মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা : আমি নিজেকে এখন শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ভাবতেই বাধ্য হচ্ছি
অঞ্জন রায়
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে যে ঐতিহ্যর উত্তরাধিকার, সেটিই আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই গর্ব ধারণ করেই পাবনা শহরের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে আমার বাবা ও মা ছিলেন প্রথম সারিতে। অথচ গত ৩৬ বছর আমাদের পরিবারের দেহে লেগে আছে একটি লজ্জাচিহ্ন। সেটি হচ্ছে, আমার বাবার বড় ভাই জয়ন্ত কুমার রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলেও তাঁকে কোন শহীদ তালিকায় তালিকাভূক্ত না করে তার জমি দখলের স্বার্থে তার নাম শত্র“( অর্পিত) তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করানো হয়েছিলো।
এই কাজটি করেছিলো পাবনার জেলা প্রশাসন, আর এতে লাভবান হয়েছিলো এমন কিছু মানুষ যারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে সারা জীবন নিজেদের লাভের বোঝা গুছিয়ে নিয়েছে। আমরা প্রাতবাদ করেছি, দাবি জানিয়েছি, কিন্তু সমাধান পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমাকে আমার শহর ছাড়তে হয়েছে, আর আমার জেঠুর দখল করা জমিতে তৈরি হয়েছে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের অফিস। এরপরে যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলো, তখন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরে এক বুক আশা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিষয়টির সমাধান চেয়ে আমি দরখাস্ত করেছিলাম, সেনা প্রধান বরাবরেও জানিয়েছিলাম আমার অভিযোগ। আশা ছিলো এবারের বিজয় দিবসে অন্তত আমরা পাবো শহীদের উত্তরাধিকারীর স্বীকৃতি।
কিন্তু বিধি বাম, সেই প্রত্যাশা আমার বা আমাদের পরিবারের পূরন হলো না। উল্টো এখন ক্রমেই আমাকে গ্রাস করছে নিরাপত্তাহীনতা। এখন ভাবছি আর কোনদিনই আমাদের প্রত্যাশা পূরন হবেনা। হয়তো দখলদারদের বিরক্ত করার কারনে আমাকে ভোগ করতে হবে কোন ভয়াবহ পরিনতি। আমি নিজেকে এখন শুধুমাত্র সংখ্যালঘুই ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা আমার পিতার ভাই জয়ন্ত কুমার রায় শহীদ হলেও সংখ্যালঘুত্ত্বের কারনেই আজ এমন ঘটনা ঘটছে, তার নাম শত্র“( অর্পিত) তালিকায় অন্তভূক্ত করানো হয়েছিলো, তিনি শুধুমাত্র জয়ন্ত কুমার রায় বলেই।
জয়ন্ত কুমার রায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন। তাঁর মৃত্যুর পরে পাবনা শহরের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ তাঁর নাম শহীদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার বদলে তাঁর নাম শত্র“ (অর্পিত) তালিকায় অন্তভূক্ত করায়। এরপর থেকেই আমরা আগের বিভিন্ন সরকারের কাছে এই বিষয়ে ন্যায় বিচার চেয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় আমি গত ১৫-৪-২০০৭ তারিখে আমার এই দাবীর কথা প্রধান উপদেষ্টার দফতরে জানিয়েছি। তার পরেই পাবনার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিষয়টির তদন্ত করে সমাধান করার জন্য। জেলা প্রশাসন বিস্তারিত তদন্ত করে আমার এই দাবীর সত্যতা পেয়ে তা প্রধান উপদেষ্টার দফতরে জানালে, প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে দ্রুত শহীদ জয়ন্ত কুমার রায়ের উত্তরাধিকারীর কাছে এই সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য গত ১২-৬-২০০৭ তারিখে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এর পরেই