চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির
অনিরুদ্ধ আহমেদবাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে যাদের সামান্যতম পরিচয় আছে, তারা জানেন যে দেশের প্রতিটি আন্দোলনকে সফল ও সার্থক করে তোলার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের ভূমিকা থেকেছে অগ্রগণ্য। তারা জাতিকে স্পষ্ট বিবেক দেখিয়েছেন, নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন জাতির স্বার্থে। বাঙালি জাতি থেকে জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা। আর সেজন্যই দেশি-বিদেশি স্বৈরশাসকদের খড়্গ নেমে এসেছে তাদেরই ওপর সবচেয়ে বেশি। এর অর্থ এ নয় যে, শিক্ষক-ছাত্ররা কখনো ভুল করেননি কিংবা তাদের অবস্থান আইনের ঊর্ধ্বে। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন শহীদ শিক্ষক-ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, তেমনি দালাল শিক্ষক-ছাত্রদের কলঙ্কে কলঙ্কিত। সেজন্যই আমাদের ইতিহাসের একদিকে যেমন রয়েছেন অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমেদ কিংবা জিসি দেবের মতো শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা, যারা নিজেদের বর্তমান উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালির ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করতে, তেমনি সাজ্জাদ হোসেন, হাসান জামান গংও ছিল, ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরাও (এবং তারা ছাত্রই ছিল), যারা ইতিহাসকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জোর চেষ্টা করেছিল, হাজার বছরের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি জাতিকে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধা প্রয়োগ করেছিল। আমাদের সৌভাগ্য, সেই প্রতিবন্ধকতা অতিত্রক্রম করে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং জাতির বিবেক হিসেবে শিক্ষকরা সবসময় সচেতন থেকেছেন যে কোনো ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। সমাজের অন্য শ্রেণীর মানুষ যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের অবদান রাখেননি তা কিন্তু নয়, তবে শিক্ষকরা তাদের অবস্থাানের কারণেই বিবেকের বিরুদ্ধে আপস করেননি। নিরাপস সেই সংগ্রামে যে বিজয়ী হওয়া যায়, নানা চত্রক্রান্ত সত্ত্বেও সম্প্রতি ছাত্র-শিক্ষকের মুক্তির ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে। শিক্ষকরা স্পষ্টতই বলেছেন, তারা কোনোত্রক্রমেই ক্ষমা প্রার্থনা করেননি, অন্যতম একজন শিক্ষক ড. আনোয়ার হোসেনের পূর্ববর্তী সময়ে ক্ষমা প্রার্থনার যে দৃশ্যটি টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল, তারও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং আনোয়ার হোসেন; বলেছেন, সেই ক্ষমা প্রার্থনা ও দুঃখ প্রকাশের সঙ্গে তিনি আরো কিছু কথা বলেছিলেন যেগুলো তাকে সম্পূর্ণ করতে দেওয়া হয়নি এবং যেটুকু তিনি বলেছিলেন, সেটুকুও প্রচারিত হয়নি মিডিয়াতে। সুতরাং অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই প্রচারিত হয়েছে আনোয়ার হোসেনের কথিত ক্ষমা প্রার্থনার কথা ও দৃশ্য। সেখানে আনোয়ার হোসেন যে সহমর্মিতার কথা উল্লেখ করেছিলেন সে কথা বুঝতে না পারলে তার ওই দুঃখ প্রকাশের খন্ডচিত্র দেখে অনেকেই ভুল বুঝতে পারতেন, যদি না অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন নিজেই বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতেন।
