সাক্ষাতকার....
ইতিহাসের শিক্ষাই আমাকে শক্তি দিয়েছে মাথা উঁচু করে অত্যাচার সহ্য করার....

অজিজুল হক

আজিজুল হক নকশাল বিদ্রোহের শেষসূর্য নামেই পরিচিত। ভারতের নকশাল আন্দোলনের প্রধান সংগঠক চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান। তাঁর গ্রন্থ ‘কারাগারে ১৮ বছর’ নকশাল বিদ্রোহ তথা ৭০ দশকের প্রামাণ্য দলিল। এছাড়া ‘মনু মহম্মদ হিটলার’ও আলোচিত বিতর্কিত গ্রন্থ। তিনি এখন সরাসরি রাজনীতিতে নেই, কোলকাতায় গঠন করেছেন ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি। লিখছেন সংবাদ প্রতিদিন ও আজকাল কাগজে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ‘লালটুকটুকে দিন’, ‘হায়না মানুষ’, ‘ছুটন্ত সময় ফুটন্ত মানুষ’, ‘হাতির খোঁজে রাজা’। তাঁর সঙ্গে কথা হয় অঞ্জন রায়ের। সেই কথোপকথন নিয়েই এ সাক্ষাতকার।

অঞ্জন রায় : পশ্চিম বাংলায় এখন বাংলা ভাষার বড় দুর্দিন। কোলকাতায় এখন বাংলাই সবচেয়ে অবহেলিত ভাষা। হিন্দির প্রকোপে আপনারা ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন, কেন এমন ঘটছে?

আজিজুল হক : হ্যাঁ, আমি তোমার প্রশ্নের সঙ্গে একমত। সত্যিই আজ আমার বাংলা ভাষা এ শহরে তথা পশ্চিম বঙ্গে প্রচন্ডরকম আক্রান্ত। তবে এই সমস্যা শুধুমাত্রই পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতারই সমস্যা নয়। বিশ্বায়নের নামে আগ্রাসনের প্রথম ধাপ জাতি সত্তাকে ধ্বংস করে দিয়ে এক জাতি রাষ্ট্রগঠন করা। বাজারকে সংহত করা। এ এক বিশ্বব্যাপী মাৎস্যন্যায়্ অপরকে গিলে খেয়ে নিজেকে ফুলিয়ে তোলার এক অশ্লীল চেষ্টা। সংকট থেকে বাঁচতে আধুনিক পুঁজিবাদের এটিই এখন প্রধান অস্ত্র। সাম্রাজ্যবাদ শুধু জাতিকে বিভক্তই করেনা। নিজেদের বাজারের প্রশ্নে একও করে। এখন ওরা ভারতের ঐক্য চায়। একটি হিন্দিভাষী জনসমষ্টির বিশাল বাজার গড়তেই তাদের এই প্রয়াস। সেই কারণেই হিন্দি রাষ্ট্রগড়ে তোলার ইচ্ছে থেকেই আজ নানা কৌশলে আক্রমণ চালানো হচ্ছে বাংলাভাষার ওপরে। এই আক্রমণে তোমাদের বাংলাদেশেও চালানো হচ্ছে।

অঞ্জন রায় : বাংলাদেশে কিভাবে?

আজিজুল হক: বাংলাদেশেও নানা কৌশলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। আমাদের একটা বিষয় বুঝতে হবে তা হলো প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রথম ধাপ হলো এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। দেখো আজ তোমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিও প্রচন্ডভাবে হিন্দির আগ্রাসনে আক্রান্ত। দুভাবে এই আগ্রাসন ঘটছে প্রথমত অবাধ আকাশ সংস্কৃতির নামে অজস্র স্যাটেলাইট চ্যানেলে রাতদিন চলছে অপসংস্কৃতির প্রসার। অন্যদিকে সরকারি সংস্কৃতি বিনিময়ের নামে দু একজন ভালো শিল্পী গেলেও বাস্তবে ঘটছে অন্য ব্যাপার হিন্দি দিয়ে বাংলাকেও গিলে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। আজ ঢাকা শহরেও ঋত্বিক রোশান, হলদিরামের ভুজিয়া, বাবা সায়গলদের জয়জয়কার। এশিয়া কাপের মাঠেও দেখেছি হিন্দি হোর্ডিং। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশেও প্রধান বাঁধা হিন্দিরই। বোম্বের তৃতীয় শ্রেণীর ছবিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়েও নিষ্ফল অনুকরণ করতে গিয়ে ঢাকাই ছবি মেধাহীন হয়ে পড়ছে। অথচ জহির রায়হান, আলমগীর কবিরের মতোন ছবি বানানোর মানুষ জন্মেছেন এই বাংলাদেশেই। আমি আতঙ্কিত। ভয় হয় আমাদের গর্ব ও আবেগের দেশ, বাংলাভাষার দেশ, বাঙালির দেশটিও এভাবে ধ্বংসের দিকে যেতে পারে!