জেলা প্রশাসন বিষয় নিষ্পন্ন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ৬০ দিন সময় প্রার্থনা করেন। এবং তারা গত ২৮-০৮-০৭ তারিখে সম্পদ হস্তান্তর বিষয়ক একটি পত্র প্রধান উপদেষ্টার কর্যালয়ে পাঠান। প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে পাবনা জেলা প্রশাসনের ভূিম মন্ত্রনালয়ের উদ্বৃতি দিয়ে পাঠানো পত্রটিকে “দায়সারা গোছের উল্লে¬খ করে এই ধরনের ঁহভধরৎ কার্যক্রম পড়ৎৎবপঃরড়হ করার বিষয়ে সরকারেরই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।”বলে লিখেছেন। কিন্তু তারপরেও অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরের নানা জটিলতার অজুহাত তুলে অজানা কারনে থেমে গেছে সবকিছূ। পাবনা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে আজো পর্যন্ত এই বিষয়ে আমাকে কোন কিছুই জানানো হয়নি। যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচিত বিষয়টির সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে- তার পরেও কেনো এই বিষয়টি আমাকে জানানো হচ্ছে না। অন্যদিকে পাবনা জেলা প্রশাসন আমাকে কোন কিছু অবহিত না করলেও গত ২১ জানুয়ারী থেকে উক্ত জমির দখলদার মোশাররফ হোসেন (তাদের লিজ এ বছর নবায়ন না করার ফলে তাদের সেই স্থানে কোন অবস্থান না করার কথা হলেও) সেই জমিতে নির্মাণকাজ শুরু করে। আমি পাবনার স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়টি জানানোর পরে তারা অনেক দেরিতে ব্যাবস্থা নিয়ে দখলদারদের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে। এর আগে আমি পাবনার জেলা প্রশাসনকে বারবার জানিয়েছি, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশে শহীদ জয়ন্ত কুমার রায়ের জমির সকল লিজ বাতিলের কথা বলা হয়েছে, সেই কারনে এই জমির সকল দখলদারদের উচ্ছেদ করা হোক। কিন্তু জেলা প্রশাসন আমার সেই কথাতে গুরুত্ব দেয়নি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশ অমান্য করে জেলা প্রশাসন দখলদারদেরই পক্ষে অবস্থান নেয়। আর আমি যখন জেলা প্রশাসকের কাছে কিছু জানতে চাই তখন তিনি আমার তাকে দেয়া দরখাস্তের কথাও বেমালুম অস্বীকার করেন।
চলতি বাংলা বছরে নতুন করে লিজ না দেয়া হলেও দখলদারেরা উক্ত জমি দখলে রেখে সাবলিজ দিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। এমনকি এবারেও দখলদারেরা কাজ শুরু করার পরে সংবাদপত্রে তা ছাপা হওয়াতে বাধ্য হয়ে পাবনা জেলা প্রশাসনের টনক নড়েছে। পাবনাতে শহীদ জয়ন্ত কুমার রায়ের সম্পত্তিতে এখন কোন লিজ নাই এবং পুরোনো লিজ নবায়নও করা হয়নি তাই ঐ জমির সকল দখলদারদের অবস্থানই অবৈধ, প্রশাসনের প্রথম কাজ ছিলো তাদের উচ্ছেদ করা। কেননা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশের পরে এখন যারা উক্ত জমিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করে রয়েছেন তারা সকলেই অবৈধ দখলদার। শুধুমাত্র জেলা প্রশাসনের কোন একটি অংশকে তুষ্ট রেখে তারা তাদের দখল বজায় রাখছে। প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে ট্রাইবুনালের কথা বললেও সেই বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন আজো কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
