বিটিভির স্বায়ত্বশাসনঃ উপকথার ক্রীতদাস কখনোই প্রভূর গৃহ ভুলতে পারেনা
অঞ্জন রায়প্রথমেই একটা ছোট গল্প। এক অতি প্রভুভক্ত ক্রীতদাসকে বৃদ্ধ বয়সে তার প্রভু মুক্তি দিলেন, বললেন- সারা জীবনের সততার জন্যই তাকে আজ শৃংখল মুক্ত করা হলো। ইচ্ছে করলে সে যেখানে খুশি চলে যেতে পারে। প্রচন্ড আনন্দিত হলেন সেই বৃদ্ধ ক্রীতদাস, প্রভুকে প্রণাম জানিয়ে বেড়িয়ে এলেন সমস্ত জীবন কাটিয়ে যাওয়া সেই প্রুভুরই দেয়া দাস আশ্রয় থেকে। পথে নামলেন। কি আশ্চর্য় আদতে গোটা জীবন প্রভুর বাড়িতে থেকে এবং নির্দেশ শুনতে শুনতে বৃদ্ধ মানুষটি নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে এমন কি নিজের বুদ্ধিতে পথ চলতেও ভুলে গেছেন। দিন গড়িয়ে রাত এলো, বৃদ্ধ মানুষটি তখনো কোন পথ খুঁজে পান নি। এক পর্যায়ে প্রচন্ড ক্ষিদে আর ক্লান্তি নিয়ে প্রভুর বাড়ির দুয়ারে গিয়ে কড়া নাড়লেন। পুনরায় আশ্রয় প্রার্থনা করলেন প্রভুর কাছেই। আর সে সময়েই বদলে গেলেন এতো বছরের চেনা প্রভু। তিনি জানিয়ে দিলেন- মুক্তি দেয়া দাসকে তিনি আর ফেরত নেবেন না। তার পরের গল্পটি সংক্ষিপ্ত এবং করুণ। বৃদ্ধ ক্রীতদাস তার প্রভুর বাড়ীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই প্রচন্ড শীত আর ক্ষুধায় এক সময়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
পাঠক, এটি ধান ভানতে শীবের গীত নয়। এটিই বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য প্রযোজ্য প্রধান উপমা। চোট বেলঅয় যেদিন বাড়িতে টেলিভিশন এলো সেই সাদাকালোর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিটিভি দেখে একজন সাধারন গনমাধ্যম কর্মী হিসেবে আমার নিজেরই মনে হয়েছে বিটিভি মানে শুধূ একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, বিটিভি মানে রাম বসুর লেখা কেরী সাহেবের মুন্সীদের এক অবাধ মেধাহীন বিচরন ক্ষেত্র। যেখানে মেধা নয়, প্রয়োজন মধ্যবিত্তের সেই প্রবল মেরুদন্ডহীন আপোষকামী খুঁটে দানা খাবার চরিত্র। যা থাকলেই শুধুমাত্র বিটিভিতে তড়তড়িয়ে প্রমোশন পাওয়া যায়, স্তাবক হলেই এখানে মেলে দাঁড়ে বসা ময়না পাখিটির প্রাপ্য দানাপানি।
আমি রাষ্ট্রের কাছে একটি সবিনয় প্রশ্ন রাখতে চাই, তত্বাবধায়ক সরকার আজ অনেক শুভ উদ্দ্যোগ হাতে নিযেছেন, সম্প্রতি তারা বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসনের বিষয়টিও খুবই গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন, খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি- নথি তলব করে বিষয়টি এখন গুরুত্বের সাথে সমাধানের চেষ্টা করছেন। সেক্ষেত্রে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন ‘টেলিভিশন কতৃপক্ষ আইন ২০০১’ কে। সরকারের এই উদ্যোগকে শ্রদ্ধা জানিয়েই তত্বাবধায়ক সরকাররের মাননীয় কতৃপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে ৯০ এর গণঅভ্যূত্থানের অন্যতম একটি এজেন্ডা ছিলো রেডিও এবং টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসন। গণঅভ্যূত্থানের সময়েই তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে বসে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের নেতারা এই রুপরেখা লিখেছিলেন। তাতে তিন জোটের শীর্ষ নেতারা স্বাক্ষরও করেছিলেন। তারপরে এলো ভোট, আমরা হাতের বুড়ো আঙ্গুলের কালো কালির দাগ নিয়ে ঘরে ফিরলাম, ভাবলাম এইবার নিশ্চয়ই সব বদলে যাবে। কি হলো তারপরে? টেলিভিশনের পর্দা দখল করে নিলেন ‘শহীদ’ জিয়ার মহান আদর্শ। এরশাদের আমলের মতোই হরতালে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতার প্রামান্য দেখে আবারো ক্লান্ত হলো আমাদের দু চোখ। শেষ হলো বিএনপির শাসন আমল। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার দিনেই- অর্থাত নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনার শেষেই বিটিভির পর্দায় আসলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা আবেগাপ্লুত হলাম, বহু বছর পরে আমরা শুনলাম সেই বজ্রকন্ঠ। কিন্তু তারপরে? গতকালের বাংলাদেশী আজ হয়ে গেলেন বেশ বড় মাপের বাঙ্গালী। পাহাড়ের সম উচ্চতার মানুষটিকে বিটিভি এমনই স্থানে নিয়ে এলো, বঙ্গবন্ধু নামটি উচ্চারিত হলেই মানুষ টেলিভিশনের সুইচ বন্ধ করে দিতেন। সেই সময়েই আওয়ামী লীগের তরফ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিলো ‘টেলিভিশন কতৃপক্ষ আইন ২০০১’। যার অন্যতম রুপকার ছিলেন তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়ীদ। তিনি গাছ বাঁচিয়ে ফল খাওয়ার পন্থাতেই প্রণয়ন করিয়েছিলেন এই আইনটি।
আজ যখন বিটিভির বিষয়টি এতোদিন পরে আবারো সামনে এসেছে তখনই কিছু বিষয় পরিস্কার হওয়া বিশেষ ভাবে প্রয়োজন, প্রথমত স্বায়ত্বশাসন আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেবো নাকি কতিপয় ব্যাক্তিকে? প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদ বাংলাদেশ টেলিভিশন স্বায়ত্বশাসিত হয় তবে তার পরিচালনার দায়িত্বে কারা থাকবেন? আমরা কি তাদেরর ওপরে আস্থা রাখতে পারি? যারা কখনোই নিজেদের মেরুদন্ড থাকার প্রমান দিতে পারেন নি। যারা সর্বাধুনিক যন্ত্রের সুবিধা পাওয়ার পরেও প্রথম শ্রেনীর কোন অনুষ্ঠান নির্মানে এখনো প্রায় সকল বেসরকারী টেলিভিশনের থেকে পিছিয়ে আছেন তাদের কি শৃংখল মুক্তি হলেই এই ঘাটতিগুলো পুরণ হবে?
একজন নগন্য গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে আমি তত্বাবধায়ক সকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে কয়েকটি সুপারিশ জানাতে চাই।
১. বিটিভিকে সম্পর্ন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য পুরোনো কোনো প্রস্তাব অথবা আইনের প্রয়োজন নাই। প্রথমেই একটি জাতীয় কমিটি করতে হবে। সেই কমিটিতে থাকতে হবে পেশাদার মানুষদের অংশগ্রহন।
২. দেশে এখন অনেকগুলো বেসরকারী টেলিভিশন সফলতার সাথেই কাজ করছে, যেখানে পর্যন্ত ক্যাবেল সুবিধা আছে সেই এলাকা পর্যন্ত প্রায় কোন দর্শকই বিটিভি দেখেন না। তারা বিভিন্ন বেসরকারী স্যাটেলাইট টেলিভিশনই দেখেন। সুতরাং বেসরকারী বলে দূরে সরিয়ে না রেখে এই টেলিভিশনে যারা সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের এই প্রক্রিয়াতে অবশ্যই সম্পৃক্ত রাখতে হবে।
৩. আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে যেমন অনেক সৃজনশীল মানুয়ের উত্থান ঘটেছে তেমনই সেখানে এখনো এমন জনসংখ্যারই আধিক্য যাদের থাকা না থাকায় একটি টেলিভিশন স্টেশনের খুব বেশি যায় আসে না। এখনই সেই সব বিশেষ কোঠায় নিয়োগ পাওয়া মানুষদের তালিকা করে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৪. আমরা যে সকল কর্মকর্তাদের কখনোই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভুমিকায় দেখিনি তাদের কাছে স্বায়ত্বশাসন আদৌ কোন মাত্রা আনতে পারবে এই কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে কথিত গল্পটির যেনো পূনরাবৃত্তি না হয়। অর্থাত আপনি তাদেরই স্বাধীনতা দিতে পারেন যাদের স্বাধীনতা বোঝার এবং তা ব্যাবহার করার যোগ্যতা আছে।
৫. আমাদের দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠি এখনো স্যাটেলাইট টেলিভিশন দেখতে পারছেন না। সে কারনেই বিটিভির দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের মনে রাখতে হবে বিটিভিরও দায়িত্ব আছে এই চ্যানেল গুলোর পজিটিভ বিষয়গুলো বৃহত্বর জনগোষ্ঠির কাছে পৌছোনোর।
৬. কোন কিছুই চাপিয়ে দেয়া নয়, বিটিভিকে আধুনিক(ভাবনায় এবং মানে) করার বিষয়েও থাকতে হবে পজেটিভ মানসিকতা।
৭. দলীয় পদন্নোতি প্রাপ্ত আর চাটুকারদের কবল থেকে প্রতিষ্ঠান মুক্ত করতে প্রয়োজনে টাস্ক ফোর্স গঠন করতে হবে।
৮. যারা বিটিভির বিষয়ে ভাবছেন সেই ভাবনাগুলোকে একত্রিত করতে প্রয়োজনে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে।
পাঠক, আমি আমার ভাবনা থেকেই মনে করি কোন রাজনৈকি সরকার কখনোই বাংলাদেশ টেলিভিশনকে সম্পুর্ণ স্বাধীনতা দিতে রাজি হবেন না। কেননা, নিজেদের কর্মকান্ড প্রচারের এমন বিনে পয়সার মাধ্যমটি হাতছাড়া করতে কারই বা ভালো লাগে? আর সে কারনেই বর্তমান সরকারের অবশ্যই সমাপ্য কাজগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিষয়ে সামগ্রিক সমাধানের বিষয়টি থাকা অতি জরুরী। আর তা যদি না হয় তবে ৯০ এর তিন জোটের রুপরেখার মতোই বিটিভি হয়ে থাকবে শুধুমাত্রই নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়। যা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। হবেও না। অন্যদিকে আরো একটি বিষয় মনে রাখা দরকার তা হলো যে বিটিভি নিয়ে আমরা ভাবছি, তাদের অধিকাংশের অবস্থাই কিন্তু আমার লেখার প্রথমে বলা সেই বৃদ্ধ ক্রীতদাসের মতোই। সুতরাং তারাও কি ভাববেন তাদের স্বায়ত্বশাসনের কথা? নাকি চাকরী আর নিশ্চিন্ত জীবনের প্রত্যাশায় মধ্যবিত্তের মতোই কানের ওপরে বালিশ চাপা দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইবেন এই আলোচনা, যা তাদের সুখের ঘরের জন্য মোটেই কাম্য নয়।
অঞ্জন রায়: একটি বেসরকারী টেলিভিশনে কর্মরত।
[email protected]