সর্বাগ্রে চাই চৈতন্যের সংস্কার

মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর 

ঠিক এমূহুর্তে সংস্কার শব্দটি বহুল উচ্চারিত, আলোচিত এবং সমলোচিত একটি শব্দগেল বছরের ১১ জানুয়ারীর পটভূমিতে আসা বর্তমান সেনা সমর্থিত এ সরকার বাড়াবাড়ি রকমভাবে সংস্কার নিয়ে উচ্চকিত হওয়ায় শব্দটিতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হতে শুরু করে খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত কমবেশী আলোড়িত 

সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী সংস্কার এসেছে নির্বাচন কমিশনে, দূর্নীতি দমন কমিশনে, সরকারী কর্ম কমিশনে এবং বিচার বিভাগেনির্বাচন কমিশন, দূর্নীতি দমন কমিশন এবং সরকারী কর্ম কমিশন পূর্নগঠিত হয়েছে এগুলোর মূল কান্ডারীদের পরিবর্তন করে কাগজেপত্রে বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব হয়েছে বিলুপ্তএতে করে কি জনগনের আকাঙ্খিত সংস্কারের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে? জনগনের আকাঙ্খিত সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে জনকল্যানে কাজ করার সূযোগ দিয়ে প্রকৃত ক্ষমতায়ন করাকিন্তু বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় জনগনের মনে আজ সংশয়নির্বাচন কমিশন, দূর্নীতি দমন কমিশন এমনকি বিচার বিভাগ পর্যন্ত যে এক অদৃশ্য সূতোর টানে নাচছে তা এদের সাম্প্রতিক কার্য্যক্রমেই সুস্পষ্ট প্রতীয়মানকর্তার ইচ্ছে কর্ম-- সেই আগের মতোই চলছে 

সরকারের আরেকটি অদম্য ইচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কার আনয়নআর ঐ সংস্কারের মূল লক্ষ্য দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ এবং বি.এন.পি.র শীর্ষ নেতৃদ্বয়কে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিরতরে অপসারন করাআর এজন্য দূর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং বিচার বিভাগকে সাথে নিয়ে সরকার চালাচ্ছে সাঁড়াশী অভিযানএভাবে দুই নেত্রীকে দৃশ্যপট থেকে বিতাড়ন করলেই যদি রাজনৈতিক সংস্কার সাধিত হয় তবে সংস্কারের আভিধানিক অর্থকেই পরিবর্তন করতে হবেযা হোক, আক্লমন্দকে লিয়ে ইশারায়ই কাফি-- বর্তমান সরকারের সংস্কারের অর্ন্তনিহিত শানে নযুল আজ অনেকের কাছেই সুষ্পষ্ট 

তবে দেশের আপামর মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য সত্যিকার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীৃকার্য্যপ্রয়োজন বহুমাত্রিক সংস্কারের কার্য্যক্রমরাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা সহ সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সংস্কার আজ সময়ের দাবীকিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমাদের চিন্তা-চেতনার সংস্কার 

আমাদের চিন্তা-চেতনা বলতে আমি এই ভূখন্ডের সমাজের  নানা ন্তরে প্রতিষ্ঠিত  এবং কমবেশী  ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক চিন্তা চেতনার কথাই বলছিজাতি হিসেবে চিন্তা-চেতনায় এখনো আমরা পশ্চাৎপদ এবং আমাদের মনোজগতে শ্রেণীবিভাজন প্রকটভাবে ক্রিয়াশীলউপমহাদেশের সনাতন ধর্ম কেন্দ্রিক বর্ণ-বৈষম্যের আবর্তে এখনো আমরা আবর্তিত হচ্ছি নানাভাবেআমাদের চেতনা মানুষকে মানুষ হিসেবে নয় বরং মূল্যায়ন করে তার শ্রেণীগত অবস্থানের ভিত্তিতেএর প্রতিফলন রয়েছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতেসামাজিক সম্পর্ক এবং শ্রেণী ভিত্তিক সম্বোধন আপনি, তুমি, তুই-- বাংলাসহ উপমহাদেশের অন্যান্য প্রধান ভাষা, যেমন হিন্দি, উর্দুতে বর্তমানতাই আমরা অবলীলাক্রমে আমাদের বাপ-চাচার বয়সী খেটে খাওয়া মানুষ, যেমন একজন রিকশাওয়ালা কিংবা দিনমজুরকে বাংলা ব্যাকরণ নির্ধারিত তুই-তোকারী করতে পারিনোম চম্স্কি সহ অনেক ভাষা বিজ্ঞানী কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষার উপর সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভাবের সুষ্পষ্ট নিদর্শন দেখিয়েছেনতবে উপমহাদেশীয় ভাষা ব্যতিত পৃথিবীর অপরাপর ভাষায় শ্রেণী চেতনার এমন প্রকট প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর 

শুধু ভাষা ব্যবহারে নয় বরং রোজকার সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় আমরা শ্রেণী বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেই নানাভাবেআমরা, সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা নিম্নবর্গের মানুষের সাথে মেলামেশায় সতর্ক দূরত্ব বজায় রাখি সামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনায়উদাহরনস্বরূপ, আমরা কি আমাদের গৃহপরিচারিকা, তুচ্ছার্থে যাদেরকে বুয়াবলে সম্বোধন করি তাদের সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়ার কথা ভাবতে পারি! পাশ্চাত্য সমাজে এটি সম্ভবকিন্তু আমাদের চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারার শম্বুক গতিতে এমনতরো ভাবনা বাতুলতা মাত্র তবে এই একবিংশ শতাব্দিতে আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদা তো দিতে পারি!  

