ইসলামের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য

ইবনে ওয়ারাক

অনুবাদক: অগ্নি অধিরূঢ়

ইসলামী আইনের প্রকৃতি 

(১) সকল মানুষের আচরণ এবং সম্পর্কগুলোকে এই ধারণাগত দৃষ্টিকোন থেকে নির্দিষ্ট মাত্রায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে যে, এগুলো সুপারিশকৃত, বৈচিত্র্যহীন, নিন্দাপূর্ণ এবং নিষিদ্ধ। 

(২) ইসলামী আইনের অমানবিক দিকগুলো এসেছে এর প্রধান দুটো অফিসিয়াল ভিত্তি থেকে। এই দুটো হল কোরান ও সুন্না। এই দুটোই হল আল্লাহর আদেশ। পবিত্র বিশ্বাস দ্বারা বৈধতা পেয়েছে- এই ধারণা থেকে ইসলামী আইনে মানবতাহীন বিষয়গুলো এসেছে। ইসলামী আইনের মানবতাবিরোধী বিষয়গুলো শুধুমাত্র পবিত্রতার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে, কোন মানবতাবোধের উপর নয়। ইসলামী আইনের অযৌক্তিক দিকগুলো স্বাধীন উসাহের চাইতে বাণীর প্রতি আস্থাকে বেশি সমর্থন করে। 

এই ঘটনা ঐতিহাসিকভাবেই আইনের উপাদান যেমন আইনী কল্পনার উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে চর্চা করেছে। উদাহরণস্বরূপ: কোরান স্পষ্টভাবে সুদকে হারাম বলে ঘোষনা করেছে। বাকীটুকু Schacht থেকে উল্লেখ করি:-

এই ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এত শক্তিশালী যে প্রকাশ্য বা সরাসরি একে ভাঙা যাবে না এমন একটি ধারণা মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। কিন্তু একই সময়ে বাণিজ্যিক বিষয়ে দেয়া ও নেয়ার মাঝে সুদের প্রতি একটা গোপন চাহিদা সবসময় থেকে গেছে। এই প্রয়োজনকে (সুদ নেয়া ও দেয়া) মেটাবার জন্য ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার জন্য নানারকম পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে। এরকম একটি আইন হল ঋণের জামানত হিসেবে সত্যিকারের সম্পত্তি দেয়া এবং ঋণদাতাকে এটা ব্যাবহার করতে দেয়া। সম্পত্তির এই ব্যবহার ঋণদাতাকে লাভ (সুদ) এনে দিচ্ছে। আরেকটি আইন তৈরি হয়েছে দ্বৈতবিক্রি নিয়ে। যেমন সম্ভাব্য ঋণ গ্রহিতা নগদ অর্থের বিনিময়ে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে দাস বিক্রি করে, তাক্ষণিকভাবে ভবিষ্যতে অনেক বেশি টাকা দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই দাসকে ফিরিয়ে নেয়। এখানে এই ঋণের সাথে দাসকে নেয়া হল জামানত (Security)। দুইরকম মূল্যের পার্থক্যটাই হল সুদ বা লাভ।

এই ধরণের কাজকে আমরা কি বলতে পারি? অলীক আইন শব্দবন্ধটি খুব বেশি শৈল্পিক হয়ে যায়। নৈতিক আত্মগোপন/ পলায়ন, নৈতিক ভণ্ডামী, নৈতিক অসততা নাকি অন্য কিছু? 

(৩) যদিও ইসলামী আইন একটি পবিত্র আইন, তবুও একে যৌক্তিক বা মানবিক হতে হবে এমন কোন কথা নেই। শুধুমাত্র নিরন্তর প্রত্যাদেশ পাবার মত এক অযৌক্তিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যে এটা তৈরি হয়েছে তা নয়। বরং এক যৌক্তিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় এটা (কোরান) বহু বাহ্যিক বা আপাতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যানধারণাকেও গ্রহণ করেছে। কিন্তু যদিও ইসলামী আইন নিজেকে উপাদানগত বিবেচনায় যৌক্তিক পদ্ধতি হিসেবে উপস্থাপন করেছে, তারপরও দেখা যায় যে, এর আনুষ্ঠানিক আইনী চরিত্র তেমন একটা বিকশিত হয় নি। এর উদ্দেশ্য হল একটা কঠিন ও প্রাসঙ্গিক মানদণ্ড নির্ধারণ করা, পরস্পরবিরোধী লাভের লড়াইয়ে আনুষ্ঠানিক আইন আরোপ করা নয় (এটাই ধর্মনিরপেক্ষ আইনের উদ্দেশ্য)। যা গভীর বিশ্বাস, সুবিচার, ন্যায্যতা, সত্য এবং ইসলামের অধীন এরকম কোন কিছু হিসেবে বিবেচনাযোগ্য- সেরকম একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের দিকেই ইসলামী আইন পরিচালিত হয়। 