অঞ্জন রায় : এর প্রতিকার কিভাবে সম্ভব?

আজিজুল হক : মানুষের মাঝ থেকেই প্রতিরোধের সূচনা হচ্ছে। এক দিকে সংস্কৃতি বিনিময়ের নামে যেমন হিন্দি সংস্কৃতি পাচার হচ্ছে। এই আগ্রাসনের বিপরীতে প্রকৃত সংস্কৃতিরও বিনিময় ঘটছে। যেমন উদীচীর শিল্পীদের আমরা নিয়ন্ত্রণ দিয়ে আনছি, তেমনই ভাষা শহীদ স্মারক সমিতির অনেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে বাংলাদেশে যাচ্ছেন। আমাদের সুমন যাচ্ছে। ওর গানে শোনাচ্ছে প্রতিরোধের কথা মানবিকতা ও দিনবদলের কথা।

অঞ্জন রায় : এতেই কি প্রতিরোধ গড়ে উঠবে?

আজিজুল হক : অবশ্যই। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ থেমে নেই। ওদের বিশ্বায়নের যন্ত্রণায়, এবং অত্যাচারে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা জেগে উঠবেই। এই আন্তর্জাতিকতার স্বপ্নই দেখেছিলেন কার্ল মার্কস। আমি বিশ্বাস করি, পুঁজির আন্তর্জাতিকতা বনাম পুঁজির জোয়ালে স্পৃষ্ট মানুষের প্রতিরোধ-এই দুইয়ের সংঘাত অনিবার্য। আগামী কয়েক বছর্ইে এই দুই দেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে। মুখোমুখি লড়াইয়ে ঘুরিয়ে দেবে ইতিহাসের চাকা।

অঞ্জন রায় : প্রসঙ্গ বদল করি। কারাগারে ১৮ বছর বইটি লেখার পটভূমি সম্পর্কে বলুন।

আজিজুল হক : জেলখানায় বসেই মূলত লিখেছি। লেখাটি যখন পুলিশের মহাফেজখানায় যাবার অপেক্ষায় আমার বিছানার নিচে পড়েছিলো। তখুনি আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোকদাশগুপ্তের অসাধারণ মেধা আর একঝাঁক করিৎকর্মা সাংবাদিকের সহায়তায় তা জেলখানার ২৪ ফুট দেয়াল টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে। খবরের কাগজে ছাপা হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৭০ দশকের জেলখানার চিত্র জেলবন্দী ছাড়া অন্য মানুষদের বোঝানো প্রায় অসম্ভব। একদিকে অকথ্য দৈহিক নির্যাতন অন্যদিকে তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানসিক নির্যাতন। একইি দিনে সকালে লাঠির বাড়িতে ঘুম ভেঙ্গেছে দুপুরে পঁচা গলা খাবার, রাতে বিশেষ বিভাগের কর্তাদের মানসিক নির্যাতন। এর সঙ্গেই নিজের কমরেডদের খুন হয়ে যেতে দেখা। সেই দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে আমার জেলখানায় ১৮ বছরের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পৃষ্ঠা। এই বইটিতে আমি চেষ্টা করেছি জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নির্যাতনের এক প্রমাণ তুলে ধরতে। কারাগারে ১৮ বছর নিয়ে আমাকে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা শুনতে হয়েছে। বইয়ের ভূমিকার একটা কথাই ফিরিয়ে বলি, তা হলো এই বইয়ের কাহিনী যে ইতিহাসের তাতে কুশিলব অনেকেই। এই বিশাল সেতু বন্ধনে লেখক হিসেবে আমার ভূমিকা একেবার্ইে পাতি কাঠবিড়ালীর। রামলক্ষণ সীতা আর হনুমানরা ইচ্ছে মতো দাপাদাপি করুন। ইচ্ছে হলে রাক্ষস খোক্কসদের নিমন্ত্রণ করে আনুন। আমি কেবল এক বরফশীতল সময়কেই আমার বইটিতে তুলে ধরতে চেয়েছি।

অঞ্জন রায় : আপনার কারাগারে ১৮ বছর পড়ে বারবার শিউরে উঠতে হয়, এতো নির্যাতন সহ্য করার মানসিক শক্তি কিভাবে সংগ্রহ করতেন?