দুই. বস্তুত অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন একজন সংগ্রামী দৃঢ়চেতা পুরুষ। তার এই মনোবলের আরেকটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পড়লাম এবার আদালতে দেওয়া তার বক্তব্যে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সাদামাটা প্রচেষ্টা বা আর্জি করেননি এই স্বাধীনচেতা অধ্যাপক বরং কেন নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকদের সামনে এ ধরনের বিপত্তি আসতে পারে তা নিয়ে তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও ব্যক্তিক ঘটনার যে অনুপুঙ্খ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটি আমাদের সবারই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আমার এক অগ্রজতুল্য ব্যক্তি, যিনি এখানেই বসবাস করেন তিনি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সেই বক্তব্যের অনুলিপি আমার কাছে পাঠিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সে রকম আশঙ্কা থেকে আমিও মুক্ত ছিলাম না মোটেই। তার আশঙ্কা ছিল, আনোয়ার হোসেন যে রকম নিঃশঙ্কচিত্তে কিছু কথা বলে গেছেন, অভিযোগ ও উচ্চারণ করেছেন নির্ভয়ে, তাতে তার মুক্তি না হয়ে শাস্তিই বরং হতে পারে কঠোর ধরনের এবং সত্যি বলতে কি, সে রকম একটা ভয় আমার নিজের মনেও দানা বাঁধছিল। এর কারণ ক্ষমতাসীনরা ক্ষমাশীল হন না সহজেই, সহনশীল তো মোটেই নয়, সেটি রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য অরাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে তার চেয়েও খানিকটা বেশি, কারণ রাজনৈতিক সরকারের জবাবদিহি করার একটি নীতিগত অবস্থাান আছে, রাজনীতি-বহির্ভূত জরুরি অবস্থাার আইনে সেই নৈতিক অবস্থানও নেই। সে জন্যই আমি নিজেও শঙ্কিত বোধ করেছি এই শিক্ষক সম্পর্কে এবং দ্বিতীয় রায়ে অন্য দু’জনের সঙ্গে তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপারটিতে আমার এবং আমার সেই অগ্রজের আশঙ্কাটাই যে প্রায় প্রমাণিত হচ্ছিল। শত্র“র মুখে ছাই দিয়ে এবং শুভাকাঙ্খীদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন যে মুক্তি পেয়েছেন, সেজন্য আমরা সবাই আনন্দিত। তবে ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনি এই মুক্তচিত্ত নির্ভীক শিক্ষককে নিয়ে আমাদের আশঙ্কা তিরোহিত হয়নি এখনো। কারণ আমরা তো সেই অঞ্চলেরই লোক যেখানে হুমায়ুন আজাদরা আক্রান্ত হন, দ্বৈতচত্রেক্রর শিকার হন বেনজিররা। আনোয়ার হোসেনদের এই বাহ্যত মুক্তি কি আসলে এক ধরনের বন্ধনেরই নামান্তর, নাকি রাজনৈতিক দাবা খেলারই একটি সুচতুর চাল সে কথা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। তবে আপাতত যে সত্যটি প্রমাণিত হলো এবং যেটি তদন্ত কমিশনের সামনেও প্রমাণিত হয়েছিল যে শিক্ষকরা, ছাত্রদের সমর্থনে এসেছিলেন কেবল নৈতিক কারণে এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংশিষ্টতা ছিল না, তবে যেমনটি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন আদালতে যথার্থই বলেছেন, শিক্ষকরা এমন কোনো উর্দি পরেন না, যে কারণে তাদের ওপর রাজনীতি করার বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক ’৭৩-এর অধ্যাদেশে সে রকম কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কিংবা বাইরে কোনোরকম হিংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে সংশষ্ট ছিলেন না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের গোলযোগ যখন শহরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং এই গোলযোগ সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিত চেষ্টা নেওয়া হয় বলে যারা গোড়াতে দাবি করেছেন, তারা কেউই প্রথমত এটা প্রমাণ করতে পারেননি যে, এর সঙ্গে শিক্ষক-ছাত্রের সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং দ্বিতীয়ত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সক্রিয়বাদীদেরও তারা গ্রেফতার করেননি। তাহলে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে দেওয়ার পেছনে ঠিক কী উদ্দেশ্য কাজ করেছিল? এই জিজ্ঞাসা জনমনে থেকেই যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে আরো যে, সেদিনের সেই প্রতিবাদ এবং তার পরের ক্যাম্পাস-বহির্ভূত সেই বিশৃঙ্খলা কি এক ধরনের পাতানো খেলা ছিল সরকারেরই বিভিন্ন মহলের মধ্যে যাতে করে জরুরি অবস্থাার কঠোর রূপ ধারণকে এক ধরনের যৌক্তিকতা দেওয়া যেতে পারে, সরকারের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত উদারপন্থি এবং জনসাধারণকেও এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝানো হলো যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, ছাত্র-শিক্ষকদের জেলে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে আর সেই সঙ্গে জরুরি অবস্থা শিথিল করার কিঞ্চিৎ সম্ভাাবনা তিরোহিত হলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই কৌশলটা যে সঠিক কৌশল ছিল না এবং বর্তমান সরকারের বিয়োগ-দুই নীতির মতোই যে সেটা কালক্রমে ব্যর্থ হলো তার প্রমাণ পেলাম আমরা সম্প্রতি।