(৪) ইসলামী আইন রোমান আইনের মত নয়। বরং পরস্পরের অনুরূপ কিন্তু সংযোগহীন কিছু নিয়মকানুনের সমষ্টিকে ইসলামী আইন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী আইনের প্রধানতম ঐতিহ্য হল বিভিন্নরকম কূটকৌশলকে পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা। "ইসলামী আইন প্রত্যেক ঘটনাকে বিভিন্ন সাদৃশ্যমূলক আইনগত উপাদান হতে পৃথক করার জন্য খুব একটা মনোযোগ দেয় না। ঘটনার বিভিন্ন ধারাবাহিক উপাদান হিসেবেও একটি সাধারণ আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে না।" যেমন, এক ব্যক্তি যিনি তার ৩২ পূর্বপুরুষের একমাত্র বংশধর হিসেবে বেঁচে আছেন, তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নে লিঙ্গ নিরপেক্ষ হতে গেলে(যখন থেকে দুই ভিন্ন লিঙ্গের সমান অধিকার নেই), কারও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে পশুত্ব হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে, আর আলাদাভাবে বললে কোন এক স্বতন্ত্র সত্ত্বা যে আধাআধি পরিবর্তিত হয়েছে তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নে। তা সোজাসুজি বা বাঁকা যে ভাবেই হোক না কেন ইসলামী আইনের দৃষ্টিভঙ্গি একইরকম থেকে যায়। 

এভাবে এক আত্মা-বিধ্বংসী পণ্ডিতি, এক কেতাবী কূটতর্ক সবকিছু দখল করে নেয়। Goldziher যেমন বলেছেন_

"আল্লাহর বাণীর ব্যাখ্যা করা এবং আল্লার বাণীর মতো করে হুবহু জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি অযৌক্তিক ও হাস্যকর কূটতর্কের মধ্যে এবং তুচ্ছ ক্লিশে ব্যাখ্যার মধ্যে হারিয়ে যায়। আনুষঙ্গিক কিছু চিন্তা করলে দেখা যাবে হেঁয়ালী বা ধাঁধাঁ নিয়ে বিতর্ক করা অযথা কূটতর্ক এবং পরস্পরের চুল টানাটানি আসলে কল্পনা নিয়ে অর্থহীন ও অপরিণামদর্শী লড়াই ছাড়া আর কিছুই নয়। 

মানুষ অপ্রয়োজনীয় আইনী সমস্যা নিয়ে বিবাদ করে। কেতাবী বিদ্যা দিয়ে বাস্তব পৃথিবীর প্রতিরূপ এক স্বাধীন জগতকে তৈরি করে। এই ধরণের আচরণগত উপাদান দিয়ে বিচারকার্যকে তারা সাজিয়ে তোলে। জ্বিনের মানবরূপ ধারণ করার বিষয়টিকেও আইনবিদরা তাদের ধর্মীয় আইনের অন্তর্গত করে নিয়ে চরম তর্ক বিতর্ককে উস্কে দিয়েছেন। যেমন: ওই ধরণের সত্ত্বারা (জ্বিন) শুক্রবারের কার্যাবলীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এমন ধারণাকে স্বীকার করা হয়েছে। 

আরেকটি সমস্যাক্রান্ত বিষয় এই বেহেশতী আইনে রয়েছে। এটাকেও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। অলৌকিক সত্ত্বারা যখন মানুষের রূপ গ্রহণ করে তখন যদি তার সাথে কোন মানুষের বিবাহ হয়, তাহলে তার সন্তান কি ধরণের অধিকার পাবে? পারিবারিক আইন এই ধরণের বিবাহ বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত দেবে? ধর্মীয় আইনে এই ধরণের সমস্যাকে (জ্বিন-পরীর সাথে বিবাহ) অন্য অনেক সমস্যার মতো একইরকম গুরুত্ব সহকার আলোচনা করা হয়েছে।" 

(৫) ইসলামী আইন অনুযায়ী আল্লাহ ও মানুষের অধিকারের মধ্যে তুলনা করে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, ফৌজদারী আইন আমরা কাকে বলব? 

