাকে আক্রমণাত্মক বলা যেতে পারে-এমনটা আমি কোনমতেই মনে করি না। অবশ্য এর পাশাপাশি আমি আরও একটি সুস্পষ্ট অশ্লীল ঘটনা চিহ্নিত করতে পেরেছি। এটা হল 'কর্তৃপক্ষের দালালদের দ্বারা ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে'। আমি নৈতিকভাবে নিশ্চিত যে, আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার মত একইভাবে ধর্ম সম্পর্কে একই উপসংহার টেনেছে। আমি ডজনেরও বেশি দেশে শত শত জায়গায় এ ধরণের মানুষদের সাথে মিশেছি। এদের মধ্যে কেউ কেউ কখনও কোন কিছু বিশ্বাস করত না। আবার কেউ বা জটিল সব সমস্যায় পরে বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়েছে। তাদের কারও কারও জীবনে এমন মুহূর্ত আছে যেগুলো অশান্তির কালো পর্দায় ঢাকা ছিল। সেই সময়গুলোতে তারা মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত ছিল। আবার কারও কাছে তা কেয়ামতের আগাম বার্তা বহন করে এসেছিল। অবশ্য সমস্যা মিটে যাবার পর তাদের মানসিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তারা এর ফলে নিজেদের নৈতিক পক্ষপাতকেও ভালভাবে চিনতে পেরেছে। 

আমার নিজের এবং সহচিন্তকদের কাছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আমাদের বিশ্বাস আদতে কোন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কোন কিছুতে আস্থা রাখা আমাদের মূল নীতি নয়। আমরা শুধু যে বিজ্ঞান ও কার্যকারণের উপর নির্ভর করি বা আস্থা রাখি তা নয়। কারণ এগুলো পর্যাপ্ত উপাদানের চাইতেও বেশি প্রয়োজনীয় বলে পরিগনিত। কিন্তু যা কিছু বিজ্ঞানের বিরোধীতা করে বা যথাযথ কারণকে এড়িয়ে চলে তাকে আমরা অস্বীকার করি। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু একটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত। আমরা মুক্তান্বেষা, মুক্তমনাকে শ্রদ্ধা করি, নিজস্ব গরজে নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের আদর্শ নিয়ে কোন রকম গোঁড়ামী করি না। 

বাধাগ্রস্থ বিবর্তন এবং নব্য ডারউইনবাদ এর অপূর্ণ শূন্যস্থানগুলো বিষয়ে প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স এবং প্রফেসর স্টিফেন জে গুল্ড এর মতবিরোধ হওয়াটা আমাদের কাছে এক সুগভীর ব্যঞ্জনা বয়ে নিয়ে আসে। আমাদের কাছে তা কাম্য ছিল না, কারণ যদি আমাদের কোন সীমাবদ্ধতা থাকে তবে উপযুক্ত প্রমাণ ও যথাযথ কারণ পর্যালোচনাসাপেক্ষে আমরা আমাদের অজ্ঞতাকে পূর্ণ করতে পারব। কিন্তু তা না করে যদি পরস্পরকে দোষারোপ বা বাতিল করা হয় তাহলে কেমন হবে? (রিচার্ড ডকিন্স এবং ড্যানিয়েল ডেনেট এর প্রতি আমার একটা নিজস্ব বিরক্তিআছে। তারা নাস্তিক বা অবিশ্বাসী শব্দটির পরিবর্তে বুদ্ধিদীপ্ত (Bright) শব্দটি ব্যবহারের প্রস্তাব করেছেন। আমার মতে এর ফলে তারা নিজেদেরকে কিছুটা হলেও ছোট করেছেন।  আমরা কেউ বিশ্বয় এর প্রতি প্রলুব্ধতা, রহস্যময়তা এবং শক্তিমানের প্রতি ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা থেকে মুক্ত নই। আমাদের সঙ্গীত, শিল্পকলা, সাহিত্য আছে। আমরা এখন জানি যে, বিশেষ রকমের নীতিনৈতিকতার জন্য পৌরাণিক বইয়ের নীতিকাহিনীর চাইতে সেক্সপীয়র, টলস্টয়, শিলার, দস্তয়েভস্কি এবং জর্জ এলিয়ট এর দ্বারস্থ হওয়াটা অধিকতর ভাল। 

সাহিত্য ধর্মগ্রন্থ নয়। বরং তা মনকে পুষ্টি জোগায়। এর আর কোন উপমা নেই, এমনকি আত্মাও যা সঠিকভাবে পরিষ্ফুট করতে পারে না। আমরা বেহেশত বা দোজখে বিশ্বাস করি না। এইসব মন ভোলানো বা হুমকির বিষয় এবং বেহেশতের লোভে ঘটানো অপরাধ অথবা বিশ্বাসের চাইতে বেশি হিংসাত্মক আর কোন কিছু সম্পর্কে কোন তথ্য এখনও পাওয়া যায় নি। (আসলে যদি কখনও সঠিক পরিসংখ্যান হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আরও তথ্য প্রমান পাওয়া যাবে।) আমরা শৈশবের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা ছাড়া একবার মাত্র বাঁচার ব্যাপারটি মেনে নিয়েছি। তার জন্যে আমরা সম্পূর্ণভাবে সুখী যে আমরা অবশ্যই আমাদের নিজেদের পরিবেশ, পথ তৈরি করে নেব। 

আমরা এটা অনুমান করতে পারি যে শেষ পর্যন্ত যা সম্ভব হবে তা হল মানুষ তাদের সংক্ষিপ্ত ও সংগ্রামী জীবনের মর্ম যখন বুঝতে পারবে তখন তারা পরস্পরের সাথে আরও ভাল ব্যবহার করবে। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, ধর্ম ছাড়াও নৈতিকভাবে শুদ্ধ জীবন যাপন সম্ভব। 

চলবে....