প্রশ্ন উঠতে পারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মাঝে তবে কি ইসলামী সাম্যবাদী চেতনার প্রভাব পড়েনিহ্যা, প্রভাব নিশ্চয়ই পড়েছে এবং সে কারণেই এ অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ ধর্মান্তরিত হয়েছিল ইসলামের সাম্যবাদের প্রবল আকর্ষণেতবে ধর্মান্তরিত হয়ে এদের অনেককেই হতে হয়েছিল আশাহতকারণ এখানকার ইসলামে দেশজ বর্ণবৈষম্যের প্রভাবে মুসলমানদের মধ্যে হয়েছিল আশরাফ/আতরাফ বিভাজন, যা নিঃসন্দেহে প্রকৃত ইসলামের পরিপন্থীপ্রকৃতপক্ষে ইসলামের সাম্যবাদ এখন শুধু মসজিদের ভেতরেই--এক কাতারে সারিবদ্ধভাবে নামাজ পড়ার মাঝেই সীমাবদ্ধইহলৌকিক সামাজিক কাজে, আচার-আচরণে বাঙ্গালী মুসলমানেরা আগের মতোনই শ্রেণী সচেতন 

আমাদের চিন্তা-চেতনার গভীরে প্রোথিত রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাযারা যত বেশী ক্ষমতাবান তারা ততবেশী সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণায় কলুষিতআমাদের গনতন্ত্র বিকাশের বড় অন্তরায়ও হচ্ছে এটিগনতন্ত্র হচ্ছে পরমত সহিষ্ণুতা এবং বিরোধী পক্ষের যৌক্তিক মতামতকে আমলে নেওয়াকিন্তু আমাদের গনতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু পবিত্র সংসদে প্রায়শঃই প্রতিফলিত হয় সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার মন-মানসিকতা তাই সংসদে দাঁড়িয়ে গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অন্য একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে চুপ কর বেয়াদপ বলে থামিয়ে দিতে পারেন অবলীলাক্রমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে গেলে নিজেদেরকে জমিদারহিসেবেই ভাবতে শুরু করেন নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীআর এমানসিকতার কারণেই সংসদীয় গনতন্ত্রের প্রাণ ভোমরা জাতীয় সংসদ হয়ে পড়েছিল অকার্য্যকর 

শাসকগোষ্ঠীর সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল গত জোট সরকারের আমলেজোট সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পুরো দেশটাকে নিজস্ব তালুকবিবেচনায় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুন্ঠন প্রক্রিয়ায় নির্দ্বিধায় অংশগ্রহন করেসামন্তযুগের রাজা-বাদশাহ্-র মতোই তারা লিপ্ত হয় ভোগ বিলাসেপ্রাসাদোপম বাড়ী, বিলাসবহুল গাড়ী, বাগানবাড়ী, ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা এগুলোতো সামন্তযুগেরই স্মারকজোট সরকারের লালু-ফালু, যারা শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চাৎপদ এবং যারা অতি দ্রুত উন্নীত হয়েছে লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণীতে, তাদের ভোগবিলাসের বিকৃত কার্য্যক্রমের মনোঃস্তাত্বিক ব্যাখ্যা সহজতরকিন্তু বহুবার দেশের অর্থমন্ত্রীর পদ যিনি করেছেন অলঙ্কৃত, যিনি বিলেতী শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোক, সেই সাইফুর রহমান যখন একই ধরনের সামšতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে বাগানবাড়ী সংস্কৃতিতে লালায়িত হোন, লালু-ফালুদের মতোন দূর্নীতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেন তখন তার শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ না বলে উপায় থাকে না সত্যিকার অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে মানুষের চিন্তা-চেতনার সংস্কার করতে পারে না তা একজন সাইফুর রহমান কিংবা অন্যান্য শিক্ষিত দূর্নীতিবাজরাই প্রমান 

বর্তমান সেনা সমর্থিত সরকারের মাঝেও যে আমাদের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সংক্রমিত তা ক্রমশঃ প্রকাশিত হচ্ছে এর কার্য্যক্রমেতাই তারা জনগনের ইচ্ছেকে তোয়াক্কা না করে চাচ্ছে তাদের ইচ্ছেমতোন রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতেপূর্ববর্তী সরকারগুলোর মতোনই এ সরকারও দেশকে নিজস্ব তালুকহিসেবে ভাবতে শুরু করছে তাই তারা পায়তারা শুরু করছে দেশের স্বার্থবিরোধী আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাথে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদনে, গণবিরোধী বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নে  

মূল কথা, চিন্তা-চেতনার সংস্কার ব্যতিত কোন সরকারের পক্ষেই গণমুখী কার্য্যক্রম করা সম্ভব নয়চিন্তা-চেতনা সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবেরএজন্য সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সত্যিকার দেশপ্রেমিক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে এককভাবে নয় বরং সংগঠিতভাবে 

 

মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর এ. আই. ইউ. বি-তে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা রত