আজিজুল হক : নৈতিক শক্তি এবং মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে অনেক ধরনের যুদ্ধেই বিজয় অর্জন সম্ভব। যখন প্রচন্ড অত্যাচারে রক্তাক্ত হয়েছি। বাচ্চা ছেলেগুলোকে পুলিশ, কংগ্রেসী, সিপিএম এর গুন্ডাদের হাতে খুন হতে দেখেছি তখন স্মরণ করেছি ইতিহাসের। এগিয়ে আসছে ফ্যাসিস্ত বাহিনী। স্তালিনগ্রাদ ঘিরে ফেলেছে। তখুনি লালপতাকার সৈনিক হেঁকে উঠলো ‘নো পাসারান’ মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চির জন্য আমি লড়বো। মৃত্যু, হত্যা, বিভীষিকা আর ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে আমার হাত হোক মুষ্ঠিবদ্ধ। হ্যাঁ ইতিহাসের শিক্ষাই আমাকে শক্তি দিয়েছে মাথা উঁচু করে অত্যাচার সহ্য করার।

অঞ্জন রায় : আপনার কারাগারে ১৮ বছরতো অনেকটাই স্মৃতি থেকে লেখা। এক্ষেত্রে কোন তথ্যগত ত্র“টি থাকার সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দেয়া যায়?

আজিজুল হক : আমি এই প্রশ্নের উত্তর আমার বইয়ের ভূমিকাতেই দিয়েছি। আমি সচেতন ভাবে কোন ভুল করিনি। তবে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার কারণে অনেকের নাম উহ্য থেকেছে। আমি আবারো বলতে চাই এই বইটিতে অনেক বিষয়ে কিছুটা অস্পষ্টতার অভিযোগ কেউ কেউ তোলেন। তাদের আমি স্পষ্ট জানিয়ে দেই এই অস্পষ্টতার কারণ আমার কোন দূর্বলতা নয়। এ আমার মানসিক অবস্থান। তথ্যগত ভুলের সম্ভাবনা আমি দেখিনা। আর তুমি যদি বলো ভুল হয়েছে কিনা। আমি তার জবাবে বলবো আমি আজিজুল হক ভুল করতেই পারি। একমাত্র ভুল করেনা ভগবান আর শয়তান।

অঞ্জন রায় : লেখক আজিজুল হক আর নকশাল বিদ্রোহের নেতা আজিজুল হক-এ দুইজনের মধ্যে মিল- অমিল কোথায়?

আজিজুল হক : কই আমিতো কোন অমিল দেখছিনা। দ্জুনেই ভাত খায়, লাঠিভর দিয়ে হাঁটে, আড্ডা দেয়। তবে অমিলটা কোথায়?

অঞ্জন রায় : তারুণ্যে উপমহাদেশের বহুল আলোচিত নকশাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই বয়সে দাঁড়িয়েও কি সেই বিশ্বাসে আপনি অনড়? দিন বদলে বিশ্বাস করেন?

আজিজুল হক : অবশ্যই। এটাই বাস্তবতা যে এই সমাজ বদলাবে। আমি বিশ্বাস করি, পুরোনো লোকজন, প্রতিষ্ঠিত নেতারা থাকুক আর নাই থাকুক। রণক্লান্ত ও সংগ্রামক্লান্ত নেতারা যতোই ভাবুক না কেন শান্তির কথা। সেই হিম ঘরের শান্তি থাকবে না। এক্ষেত্রে আমি চেয়ারম্যান মাওয়ের সেই বিখ্যাত কথাটি মনে করিয়ে দেই, ‘গাছ যতোই বিশ্রাম নিতে চাক, ঝড় বইবেই।’ আমি বিপ্লবে বিশ্বাস করি। সেই বিপ্লবের স্বপ্নেই আমার দিনযাপন। দিন বদলের বিশ্বাস হারালে, দিনযাপনইতো অর্থহীন হয়ে পড়ে।
অঞ্জন রায় : কিন্তু এই পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায়। যখন ইউরোপ, সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়ায় লাল যুগের অবসান হয়েছে তখন এই ভাবনার ভিত কি আগের মতো দৃঢ় থাকে?