তিন. বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই প্রতিষ্ঠানের প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষককে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব সামরিক সরকারই এক ধরনের আশঙ্কার চোখেই দেখেছে। সেই আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে বিভিন্ন সরকারের আমলে। সামরিক সরকারদের মধ্যে একমাত্র জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার শিক্ষকদের একাংশের সঙ্গে এক ধরনের দোস্তি করতে সক্ষম হয়েছিল, জেনারেল এরশাদ এ ব্যাপারে এগুতে পারেননি সামান্যতমও, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কার্যকর ছাত্র সংগঠনকে ও পূর্ণাঙ্গতা দিতে পারেননি সেই স্বৈরশাসক এবং ছাত্র নামধারী একদল তরুণকে লেলিয়ে দিয়েও নিজের গদিকে রক্ষা করতে পারেননি। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে জেনারেল জিয়াই বোধহয় স্বৈরশাসকদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি রাজনৈতিক শূন্যতার ষোলোআনা সুযোগ নিয়ে কাউকে কাউকে দলে টানতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যরা সুবিধে করতে পারেননি। তবে জেনারেল এরশাদ জেনারেল জিয়ার মতোই আরো একটি বিষয়ে সফল হয়েছিলেন, আর সেটি হলো সামরিক ব্যবস্থাা থেকে অসামরিক লেবাসে রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি সফল এক্সিট পলিসি, তথা প্রস্থাান নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রস্থান অবশ্য ঠিক ক্ষমতা ত্যাগ নয়, কিন্তু উর্দি বদলিয়ে, ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টা। টিকে ছিলেন ও দীর্ঘদিন এরশাদ; জিয়াও বোধহয় থাকতেন যদি না সামরিক বাহিনীর মধ্যে তিনি এত হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য দায়ী থাকতেন। মজার কথা হচ্ছে, জিয়া-এরশাদের এই কথিত এক্সিট পলিসি হচ্ছে, ‘কে বলে যাও যাও যাও, আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া।’ প্রস্থাান করে ও ক্ষমতায় টিকে থাকার এ রকম কৌশলে বর্তমান সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার সফল হবে বলে এখনো মনে হচ্ছে না যদিও এ রকম গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে যে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে হলেও, প্রশাসনের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন, তাদের কর্মকান্ডকে বৈধতা প্রদানের জন্য। আমি নিজেও হয়তো এ ব্যাপারে একটু বেশিই আশাবাদী বলেই কি-না জানি না, আমার এখনো বিশ্বাস যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক কৌশলেও যে সফল হতে পারছে না, সেটা থেকে তাদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রত্রিক্রয়া শুরু করার ব্যাপারে তাদের ওপর যে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটি অনুধাবন করেই অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংলাপের কথা বলছে এবং এখন পর্যন্ত দৃঢ়ভাবেই বলে চলেছে, নির্বাচন ২০০৮ সালের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। তাদের এই প্রতিশ্রুতি পালন সম্পর্কে কিন্তু জনমনে এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে এবং সে কেবল এ কারণেই নয় যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর সরকার কিংবা সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার নির্বাচনের তারিখ নিজেদের সুবিধের জন্য পাল্টেছে বহুবার বরং এ কারণেও যে, এখনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমনকি ঘরোয়া রাজনীতিও এখন সীমিত রয়েছে ঢাকা শহরের মধ্যেই। এর ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ঢাকায় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে বিশেষত বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্যই এই বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারের দুর্ভাগ্য এই যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে খানিকটা কোন্দল দেখা দেওয়ার পর এখন আর বড় রকমের কোনো মতভেদ নেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের কথিত স্টার বা RATS (যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন) এখন আবার মূলধারার সঙ্গে একাত্মবোধ করছেন এবং বিশেষত দলীয় নেত্রীর গ্রেফতারের পর, আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভ্রান্তি দূর হয়েছে, দলটি সুসংহত হয়েছে আরো বেশি বলে মনে হচ্ছে। বিএনপির মধ্যে এই সংহতি অনেকটাই দুর্বল কিন্তু মেজর হাফিজ কিংবা দেলোয়ার হোসেনরা এখন আর তেমন বাগযুদ্ধে লিপ্ত নন আর সাইফুর রহমান এবং আবদুল মান্নান ভূঁইয়ারা এখন নিশ্চুপ। সুতরাং ঢাকাকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বিভাজন কর ও শাসন কর’র সেই ঔপনিবেশিক নীতি যে ব্যর্থ হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে খুব পরিষ্কারভাবেই। বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতি শুরু হলে। দুই নেত্রীর বিষয়ে যতই আপত্তি থাকুক না কেন, তাদের নিজ নিজ দলের কাছে, তারা এখনো শীর্ষে রয়েছেন আর জেলা-উপজেলা, গ্রামগঞ্জ পর্যায়ের রাজনৈতিক কার্যত্রক্রম অবাধ হলে সে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ক্ষমতায় যারা থাকতে চান, সরকারের মধ্যে এমন উপাদান এখনো বর্তমান থাকলে নিঃসন্দেহেই তাদের জন্য বিষয়টি অস্বস্তিকর।
চার. সেজন্যই ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তির এ বিষয়টি বস্ট‘ত গণতন্ত্রের জন্য এক বড় রকমের বিজয়। কোনো ধরনের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাার কাছে মাথা না নোয়ানোর যে প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন ছাত্র-শিক্ষকরা এবং অমানবিক নির্যাতনের মধ্যেও তারা যে শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, সেখান থেকে কেবল বর্তমান সরকার নয়, আমাদের সবার শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মরার আগে দু’বেলা না মরলেই কিন্তু জয়টা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণে যে বহু উদ্ধৃতিতুল্য কথা বলে গেছেন, তার মধ্যে একটি কথা আমাদের মনে এখনো দাগ কাটে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যারা বন্দি ছিলেন তাদের দৃঢ় মনোবল এবং যারা মুক্ত ছিলেন তাদের নির্ভীক আন্দোলন আমাদের এ কথাটিই মনে করিয়ে দেয় যে, ভয়শূন্য হৃদয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই হচ্ছে অন্যায় প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, এখন দেখা যাক অন্যায় প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট অন্যরা কী ভূমিকা রাখেন, যাতে করে বাংলাদেশের জন্য দ্র“ততম সময়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন হয় নিষ্কন্টক। সংস্কার বোধহয় সবাই চান; কিন্তু সে তো কেবল গণতন্ত্রের জন্যই সংস্কার, যে সংস্কার গণতন্ত্রকে প্রতিহত করবে, একনায়কতন্ত্রের দিকে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করবে, সেটি কুসংস্কার। বাংলাদেশ সে রকম কুসংস্কার থেকেও মুক্তি চায়।
মতামতের জন্যে ইমেইল পাঠাতে পারেন : [email protected]
এই লেখাটি ২৫শে জানুয়ারী তারিখের ঢাকার দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত
লেখক অনিরুদ্ধ আহমেদ , যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট।