একটি কার্টুন কাহিনী ও তালেবান বাহিনী
অনিরুদ্ধ আহমেদ
এক
সম্প্রতি টেলিভিশনের পর্দায় আফগানিস্তানে অপহৃত বাংলাদেশের একজন ত্রাণকর্মীর দরিদ্র মা ‘র অসহায় কন্নার দৃশ্য দেখছিলাম যিনি ইসলামের দোহাই দিয়ে তাঁর পুত্রের মুক্তি কামনা করছিলেন । এ দৃশ্য হৃদয়স্পর্শী , ধর্মের নামে , এমন কী স্বধর্মী , নির্যাতনের এক বর্বর আচরণ। বস্তুত সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে , করেছে উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত ও বটে। আফগানিস্তানে ধর্মীয় কট্ররপন্থিদের হাতে বাংলাদেশের দু জন ত্রাণকর্মীর অপহরণ , একজনকে হত্যা এবং এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত অপরজনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাদের উৎকন্ঠা অপরিসিম। তারই পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি ব্যঙ্গচিত্রকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ভাবাবেগকে উস্কে দেওয়ার যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে বাংলাদেশে, সেটিও যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে জনমনে। এ দুটির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোন সম্পর্ক না থাকলেও একটি মোটা দাগের মিল ও আছে। আফগানিস্তানে যারা বাংলাদেশের দু জন মুসলমান ত্রাণকর্মীকে অপহরণ করেছে তারা তাদেরই সমর্থক যারা সে দেশে কট্টরপন্থি ইসলামি আইন জারী করতে চায়। তালেবান কিংবা তালেবান সমর্থক গোষ্ঠিগুলো আফগানিস্তানে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে। যে লোকগুলো তাদের দেশের মানুষদের রক্ষা করছে এবং এই মানুষদের মধ্যে অধিকাংশ জনই মুসলমান তাদের বিরুদ্ধে এই আচরণ অবিশ্বাস্য ভাবে অমানবিক। বাংলাদেশে যাঁরা ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত থাকেন এবং কার্টুন কাহিনীর মতো কোন সুযোগই হাত ছাড়া করেন না , তাঁরা এ ধরণের অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে , বস্তুত আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে কোন রকম মিটিং মিছিল করেছেন বলে মনে পড়ে না। বরঞ্চ এ ধরণের ধর্মব্যবসায়ীরাই এক সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিয়েছিলেন , “ আমরা সবাই তালেবান , বাংলা হবে আফগানিস্তান”। তাঁদেরই তাত্বিক সমর্থনে বাংলা ভাই , জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ ( জেএমবি) এবং এ ধরণের উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলো বাংলাদেশে এক সন্ত্রাসী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এখন ও যাঁরা বাংলাদেশকে শারিয়া ভিত্তিক কথিত ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার “ খোয়াব” দেখেন তাঁরাই উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে কুন্ঠিত হন । যাঁরা তালেবানদের এক সময়ে সমর্থনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেন , তাঁরা তালেবান বিতাড়নের জন্যে মুক্ত কন্ঠে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসা করেন না। এ হচ্ছে কতিপয় ধর্ম ব্যবসায়ীর দ্বৈত আচরণ। খোদ ইসলাম ধর্মে ও এ ধরণের “ মুনাফিক” দের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে একাধিকবার। বাংলাদেশে যখন ইসলাম ও শারিয়ার নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু হয়েছিল , নির্মম ভাবে নিহত হচ্ছিলেন লোকজন , বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল জেলায় জেলায় , তখনতো আমরা কোন ধর্মব্যবসায়ীর মিছিল মিটিং দেখিনি। তাঁদের মৌনতাই যেন দিয়েছিল এক ধরণের তাত্বিক ভিত্তি যাঁরা তাঁদের কথায় “ আল্লাহর আইন “ প্রচলন করতে চাইছিলেন , তাঁদেরকে। এই প্রেক্ষাপটটি আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন এ জন্যে যে আজ যাঁরা খ—গহস্ত হয়েছেন একজন কার্টুনিস্টের বিরুদ্ধে তাঁরা মানুষ হত্যার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হননি। এঁদের মধ্যে কেউ কেউতো ১৯৭১ সালের ঘাতক দালালদের সমর্থন ও করেছেন নির্বিঘ্নে
দুই
এ কথা অনস্বীকার্য যে কোন ধর্মের বিরুদ্ধেই কোন রকম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ ধর্ম যুক্তির বিষয় নয় ,বিশ্বাসের বিষয় মূলত। অতএব ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগলে ধর্মানুরাগী মানুষমাত্রই ক্ষিপ্ত হতে পারে। তবে এই উস্মাকে কাজে লাগিয়ে , মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিকে শোষন করে যাঁরা নিজেদের সুদূর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালান , তাঁদের সম্বন্ধেও সচেতন হবার সময় এসছে। কার্টুনিস্টকে কোন ব্যাখ্যার সুযোগ না দিয়ে , কার্টুনটির যে স্¦কপোল কল্পিত অপব্যাখ্যা দিতে উদ্যোগী হয়েছেন এক দল লোক তাতে তাঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হবার যথেষ্ট কারণ আছে। কার্টুনটির একটি ইতিবাচক ব্যাখ্যা হতে পারতো এর রকম যে হজরত মোহাম্মদ (দ) এর নামের অপব্যবহার করে , তাঁর মর্যাদাহানি করেন কেউ কেউ। অন্তত কার্টুনটি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে সেই রকম এক অনুভুতি যেখানে একদল মোল্লা- মৌলভী , নবীজির নামের যত্রতত্র প্রয়োগ করে , তাঁর মাহাত্মকে সামান্য করে তুলছেন। আমার এই ব্যাখ্যাটির সমর্থন পেলাম ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি ইসলামি মৌলবাদী দলের পত্রিকা কিশোর কন্ঠের একটি কৌতুক পড়ে । আর নামকে নিয়ে কৌতুকটি পাঠিয়েছে মাদ্রাসার একটি ছাত্র। পত্রিকাটির হাসির বাকস শীর্ষক কৌতুকের পাতায় মোহাম্মদ মাসুদ নামের ফেনীর এম এম ইস সি মাদ্রাসার একজন ছাত্র প্রায় অনুরূপ একটি কৌতুক পাঠিয়েছে যেখানে একই নামের অপপ্রয়োগ নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছে। ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনের কিশোর পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ ব্যঙ্গকৌতুক সম্পর্কে তো কোন ইসলামপন্থি দল , আলেম , উলামা , মাশায়েখ একটু ও আপত্তি করেননি । এ নিয়ে কোন রকম বাক বিতন্ডা , কৌতুক -লেখক ঐ মাদ্রাসার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা কিংবা ঐ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার কোন দাবী কেউ তো করেনি। তা হলে কি ইসলাম ও এর নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা তাদের পত্রিকার জন্য জায়েজ যারা ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করতে চায় ? আমার কিন্তু মনে হয়েছে তখনকার ঐ কৌতুক ও ছিল নিছক কৌতুক , এর পেছনে ধর্মীয় অবমাননার কোন উদ্দেশ্য ছিল না বরঞ্চ এতে একটা শিক্ষনীয় বিষয় ছিল যে হজরত মোহাম্মদের নামের যত্র তত্র ব্যবহার সঠিক নয় , তাতে নবীর নামেরই অমার্যাদা করা হয়। সে দিনের ঐ কিশোর কন্ঠ নামের পত্রিকার ঐ কৌতুকে যেমন , তেমনি এই কার্টুনে ও নবীজির প্রতি কোনরকম অবমাননা করা হয়নি , যারা নবীজির নামের অপপ্রয়োগ করেন , তাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
তিন
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে ইসলাম ধর্মে এবং বোধ করি অন্যান্য ধর্মেও অর্থপুর্ণ নাম রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সেটা আরবীতেই হোক কিংবা অন্য কোন ভাষায় । নামের একটা ভালো অর্থ থাকতে হবে এ কথা ইসলাম ধর্ম মনে করে । সে জন্যেই আরব দেশের আরবী নামগুলো অর্থবহ হয় , সে সব দেশে নামের আগে মোহাম্মদ যোগ করার প্রবণাতা ও কম। কিন্তু আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ায় নামের বরকত ও মাহাত্মের জন্যে অর্থের সামঞ্জস্য না রেখেও নামে মোহাম্মদ যোগ করা হয়। যেমন ধরুন যদি কারও নাম হয় , মোহাম্মদ শামসুর রহমান এর অর্থ কি হবে ? শামস অর্থ সূর্য , রহমান অর্থ দয়ালু এবং তা আল্লাহরই একটি নাম। অতএব শামসুর রহমান , এই নামটির মানে হলো , আল্লাহর সুর্য অর্থাৎ আল্লাহর ( স্রষ্টার ) আলো , অত্যন্ত অর্থবহ পরিপূর্ণ একটি নাম কিন্তু এই নামের আগে যে মোহাম্মদ যুক্ত হলো সেটি নামের অতিরিক্ত অংশ , অনেকটাই যেন প্রথাগত। এই প্রথায় হয়ত আভিধানিক অর্থ নেই , কিন্তু মাহাত্ম আছে এক রকমের , আছে হজরত মোহম্মদ ( দ) এর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নিখাদ প্রচেষ্টা। তবে সেই প্রচেষ্টা যদি নির্বিচারে অর্থহীন ভাবে যত্রতত্র প্রযুক্ত হয় , তা হলে এর অবমাননা ও করা হয়। প্রকৃত অর্থে ঐ কার্টুনটি এবং মৌলবাদী একটি দলের কিশোরদের পত্রিকায় ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ঐ কৌতুকটির উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। অথচ কৌতুকের বিরুদ্ধে কেউই সোচ্চার হননি তখন , কার্টুনের বিরুদ্ধে এখন সোচ্চার হলেন এঁরা, এর তাৎপর্য কি?
