৪৭ এর পাপ, অর্পিত সম্পত্তির শব এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের শীতঘুম....

অঞ্জন রায়

কয়েক দিন ধরেই আবারো খবরের কাগজের আলোচনায় উঠে এসেছে অর্পিত সম্পত্তির বিষয়টিগত এক বছর ধরে এই বিষয়টি আলোচনা হলেও অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে আমাদের বর্তমান অরাজনৈতিক (!) সরকারও অপরাপর সামরিক ও গনতান্ত্রিক সরকারের মতোই এক অদ্ভুত নীরবতা পালন করেছেনগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই এবারেও সরকারের মেয়াদের একদম শেষে এসে এই বিষযে কিছু একটা করতে চাইছেন  ড.ফখরদ্দীন আহমেদের সরকারযখন অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে কিছু করার সময় ও সুযোগ ছিলো সেই সময়ে শীতঘুমে কাটিয়ে আজ তারা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন ট্রাইবুনাল গঠনের বিষয়ে ব্যাস্ত হয়েছেনযখন নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে তখন তাদের হুশ হয়েছে এই বিষয়ে কিছু একটা করারসিভিল সোসাইটির আধিক্যের এই সরকারের অনেকেই যখন গাড়ীতে পতাকা ওড়াতে আরম্ভ করেননি তখন তারা বেশ মানবিক ছিলেনঅর্পিত সম্পত্তি নিয়েও তারা অনেক কথা বলতেন, কিন্তু সরকারে এসে হয়তো নানা ব্যাস্ততার কারনে ভুলে গিয়েছিলেন এসব  বিষয় শেষকালে মনে হয়েছে কিছু একটা করতে হবেআর সে কারনেই এসব আয়োজনযে আয়োজনে এই কালো আইনে সর্বশান্ত হওয়া মানুষেরা আশাবাদী হবেন এবং শেষ পর্যন্ত ফের আশাভঙ্গের বেদনায় আক্রান্ত হবেন 

শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিদের এই সরকারের আইনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একদা সিভিল সোসাইটিতে বাস করা আমাদের আইন উপেদেষ্টা ২৩ অক্টোবর সমকালকে বলেছেন, ২০০১ সালের আইনটির প্রয়োজনীয় সংশোধন করে হলেও সরকার এই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে সমকালের সংবাদ থেকেই জানতে পারলাম এতোদিন যে আমলারা এই শত্রঅথবা অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলেন তাদেরই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সমস্যা চিহ্নিতকরনেএ যেন সেই উপকথার শেয়ালের মুরগী পালনের গল্পেরই পূন:শ্রবন 

আমাদের দেশে গত দু বছরে যে বাহ্যিক সিভিল সোসাইটির শাসন চলছে তাতে অর্পিত সম্পত্তির বিষয়টি বেশ কয়েক দফাই আলোচনায় এসেছেএই বিষয়ে আমরা শুনেছি অনেক গালভরা বুলিএই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার অফিসের একটি ফাঁকা বাগড়ম্বরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার অর্জনেরও সুযোগ হয়েছেদেখেছি বাহ্যিক জোর আওয়াজ তোলা এই সরকারের নির্দেশ প্রদানের সাথে নির্দেশ বাস্তবায়নের বিস্তর ফারাকএ এমন এক সরকার যেখানে খোদ প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারেন একজন জেলা প্রশাসকআর সেই কথা বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে ছাপার পরেও  টনক নড়ে না প্রধান উপদেষ্টার দফতরেরশুধু তাই নয়, কেন প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে? এই কারনে আবেদনকারীকেই কাটাতে হচ্ছে নিরাপত্তাহীন সময় 

এই রাজধানীতে থেকে অনেক ধরনের নাগরিক সুবিধা পেয়েও যখন আমাকে ভয় তারা করে, তখনই বুঝতে পারি সেই দূর গ্রামের একজন সাধারন সংখ্যালঘুকে কি ধরনের অনিরাপদ জীবনযাপন করতে হচ্ছেএই পাকা দালানে থেকে আমরা কি একবার ভেবে দেখতে পারি সুদূর গ্রামের একজন মানুষ- যার জমিজমাগুলো ৪৭ এর পাপের ফসল হিসেবে বেহাত হয়ে আছে, তাকে কি ভাবে দিন যাপন করতে হচ্ছে? আমাদের দেশে যারা মানবাধিকার, আইনের শাসন, গনতন্ত্রের কথা বলে মাইক গরম করছেন- যারা বিদেশী সাহায্যে সংগঠন গড়ে পন্য করেছেন এদেশের দারিদ্রকে তারাও কি একবার ভেবে দেখেছেন, শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক কারনে এই দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠিকে কেন সব অধিকার থাকার পরেও আধিকারহীন হয়ে থাকতে হচ্ছেআমাদের সর্বোচ্চ ডক্টরেট সমৃদ্ধ সরকারের উপদেষ্টারাও নিশ্চয় এতোটাই ব্যস্ত যে তাদের সময় নেই এইসব মামুলী বিষয়ে ভাবার মতোআজ যখন নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে- তখনই শীতঘুম ভেঙ্গেছে আমাদের মাননীয় আইন উপদেষ্টারতিনি অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তর বিষয়ে ট্রাইবুনাল গঠনের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেনঅথচ গত প্রায় দুবছরে এই বিষয়ে অনেক কথা উঠলেও আমরা সরকারের তেমন কিছু উদ্যোগ দেখিনিদেখিনি রাষ্ট্রের গায়ে লেগে থাকা এই পুরোনো পাপ মোচনে উদ্যোগী হতে 

অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে আমার ব্যাক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়েসেটি হলো, আমার পিতার ভাই পাবনা শহরের মহিম চন্দ্র জুবিলী স্কুলের শিক্ষক জয়ন্ত কুমার রায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে শহরে শহীদ হনপাবনা পৌরসভার নিবন্ধন বইতে ২-১১-১৯৭১ তারিখের নিবন্ধিত করে লেখা আছে, তিনি পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক নিহত হয়েছেনকিন্তু অজ্ঞাত কারনে তিনি বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহীদ হওয়ার পরেও সম্পূর্ন বেআইনী ভাবে তার নাম শহীদ তালিকায় অন্তর্ভূক্তির বদলে তার জমি শত্র“ (অর্পিত) সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছিল।   

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরে আমি সেই সম্পদ ফেরত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেছিলামপ্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ১২.০৫.০৭ তারিখে ২০৮৭ নং ডায়রিতে তদন্ত করতে দেয়া হয় পাবনা জেলা প্রশাসনকেতারা তদন্ত করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ৩ জুন ০৭ জানিয়েছেন শহীদ জয়ন্ত কুমার রায়ের সম্পত্তি অর্পিত নয়তার নামীয় সকল সম্পত্তি অর্পিত তালিকা থেকে অবমুক্তির পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহন করা যেতে পারেজেলা প্রশাসন আরো সুপারিশ করেন জয়ন্ত কুমার রায়ের নামীয় সকল সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি থেকে অবমুক্তি করত- ঞযব ইধহমষধফবংয অনধহফড়হবফ চড়ঢ়বঃু ( ঈড়হঃড়ষ, গধহধমবসবহঃ অহফ উরংঢ়ড়ংধষ) ঙফব ১৯৭২ এর অধীনে তার বৈধ উত্তরাধিকারী না পাওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক মহোদয় উক্ত সম্পত্তির দখল বুঝে নিতে পারে বলে জানিয়েছেনজেলা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে অনুমোদন দিয়ে দ্রুত শহীদ জয়ন্ত কুমার রায়ের উত্তরাধিকারীর কাছে এই সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য গত ১২.০৬.০৭ তারিখে নির্দেশ দেওয়া হয় কিন্তু তারপরেই প্রকাশিত হলো পাবনা জেলা প্রশাসনের আসল চেহারাজেলা প্রশাসনের কাছে এই বিষয়ে মানবাধিকার কর্মিরা জানতে চাইলে তিনি তাদের ভারতে গিয়ে মুসলিমদের সম্পত্তি উদ্ধারের পরামর্শ দিলেনএ কথাও সংবাদপত্রে ছাপা হলো, জনগন পড়লেও পড়লেন না প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তেরাআমিও বুঝে গেলাম- এইসব অনুমতি বা আইনের শাসন আমার জন্য নয়, কেন না আমি বিশ্বাস না করলেও এই রাষ্ট্র আমাকে সংখ্যালঘুর দলেই ঠেলে দিয়েছে 