আজিজুল হক : অবশ্যই থাকে। মানুষের জন্যে মানবিক সমাজ গড়তে সমাজতন্ত্রের বিকল্প নেই। সে কারণেই লড়াই না থামিয়ে তাকে আরো সুসংহত করতে হবে। আমি স্পষ্টভাবেই মনে করি ভারতীয় এ উপমহাদেশে প্রতিদিন আরো জরুরী হয়ে পড়ছে প্রকৃত এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য দরকার কমরেড স্তালিনের মতো বিশাল হৃদয়ের নেতা।

অঞ্জন রায় : আজতো নতুনভাবে স্তালিনের মূল্যায়ন হচ্ছে। তাকে নেতিবাচক ভাবেইতো উপস্থাপন করা হচ্ছে।

আজিজুল হক : এ প্রশ্নে আমি ২য় মহাযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সে সময়ে প্যারি পারলো না ধ্বংষ হয়ে গেলো লুইপাস্তুরের স্মৃতিসৌধ। অথচ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে, বুকে বুক দিয়ে লড়াই করে স্তালিনগ্রাদ রক্ষা করা হলো। হ্যাঁ, সেদিন স্তালিন আহ্বান জানিয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক পিতৃভূমি রক্ষা করার। সেদিন সাধারণ জনগণ দাঁত আর নখ দিয়ে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলো বিজয়। স্তালিন যদি নরখাদক একনায়ক হতো তবে কি এমন হতো। উল্টো অভ্যুত্থানে ফেটে পড়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতো অথবা শত্র“কে দরজা খুলে দিয়ে বলতো সবাই সমান হিটলারও যা স্তালিনও তা। কিন্তু তা হয়নি তাই এসব মূল্যায়ন ক্রুশ্চেভের তথ্যে বলীয়ানদের মূল্যায়ন।

অঞ্জন রায় : কারাগারে ১৮ বছরে আপনি যে জেলখানার কথা লিখেছেন, বামফ্রন্টের শাসনে তা কি বাস্তবে থাকা সম্ভব?

আজিজুল হক : কেন থাকা অসম্ভব, যাদের সঙ্গে অতীতে জেল খেটেছি। তখন তো তাদের হাতে আমি বন্দী হয়ে জেলে। আমার বিশ্বাস বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের পশ্চিমবঙ্গে মার্র্কসবাাদীদের পরিচালিত এই জেলখানাগুলো দেখলে কমরেড লেনিন কখনো জেলখানাকে বিপ্লবীদের বিশ্ববিদ্যালয় বলতেন না। ৭০ থেকে ৭৭ পর্যন্ত বামফ্রন্টের জেলে থেকেছি অমানবিক নির্যাতনের মধ্যে। একটানা ডান্ডাবেড়ি পরে থাকতে হয়েছে। ২৪ ঘন্টা লকআপে থাকতে হয়েছে। মে দিবস, চীন বিপ্লব দিবস, অক্টোবর বিপ্লব দিবসে জেলের হাসপাতাল ভর্তি হয়ে গেছে নকশাল বন্দীদের ভীড়ে। আমি বলবো সিদ্ধাথের্র ছেঁড়া জুতো পায়ে দিয়েই এরা জেলগুলো চালিয়েছে। আমার মনে হয়, বামফ্রন্ট আমলে জেলখানার নানা নির্যাতন নিয়ে হৈ চৈ করার দলের সংখ্যা নেই বলেই এই সময়ে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে লাগামছাড়া। যেমন বহরমপুরের নকশাল বন্দী মালা দাশকে অন্তস্বত্বা অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছিলো। শিশুটি জন্মানোর পরে ডাক্তারের পরামর্শ না শুনে মা থেকে আলাদা করে অন্য কয়েদিদের হাতে ছেড়ে দেয়া হলো। শিশুটি মারা গেলো। ডাক্তার যখন বার বার বাচ্চার মায়ের খোঁজ করেছে তখন জেলকর্তৃপক্ষ বলেছে, হোম ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নাই তাই বাচ্চার মাকে আনা যাবে না। শিশুটি মারা গেলো বামপন্থিদের জেলখানাতেই, ভাবতো দেখি এরই নাম কি মানবতা।

অঞ্জন রায় : বর্তমানে সমাজ বাস্তবতায় একজন লেখকের প্রধান ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ?

