তুমি বেঁচে থাকবে আমাদের মনে সঞ্জীব’দা

অমিত আহমেদ 

১৯৯৯ সালের দুপুর আড়াইটা। ভোরের কাগজ পুরানো ভবনের চার তলায় সবে পা রেখেছি কি রাখিনি বিপুল ভাই চরম উদ্যমে জিজ্ঞেস করলেন, “আররে, সাব্বির আসছে! বলো তো সাব্বির ডলচে ভিটা কি?” 

আমি হঠা প্রশ্নে একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ভোরের কাগজের ট্রেডিশন হচ্ছে চরম নির্দ্ধিধায় একে তাকে প্যাঁচে ফেলে দেয়াআপাত নিরিহ এ প্রশ্নের মাঝেও ধরা খাওয়ার উপাত্ত লুকিয়ে থাকতে পারে। তাও দেখি একদিকে রেজা ভাই, কলি আপা হাসি হাসি মুখে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যদিকে বুকে হাত গুঁজে টেবিলের উপর বসে আছেন সঞ্জিব’দা। তাঁর মুখেও একটা হাসির আভাস।

আমি সতর্ক হয়ে যাই। আত্মবিশ্বাসহীণ মিনমিনে গলায় বলি, “একটা সিনেমা!”

বিপুল ভাই উল্লসিত ভাবে বলেন, “সাব্বির জানে! এদিকে কি হইছে জানো?”

প্যাঁচের ফাঁদ এড়ানো গেছে বুঝতে পেরে আমার গলার জোর ফিরে আসে। আমি সমান উদ্যমে জিজ্ঞেস করি, “কি হইছে?”

“মঞ্জু সিনেমা নিয়ে তাফালিং মারতেছিল। সঞ্জীব’দা ওরে জিগায়, ডলচে ভিটা দেখছো? সে কি বলে জানো?” 

“কি বলে?”

“বলে, সঞ্জীব’দা আমাকে ভাবছেন কি? চিনি তো! আইসক্রিমের দোকান। সোবহানবাগে না?” 

সবার সাথে আমিও গলা ফাটিয়ে হাসি। 

সঞ্জীব’দা মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করেন, “দেখছো নাকি সিনেমাটা?” 

আমি বলি, “না!” 

তখন ভোরের কাগজে আমার বিপুল ভাই, রাসেল ভাই, সাগর ভাই, তানভীর ভাই, প্রতীক ভাই, আরিফ ভাইদের সাথেই খাতির বেশিরেজা ভাই, সঞ্জীব’দা, কলি আপা, মাসুদ ভাইদের একটু ভয়ই পেতাম, দূরে দূরে থাকতাম। পরের দিকে যদিও সেই ভয়টা কেটে যায়। 

সঞ্জীব’দার কাছের মানুষ ছিলাম, কিংবা খুব খাতির ছিল এটা বললে খুব ভুল বলা হবে। ভোরের কাগজে আসা যাওয়ার সুবাদে একটা চিন-পরিচয় ছিল। লেখা নিয়ে হঠা আলাপ হতো। ফিচার বিভাগে প্রকাশিত সব লেখাই মন দিয়ে পড়তেন। কোনো লেখা ভাল লাগলে বলতেন “ভাল হয়েছে”, মন্দ হলে বলতেন “ভাল হয় নাই” - এটা নিয়ে কোনো লুকোছাপা তাঁর ছিল না। 

আমরা চার বন্ধু মিলে তখন একটা লিটল ম্যাগাজিন চালাইনাম ছিল Y2K” (আরিফ ভাই যেটাকে মজা করে বলতেন ইংরেজী মাস্টহেডে দেশের প্রথম বাংলা সাহিত্য পত্রিকা)! সেটা নিয়ে উনার কাছে পরামর্শ চাইতাম। উনি বলতেন, “লিটল ম্যাগাজিনের যেইটা হয় কয়টা সংখ্যা বেরুনোর পরে বন্ধ হয়ে যায়। এইটা তোদের সাথে যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখবি, তাইলেই হবেতখন অহেতুক বড় গলায় খুব বলেছিলাম, “আরে নাহ! আমাদের ম্যাগাজিন থাকবে।” 

একবার টাকার খুব প্রয়োজন। কিছুতেই বিল তুলতে পারছি না, দোতলায় অনেক অনুনয়-বিনয় করেও ড্রয়ার খোলানো যায়নি। হতাশ আমি চার তলায় গিয়ে দেখি একা সঞ্জীব’দা বসে আছেন। উনাকেই বললাম, “দাদা, টাকা দিচ্ছেই না! কি করি বলেন তো? খুব দরকার!” 

উনি বললেন, “একশো টাকায় হবে? এই একশোই আছে পকেটে!” 

উনার কাছে ধার চাওয়ার নিমিত্তে কথাটা বলিনি আমি। নিজের অসহায়ত্বটাই কারু কাছে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছিল কেবলবিব্রত আমি বললাম, “দাদা, আমি তো ধার নেই না! জীবনে কখনো ধার নেই নাই।” 

উনি খুব বিরক্তি নিয়ে বললেন, “সাংবাদপত্রে কাজ করবা কিন্তু ধার নিবা না! এইটা কি সম্ভব নাকি?” 