একটি বাহ্যিক কারণ হতে পারে এই যে কার্টুনে একজন মৌলভীকে দেখানো হয়েছে ছেলেটিকে নাম সম্বন্ধে উপদেশ দিতে অথচ পুর্বেকার ঐ কৌতুকে শিক্ষক ছাত্রকে নাম বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছেন। উভয় ক্ষেত্রেই ছাত্রটি/ বালকটি তার সারল্যের কারণে নামের অপপ্রয়োগ করছে। এটাই যদি কারণ হয় , তা হলে এই সব প্রতিবাদকারী কট্ররপন্থিদের কাছে হজরত মোহম্মদ ( দ) এর মর্যাদার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব! প্রকৃত বিষয় হচ্ছে এই যে ধর্মকে অপব্যবহারের কোন সুযোগই হাতছাড়া করতে রাজী নন এই সব লোক। ধর্মকে যাঁরা রাজনৈতিক ফায়দার জন্যে ব্যবহার করেন , ১৯৭১ সালে তাঁদেরকেই দেখেছি ইসলামের নাম ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করতে , নারী নির্যাতন করতে, তাঁরা কুন্ঠিত হননি । বায়তুল মোকাররমের যে উত্তর গেইট উত্তাল হয়ে ওঠে অযথা ইস্যু সৃষ্টি করে , সেই উত্তর গেইটে কখনও প্রতিবাদ হয় না যারা ধর্মের নামে অধর্ম চালাচ্ছে গোটা বিশ্বে। ওসামা বিন লাদেনকে কবে কোথায় আমেরিকা সমর্থন করেছিল সেই যুক্তি দিয়ে ওসামাকে রক্ষা করার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করি কিন্তু কখনই এই সব ধর্মব্যবসায়ী যাঁরা রাজনীতিতে ধর্মের প্রয়োগ চান , বিশাল কোন মিছিল বের করেন না আল ক্বায়দা কিংবা তালেবানের বিরুদ্ধে। এতেই বোঝা যায় এ সব লোকদের তাত্বিক আনুগত্য কোন দিকে , মুখে যতই শান্তির বাণী উচ্চারিত হয়।
চার
একটি “তুচ্ছ” ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে বিচলিত সরকার যেমন করে দমন করেছিলেন তখনকার প্রতিবাদ বিক্ষোভ , এখনও একটি অপব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে কতিপয় ধর্মব্যবসায়ীর এই অযৌক্তিক অন্যায় আস্ফালনকেও রুখবার দায়িত্ব সরকারেরই। বস্তুত ধর্মের প্রতি অবমাননা প্রদর্শন যেমন কখনই কাঙ্খিত নয় , তেমনি অবমাননার অভিযোগ তুলে উন্মাদনা সৃষ্টি ও যথার্থ নয়। কার্টুন বলুন , কৌতুক বলুন এ গুলোর সুক্ষ অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে না পেরে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি ধর্মেরই পরিপন্থি। রমজানের এই সময়টাতে যখন সংযমের প্রয়োজন সর্বাধিক এবং সেই সঙ্গে সহিষœুতারও তখন যারা একটি অপব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে তিলকে তাল করছেন , তাঁদের উদ্দেশ্য যে মহৎ নয় , সে কথা বুঝতেই হবে। আমরা একাত্তরে দেখেছি ধর্মকে রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা , আমরা মৌলবী বাজারের নুরজাহানকে দেখেছি ফতোয়াবাজদের কবল থেকে বাঁচতে গিয়ে আত্মাহুতি দিতে , আমরা হুমায়ুন আজাদকে দেখেছি মৌলবাদিদের হাতে আহত হতে । গণতন্ত্রের প্রতি বর্তমান অন্তবর্তী সরকার যখন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে প্রতিনিয়ত , তখন যাতে আবার ধর্মের নামে অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান না ঘটে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার । সকলের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সকল ধর্মের শান্তিপুর্ণ অবস্থান বাঙালি জীবনচর্যার একটি বলিষ্ঠ শক্তি। এই শক্তির প্রতি আমরা প্রত্যয় জ্ঞাপন করেছি ১৯৭১ এ । সেই প্রত্যয় থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই , সুযোগ সন্ধানীদের উস্কানীতে। যথার্থ ধর্মানুরাগীদের প্রতি যেমন আমাদের শ্রদ্ধা থাকবে অপরিসীম , তেমনি আমরা ঘৃণা করবো যারা ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে , ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে করবে ভক্তির পরিবর্তে শক্তির আখড়া, তাদেরকে।