পাঠক, অর্পিত সম্পত্তি এমনই একটি বিষয়, যেখানে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পরেও আমাদের আদালত বলে তিনি ভারতে পলাইয়া গিয়াছিলেনসুতরাং এই দেশে এমন সবই সম্ভব, রাষ্ট্র যখন নিজেই একটি কালো আইনের পক্ষে দাঁড়ায় তখন এমন ঘটনাগুলো স্বাভাবিকআর সম্ভব বলেই প্রতিনিয়ত কমছে দেশের সংখ্যালঘুর সংখ্যা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র তার সবগুলো নখর দিয়ে আক্রমন করতে থাকলে কিভাবে হরিপদ নাপিত অথবা কমল বহুরুপী তার কয়েক পুরুষের ব্যাবসা চালিয়ে যেতে পারবে? কিভাবে বিমলা হাত বাড়াবে সন্ধ্যা পুজোর ফুলের জন্য? নাএই রাষ্ট্রই চায় না এই দেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকুক রাষ্ট্রই চায়নি সন্ধ্যেবেলা আজান আর শাঁখের সুরের ঐক্যতানচায়নি বলেই এখানে আজো বলবত থাকে অর্পিত সম্পত্তির মতো অশ্লীল আইন 

আমরা যদি একবার আমাদের অতীতের দিকে তাকাই, দেখি তাহলে ৪৭ এর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পরিনতি যে অপরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিলো, তার পরিনতিই আমাদের উপহার দিয়েছিলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের মানসিকতারাম আর রহিমের বিভাজনের বিষ আমাদের মনোজগতে গেঁথে গিয়েছে অজান্তেই প্রত্যেকের গায়ে চেপে বসেছে সাম্প্রদায়িক আলখাল্লা সংখ্যালঘুদের সম্পদ সাইদী সাহেবদের কারনে হয়ে গেছে গনিমতেন মাল অন্যদিকে ভূমি অফিসের বাস্তঘুঘুদের অবাধ লুটপাটে শুধুমাত্র নামের কারনে প্রতি বছরে অগনিত মানুষকে হারাতে হচ্ছে তাদের জমির অধিকার 

পাঠক, আমরা যদি বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তির দখলদারদের দিকে তাকাই- তাহলেই অনেক প্রশ্নের সমাধান মিলে যায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তিকাল থেকে বিগত সময়ের যে বরাদ্দ তার বেশিরভাগই পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের সুবিধাবাদি শ্রেনীউদাহরন হিসাবে আমি আমার নিজ শহর পাবনা জেলাকে উপস্থাপন করতে পারি, এখানে আওয়ামী লীগ এবং বি এন পি এই প্রধান দু দলের অফিসই অর্পিত সম্পত্তিতেতাই যারা সরাসরি সুবিধাভোগী তারাই যখন দেশকে পরিচালনা করেন তখন অর্পিত সম্পত্তির মতো কালো আইন বাতিলের বিষয়টি প্রত্যাশা  করে কি কোন লাভ হবে? এটি যেমন রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনই বর্তমান সুশীল ডক্টরেট সরকারের কাছেও এটি মোটেই গুরুত্বপূর্ন বিষয় নয়, বরং দেশের তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ সহ এমন অনেক বিষয় আছে, যাতে তাদের এখন অগ্রাধিকার দেবার দরকার আছে 

সামনেই নির্বাচন, এবারো নির্বাচনের আগে আমরা শুনবো অনেক গালভরা বুলি নির্বাচনী ইশতেহারে এবারেও থাকবে স্বপ্নের দেশ গড়ে তোলার বিবিধ প্রতিশ্রতিআমরাও ভোট কেন্দ্রে যাবো- হাতের বুড়ো আঙ্গুলে কালো কালির দাগ নিয়ে ঘরে ফিরবোদুপুরে ভরপেট খেয়ে ঘুম থেকে উঠে রাতভর টেলিভিশনে ভোটের ফল দেখবোদেখবো গনতান্ত্রির সরকারের শপথ নেয়াকিন্তু দেশের সংখ্যালঘুদের যন্ত্রনা তার কি কোন সমাধান হবে? হয়তো সংখ্যালঘুদের কিছু নেতার আবারো কপাল খুলবে- কিন্তু দূর গ্রামের হেঁটো ধুতিপড়া মানুষগুলো ক্রমেই পরিনত হতে থাকবে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে নির্বাচনী ভোট ব্যাংক হয়ে থাকা সংখ্যালঘুদের জন্য রাষ্ট্র কখনো মানবিক হবে এমন প্রত্যাশা করাটাও এখন হয়ে উঠেছে অবাস্তব একটি বিষয়কেননা, ৪৭ এর পাপ, অর্পিত সম্পত্তির শব এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের শীতঘুমের বাইরে আর কোন কিছু এখন আর আমাদের প্রাপ্য নয় প্রত্যাশা করাটাও উচিত নয়

অঞ্জন রায়: গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]