এমন টুকিটাকি আলাপ প্রায়ই হতো। সবাই থাকলে চা আর চানাচুর-ঝালমুড়ি-ডালপুরি-পিঁয়াজু-সিঙ্গারার সাথে আড্ডা হতো। আগে কখনো ভাবিনি, ভাবার প্রয়োজনও হয়নি, সঞ্জীব’দাকে কেন আমার ভাল লাগে? 

এটা কি তাঁর সাথে আমার সামান্য ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারনে? সুখ কিংবা দুঃখে গোঁফের ফাঁকে সারাক্ষণ লেগে থাকা মুচকি হাসির জন্য? আঠারো-উনিশের সেই আমাকে ছোট করে না দেখার জন্য? নিজের অভিজ্ঞতাটা নির্দ্ধিধায় আমাদের সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেবার জন্য? খ্যাতির জন্য লালচহীণ নির্লিপ্ততার জন্য? এনসাইক্লোপিডিক জ্ঞানের জন্য? সব ধরনের আড্ডায় তাঁর সাবলীল বিচরণের জন্য? আবেগী মনে ছোটবড় সবার সাথ আদ্র মেলামেশার জন্য? মায়াকাড়া কিন্তু জ্বলন্ত কবিতা-গল্পের জন্য? নাকি তাঁর জাদুকরি সঙ্গীতের জন্য? 

আমি বুঝতে পারি আসলে এগুলো একটাও নয়!

মিডিয়া জীবনে একটা জিনিস আমার রগে রগে ঢুকে পড়ছিল। সেটা হচ্ছে “অবিশ্বাস”! আমাকে শেখাচ্ছিল কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, কারু উপর নির্ভর করা যায় না, নিজের পথটা নিজেকেই মেরে-কেটে তৈরী করে নিতে হয়ঠিক সে সময় অল্প যে ক’জনের সান্নিধ্যে আমি আবার মানুষে বিশ্বাস ফিরে পেতাম তাঁদের একজন এই সঞ্জীব’দা! আর তাই তাঁর প্রতি আমার এ অপার শ্রদ্ধা-ভালবাসা 

প্রথম যখন শুনি সঞ্জীব’দা হাসপাতালে কোমায় আছেন আমার কোনো বিকার আসে না। নির্লিপ্ত ভাবেই কম্পিউটারে নিজের কাজ করে যাই, রিসার্চের কাজ বড়ই গুরুত্বপূর্ণ! শুনি উনাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। মোটেই বিকার আসে না। সেই নির্লিপ্ত ভাবেই দিনটি চলে যায়। পরদিন কোনো এক সময়, অতর্কিতেই আমার অবিশ্বাসী মন ব্যাপারটা বিশ্বাস করে ফেলে! আমি বুঝতে পারি প্রিয় এ মানুষটিকে আমরা হারাতে যাচ্ছি! ভার্সিটিতে সুপারভাইসরের সাথে মিটিং ছিল, ল্যাবে কাজ ছিল, সব বাদ দিয়ে আমি ঘর অন্ধকার করে বসে থাকি। আমার ফোন বাজতে থাকে, আমি ধরি না। সেই ফোনের সেই বিরক্তিকর শব্দটি দিনভর স্থায়ীভাবে মগজে ঢুকে যায়... করোটিতে সস্তা রিংটোনের প্রতিধ্বনি হতে থাকে... হতেই থাকে! 

সঞ্জীব’দার সাথে আমার শেষ দেখা কবে-কোথায় সেটা মনে নেই, তবে ঘটনাটা মনে আছে। সেটা উনি যখন আজকের কাগজে ছিলেন তখন, সালটা কি ২০০৩? হয়তো! দেশে গিয়েছি দু’মাসের জন্য গিয়ে কোথাও আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় সঞ্জীব’দা। আমাকে দেখে হেঁটে আসলেন। চেহারা চিনতে পেরেছেন, নামটা হয়তো মনে নেই। উনি বললেন, “তোকে তো দেখিই না! এখনো ভোরের কাগজে?”

আড়াই বছর আগেই যে দেশ ছেড়েছি সেটা তাঁর মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। আমি ভুলটা কেন জানি ধরিয়ে দেই না। বলি, “এখন আর লিখি না সঞ্জীব’দা।” 

তিনি চোখেমুখে কেমন একটা অসহায়ত্ব নিয়ে বলেন, “ভোকায় সুন্দর একটা আড্ডা ছিল, না? সেই আড্ডা থেকে কতো লেখক উঠে আসতো, কবি উঠে আসতো। সব নষ্ট হয়ে গেল। তাই আর লিখতেও ইচ্ছা করে না!” 

“আসলেই দাদা! ভোকার আড্ডাটা খুব মিস করি।” 

“আজকের কাগজে আয়, ওখানে একটা আড্ডা জমানোর চেষ্টা করছি!” 

“কে কে আসে ওখানে?” 

“আসে...” উনি বেশ বিব্রত হয়েই বললেন, “আর আমি তো আছি, গেলে আমাকে তো পাবিই!” 

আমি বলি, “চেষ্টা করবো সঞ্জীব’দা!” 

সঞ্জীব’দা হাসেন। হয়তো খুশি হন। কিংবা হয়তো ধরতে পারেন আমি আসলে কখনোই সে “চেষ্টাটা” করবো না। কি জানি... কক্ষনো জানা হবে না! 

জানতে যে চাই, তাও না! 

টরান্টো, কানাডা

[email protected]