একটি কুচক্রী মহলের কারনে শহীদ জয়ন্ত কুমার রায় বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহীদ হওয়ার পরেও তার জমি শত্র“ ( অর্পিত ) সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছিলো। পাবনা পৌরসভার মৃত্যু নিবন্ধন বইতে ২-১১-১৯৭১ তারিখের নিবন্ধিত করে লেখা আছে, তিনি পাকিস্তানী সৈন্য কতৃক নিহত হয়েছেন। সুতরাং তাঁর সম্পদ অর্পিত হিসাবে কোনমতেই তালিকা ভূক্ত হতে পারে না। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ জানে কোন মতে তালিকাতে ঢোকাতে পারলেই সেই সম্পত্তি লিজ নেয়ার মাধ্যমে গ্রাস করা যায়। তাই তারা সেই কৌশলের আশ্রয় নিয়েই আমাদের দীর্ঘকাল বঞ্চিত করে রেখেছে।
এদিকে পাবনার জেলা প্রশাসক গোলাম মাওলা কয়েকদিন আগে আমার এই বিষয় নিয়ে সংবাদপত্রে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা একটি আইনের কারণে এ কাজটি সম্ভব হচ্ছে না। ওই আইনে অর্পিত সম্পত্তির হস্তান্তরের বা ফিরিয়ে দিতে হলে ট্রাইবুনালের মাধ্যমে করতে হবে। কিন্তু কোন সরকারই এ ট্রাইবুনাল গঠন করে যায়নি। ফলে আইন সংশোধন না করা পর্যস্ত জয়ন্ত কুমারের সস্পত্তির লিজ বাতিল করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে আমি স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই, শহীদ জয়ন্ত কুমার রায়ের সম্পত্তি যে অর্পিত নয় তা পাবনা জেলা প্রশাসক নিজেই তদন্ত করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ৩ জুন ’০৭ জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরে তিনি আবারো এই জমিকে কেন অর্পিত হিসেবে চিহ্নিত করে ট্রাইবুনালের কথা বলে সময়ক্ষেপন করছেন তা বুঝতে পারছি না। অন্যদিকে পাবনা জেলা প্রশাসন প্রধান উপদেষ্টার দফদরের নির্দেশের পরেও কেন আগের লিজগ্রহীতাদের এখন দখলদার বানিয়ে শহীদ জয়ন্ত রায়ের জমিতে বসিয়ে রেখেছেন তাও আমরা বুঝছি না।
দ্বিতীয়ত, যে মানুষটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে, তা প্রমানিত হওয়ার পরে কোন মতেই শত্র“(অর্পিত) সম্পত্তি আইনের অজুহাতে তা আটকে রাখা আইনী এবং মানবিক ভাবেও উচিত নয়। যারা আমাদের দেশটির প্রধান, তারা নিশ্চয়ই গত ৩৬ বছর ধরে জমে থাকা আমাদের বেদনা অনুভব করবেন। আপনাদের সবার সহায়তা পেলে নিশ্চয়ই আমি সুবিচার পাবো। আইনের মারপ্যাঁচে আটকে থাকবে না আমার এই দাবী।
যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের অনেক রকম ব্যাস্ততা, হয়তো তাদের সময়ও নেই এই লেখাটি পড়ার মতো, তবু যারা আমার এই লেখাটি পড়বেন তাদেরই জানাচ্ছি, যদি আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে আমার এই দাবী সত্যতা যাচাইয়ের পরেও প্রত্যাখাত হয় তবে আমি ও আমদের পরিবারের প্রতিাট সদস্য একত্রিত হবো স্বাধীনতা দিবসে। যখন মুক্তিযুদ্ধে পতাকা উড়বে সবখানে তখন আমরা আমাদের সন্তাদের বলবো যা দেখছো তা পুরোটা সত্য নয়, আমাদের এই দেশটি এখনো সব শহীদের প্রতি সম্মান জানায় নি। আর একই সাথে আমরা স্বাধীনতার দিনটিকে পারিবারিক ভাবেই অনশনের দিন হিসাবে পালন করবো। বিজয়ের বা স্বাধীনতার কোন আনন্দে আমাদেরতো থাকারই কথা নয়, কেননা এই রাষ্ট্র এখনো আমাদের শহীদ স্বজনকে জানায়নি তার প্রাপ্য সম্মান।
পাঠক, আপনি কি এই দিনে লাল সবুজ পতাকায় শুধু বিজয়ই দেখবেন, নাকি আপনার অবস্থান থেকে অন্তত প্রতিবাদটুকু জানাবেন। আর কতো বছর নিজেদের বেদনা আমরা নিজস্ব মৃতদেহের মতোই বহন করবো? ভাববো, আমরা খবরের কাগজে যা পড়ি, যা শুনি এর কোন কিছুই আমাদের পরিবারের জন্য সত্য নয়। সত্য হচ্ছে এই যে- আমাদের পরিবারের কোন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হননি, ১৯৭১ সালে কোন মুক্তিযুদ্ধ এদেশে হয়নি। আলী আহসান মুজাহিদ অথবা শাহ মোহম্মদ হান্নানের কথাই সত্য। বাকি সব কিছুই মিথ্যা। যা আমাকে আজকের এই বাংলদেশ শেখাচ্ছে।
অঞ্জন রায়: একটি বেসরকারী টেলিভিশনে কর্মরত।
[email protected]