আজিজুল হক : ফিরে যাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। লেখককে মানিক উল্লেখ করেছেন সামাজিক মজুর হিসেবে। আমিও মনে করি যে সমাজে লেখক বসবাস করেন, সেই সমাজের অসংগতি এবং মতগুলোকে চিহ্নিত করা একজন লেখকের প্রধানতম দায়িত্ব।

অঞ্জন রায় : প্রতিকারেও কি লেখকের অংশগ্রহণ থাকবে?

আজিজুল হক : অবশ্যই সমাজের অপর মানুষদের মতোই লেখকেরও সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে সমাজের প্রতিটি উত্থানপতনে। সামাজিক আন্দোলন সংগ্রাম, বিক্ষোভেও লেখক থাকবেন অগ্রবর্তী দলে।

অঞ্জন রায় : ভারতে বর্তমান সাম্প্রদায়িক উত্থানের প্রধান কারণ কি?

আজিজুল হক : আমি মনে করি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মোড়ক মাত্র। সব ধর্মকে স্বীকৃতি দিয়ে সমান মর্যাদা দেখালেই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া যায় না। সব ধর্মই-যদি সমান হয় তাহলে কারো হিন্দু আবার কারো মুসলমান হওয়ার দরকারই পরে না। শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্ব নিয়ে কখনোই অপরের ধর্মকে সম্মান জানানো যায় না। আজ ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা নামে এক অদ্ভূত চর্চা শুরু হয়েছে দূর্গাপূজায় আরতি আর ঈদেও দিনে টুপি দিলেই একজন মানুষকে কোন মতেই ধর্মনিরপেক্ষ বলা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা আরো অনেক গভীর ব্যাপ্তির বিষয়। অন্যদিকে এদেশে প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল দু’পক্ষই ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এই ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই আরো শক্ত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চক্রের শেকড়। আমি স্পষ্টভাবেই বুঝি ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যে কোন ধর্মকেই অস্বীকার করা। আমার বই কারাগারে ১৮ বছরেও আমি এই কথা উল্লেখ করেছি।

অঞ্জন রায় : নতুন কোন লেখায় হাত দিয়েছেন কি?

আজিজুল হক : এখনো ভাবনার মধ্যেই আছে নতুন লেখা। অন্যদিকে আঙ্গুলে কলম ধরে লেখা আমার জন্যে প্রচন্ড কষ্টের বিষয়। জেলখানার দৈহিক নির্যাতনের কারণে আমার ইনডেক্স ফিঙ্গার দীর্ঘদিন অসাড় ছিলো। এখন তবু কিছুটা লেখার উপযুক্ত হয়েছে। তবে লিখতে আমি ভালোবাসি, এখনো প্রতিদিন কাগজ কলম নিয়ে বসতে চেষ্টা করি। যতো দিন বেঁচে থাকবো লেখাটা চালিয়ে যেতে চাই।

অঞ্জন রায় : দৈহিকভাবে আপনিতো বেশ অসুস্থ এ-অবস্থায় এতো কিছু সামলাতে পারছেনা?

আজিজুল হক : শরীরকে প্রশ্রয় দিলেইতো পেয়ে বসে। যতোদিন চলাফেরা করতে পারছি ততোদিন কাজের মধ্যেই থাকতে চাই। শরীরের কি দোষ। বামফ্রন্ট আমার পাকস্থলীর অর্ধেকটা কেটে ফেলেছে। এখন প্রতি ৬ মাস পর-পর শরীরের রক্ত বদল করতে হয়। এছাড়া জেলখানার অজস্র নির্যাতনের ছাপ পড়ে গেছে সারা দেহেই। তাই শরীর মাঝে মাঝে বিগড়ে যায়। তবুও চেষ্টা করি কাজ করার মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার।

অঞ্জন রায় : বাংলাদেশে আসতে ইচ্ছে হয় না?

আজিজুল হক : ইচ্ছে হয় প্রচন্ডভাবেই। আমার প্রচন্ড ইচ্ছে ঢাকায় একটি ২১ ফেব্র“য়ারী দেখার। এই জন্যে একটা পাসপোর্ট পেতে বার বার চেষ্টা করেছি। অথচ আজো যতোই আমার প্রাণটানুক। আইনী মার-প্যাঁচ আমাকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

অঞ্জন রায় : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আজিজুল হক : তোমাকেও ধন্যবাদ। একই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের জনগণকে।



অঞ্জন রায়: একটি বেসরকারী টেলিভিশনে কর্মরত।
[email protected]