ধর্ম সবকিছুকে বিষাক্ত করে তুলছে
ক্রিস্টোফার হিচেনস
অনুবাদক: অগ্নি অধিরূঢ়
ধর্ম অসংখ্য মানুষকে অপেক্ষাকৃত ভাল আচরণ করতে তো শেখায় না বরং বেশ্যার দালালের মতো নোংরা মনের ও গণহত্যাকারীর মতো হিংস্র হতে উৎসাহ দেয়। কিন্তু আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হর নিজের মনে জোর বাড়ানোর জন্য আমাদের কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রতিদিন অথবা প্রত্যেক সপ্তাহে অথবা কোন বিশেষ দিনে একত্রিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। অযোগ্য, সম্মানহীন কাউকে বড় করতে গিয়ে এবং আমাদের সাধুতা প্রচার করে নিজেকে ছোট করার জন্য আমাদের দলভুক্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা নাস্তিকরা কোন মোল্লাগিরি সমর্থন করি না কিংবা নিজের মতবাদ পালনের জন্য পুলিশিগিরিও করি না। কোন চিত্র বা বস্তুকে (এমনকি তা যদি কোন বই হয় তাকেও) শ্রদ্ধা করার উপযুক্ত বলে মনে করি না। বরং তথাকথিত ত্যাগের মহিমা বা ভদ্রতাকে আমরা পরিত্যজ্য বলে বিবেচনা করি। আমাদের কাছে পৃথিবীর কোন জায়গা পবিত্রতর হতে পারে নঅ। আমরা মনে করি তীর্থযাত্রা আসলে হাস্যকর লোকদেখানো কার্যক্রম ছাড়া কিছুই নয়। কোন পবিত্র দেয়াল, গুহা, পাথর বা দালানের নামে গণহত্যাকে আমরা কোনক্রমে মেনে নিতে পারি না। আমরা ধীরগতিতে বা তাড়াহুড়া করে পাঠাগার বা আর্টগ্যালারির এক পাশ থেকে অন্য পাশে গমনাগমনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি। অথবা কোন বন্ধুর সাথে সৌন্দর্য বা সত্যতার স্বরূপ নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা করতে করতে লাঞ্চ সারতে পারি। এইসব বইয়ের জগত বা সাংস্কৃতিক আলোচনাপূর্ণ লাঞ্চ বা গ্যালারি পরিদর্শনের অর্থ খুব স্পষ্ট। যদি আমাদের মধ্যে কিঞ্চিত ধর্মবিশ্বাস তৈরি হয়েও থাকে তবে তা এসেছে এই সাংস্কৃতিক জগত থেকে, কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহা থেকে নয়। আমাদের প্রিয় চিত্রকর, সুরকার প্রমুখের সৃষ্টি আমাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অগাস্টিন, একুইনাস, মাইমনিডস এবং নিউম্যান আমাদের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রভাবশালী বিদগ্ধজনেরা অনেক বিপদজনক বিষয় নিয়ে লিখেছেন। কখনও কখনও তা অবশ্য বোকামীর পর্যায়েও চলে গেছে। অসুখের কার্যকারণ, এই সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে তারা হাস্যকর নানা মন্তব্যও করেছেন। বর্তমান কাল পর্যন্ত তাদের মতবাদের টিকে না থাকা বা আগামীতেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি না হবার পিছনে এগুলোই সাধারন কারণ। ধর্ম হল এরকমই একটি অস্পষ্ট প্রশংসার জিনিস।
ধর্ম সমকালে নয় বহুকাল আগেই তার কিছু মহানুভবতা প্রদর্শন করেছিল। একালে নয়, তার সবচেয়ে মূল্যবান বাণী বা উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিয়েছে সেই অতীতকালে। এটা তো বটেই, এছাড়া কোন ভালোকাজে ধর্মের বাকরুদ্ধ করা হয়েছিল সেও অনেকদিন আগের কথা। এমন ঘটেছিল সাহসী ভিন্নমতাবলম্বী লুথারিয়ান গির্জার যাজক দিয়েত্রিচ বনহেফের (Dietrich Bonhoeffer) এর জীবনে। নাৎসীদের অপকর্মে সাহায্য না করার কারণে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত কোন নবী বা ধর্মনেতার জীবনে এমন ঘটেনি। আমরা এমন কাউকে পাইনি যার বক্তব্যে পুনরুক্তি নেই। তারা সবসময় গতকালের কথার প্রতিধ্বনি তুলেছেন। কারও কারও ধর্ম সম্পর্কিত স্বীকারোক্তি পাসকেলকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে নিজেদের সংকীর্ণ মনোভঙ্গিকে প্রকাশ করে ফেলেছে। যখন আবার ওই প্রচারকার্য ভন্ডামো ও নিরানন্দে পর্যবসিত হয়, তখন তারা সি. এস. লুইস (C. S. Lewis) এর নামোল্লেখ না করে পারে না। দুই পদ্ধতির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য একইরকম। এটা আসলে সবসময় ঘাড়ের উপর চেপে থাকে এমন অনিচ্ছুক মানসিক চাপ থেকে আসে। কত উদ্যম যে এই মানসিক চাপকে লালন করেছে তা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রত্যেক সূর্যোদয়কে নিশ্চিত করতে আজটেকরা প্রত্যেক বিশেষ দিনে একজন মানুষের বুক চিরে ফেলত। একেশ্বরবাদীরা তাদের উপাস্যকে এর চেয়েও বেশি বিরক্ত করেছে। 'স্বর্গীয় পরিকল্পনার এক অংশ ব্যক্তি' -এমন মিথ্যাচার করার জন্য কত ভণ্ডামীই না করা হয়েছে। কিন্তু কোনটাই কাজে লাগে নি।
কারও পাপ সম্পর্কে সচেতন করার জন্য কি পরিমাণ আত্মবোধ বিসর্জন দেয়া হয়েছে? কিছুই না। কতবার তারা লজ্জা পেয়েছে? কখনও নয়। বিজ্ঞানের নতুন উদ্ভাবনের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য কতভাবে ধর্মকে মোচড়ানো হয়েছে? অকাজের অনুমান কতগুলো তৈরি করা হয়েছে? বিজ্ঞানের নতুন চিন্তার সাথে মানুষের নিজ হাতে তৈরি ফেরেশতার পবিত্র বাণীর মিলে যাবার জন্য ধর্মীয় সূত্রসমূহকে কত নতুনভাবে সাজানো হয়েছে? কত সাধু, কত অলৌকিক ঘটনা, কত ধর্মসভাই না ওইসব মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে আবার সময়ান্তরে সেগুলোকে বাতিল করতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ঈশ্বর তার নিজের আদলে মানুষকে তৈরি করেনি। সহজ করে বললে বলা যায় যে, ঈশ্বর বা ধর্মের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাবার এটাই সহজ ব্যাখ্যা। বিশ্বাসগুলোর নিজেদের প্রতি ও নিজেদের মধ্যে যে পরস্পরবিরোধীতা তা সহোদর হত্যার মত একই দোষে দুষ্ট। আর এর ফলে সভ্যতার অগ্রগতিকে শুধু প্রতিহত করাই হয়েছে।
(অসমাপ্ত)