শুধুমাত্র আল্লাহ'র অধিকার প্রসঙ্গে ফৌজদারী আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে কোনরকম অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারী বিচারের বিধানকে স্পষ্টভাবে রাখা হয়েছে। আল্লাহ'র কর্তৃত্বের কোন অংশকে নিজের বলে দাবী করার ধারণাকে মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে মনে করা হয়। এই সত্যিকারের ফৌজদারী আইনগুলো কোরান এবং প্রথা (হাদীস) থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। 

দ্বিতীয় প্রধান পার্থক্য হল "অপরাধের ক্ষতিপূরণ" বিষয় এই আইনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার ও ইসলামী আইন দু'পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে প্রাচীন আরবের অপ্রচলিত কিন্তু বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু নিয়মনীতিকে আইন হিসেবে কোনরকম পরিমার্জন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন: দায়বদ্ধতা যেখানেই আরোপ করা হোক না কেন, রক্তের বদলে রক্ত, অথবা কোন না কোন ক্ষতির বিনিময়ে হলেও সমুচিত প্রতিশোধ নিতে হবে। এটা নির্ভর করবে মানুষের নিজ অধিকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিগত অভিযোগের উপরে এই ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য ভয়ানকটির বাস্তব অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। যদি থাকে, তাহলে যা আছে তা রয়েছে ধর্মীয় দায়িত্ব বিষয়ে বিবেচনার মধ্যে। 

অতএব, ইসলামী আইনে মানব অধিকার লঙ্ঘনের জন্য কোন নির্দিষ্ট দণ্ড নেই। কিন্তু শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গ বা সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমান ক্ষতিপূরণ প্রদানকে মানব অধিকার বলে মনে করা হয়েছে। এই ধরণের চিন্তা হত্যার বদলে হত্যা বা আঘাতের বদলে আঘাতের ধারণাকে উস্কে দেয়। অর্থদণ্ডকে বাদ দিয়েই এই ধরণের বিধানকে প্রয়োগ করা হয়। 

পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি যে, শরীয়া হল এমন কিছু তাত্ত্বিক আইনের সমষ্টি, যা আল্লাহ'র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করেছে এমন মুসলিম সমাজের উপরে প্রয়োগ করা হয়। এটা পবিত্র কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে রচিত এবং একে সম্পূর্ণভাবে কোনরকম সমালোচনা ছাড়াই গ্রহণ করতে হবে। এই মত অনুযায়ী ইসলামী আইন কোন মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণ নয়। এই আইন সামাজিক বিবর্তনের প্রভাব (ইউরোপীয় আইনের মতো) অথবা অনবরত পরিবর্তনকে কোনভাবেই মেনে নেয় না। এটা অপরিবর্তনীয় এবং ফিকাহশাস্ত্র এই পবিত্র বাণীসমূহর ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে দিয়ে দিয়ে এর অভ্রান্ততাকে রক্ষা করেছে। 

এটা অভ্রান্ত, কারণ একদল আইন বিশেষজ্ঞ কোরান এবং প্রথা (হাদীস) থেকে যে কোন কর্তৃপক্ষীয় সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এটা স্পষ্ট, কারণ পরবর্তী তিন শতাব্দীর মধ্যে সব ধরণের সমস্যার সমাধান দেয়া হয়ে যায়। অথচ ইউরোপে আইন হল মানুষের তৈরি এবং ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু শরীয়া হল বেহেশতীয় এবং অপরিবর্তনীয়। এটা আল্লাহর এমন এক দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছার অধীন, যা মানবীয় বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এটাকে অবশ্যই কোনরকম সন্দেহ বা প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করতে হবে। শরীয়ার পণ্ডিতদের কাজ হল শুধুমাত্র কোরান ও তার নবীর কথাগুলোর কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগবিধিকে সংকলিত করা। অবশ্য এ বিষয়ে তাদের কোন কিছু করার ক্ষেত্রও ছিল সীমিত। এটা আল্লাহই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত আইনকে শক্তি দিয়েছে। বাকীটুকু নির্ভর করে মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজস্ব অভ্রান্তি বোধের উপর। আর এই অভ্রান্তবাদ আল্লাহ নিজে মোহাম্মদের মাধ্যমে তার নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করেছেন। 

অসমাপ্ত

 ****

অগ্নি অধিরূঢ়, বাংলাদেশে বসবাসরত মুক্তমনার নিয়মিত লেখক। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।  ইমেইল - [email protected] িজস্ব ব্লগে লিখে থাকেন