স্বাগতম ২০০৮

অভিজি রায়

 

 

দেখতে দেখতে আরেকটি বছর চলে গেল। গত বছরটা খারাপ যায়নি মুক্তমনার জন্য।  এ বছরটিতেই আমরা জাহানারা ইমাম পদক পেয়েছি, যাকে আমাদের অনেকেই দেখেছেন এতদিনকার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে।  এতদিন আমাদের বিচরণ ছিল শুধু ইন্টারনেটের পাতায়।  জাহানারা ইমাম পদকপ্রাপ্তির মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের মিডিয়ায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলাম।  এর আগে বছরের শুরুতে আমার আর ফরিদ আহমেদের লেখা ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ আর বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বেরিয়েছিল (এ বছর বই মেলায় বই দুটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুচ্ছে)। আমাদের প্রত্যাশাকে পূর্ণ করে বইদুটি পাঠকপ্রিয়তায় ধন্য হয়েছে।  দ্বিজেন শর্মার মত জনপ্রিয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় লেখক এবং গবেষক আমাদের বইগুলো পড়ে নিজ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বইগুলো পর্যালোচনা করেছেন পত্রিকার পাতায়।  তার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে (ডারউইন : বিশ্বে ও মহাবিশ্বে দ্রষ্টব্য) ২৯ এ জুন। এছাড়া আমাদের বইয়ের রিভিউ বেরিয়েছে সমকাল, সায়েন্স ওয়ার্ল্ড সহ অনেক পত্র-পত্রিকাতেই। ডয়েচেভেল জার্মান রেডিও বাংলা থেকে বছরের প্রথম দিকে আমার একটি সাক্ষাকার নেওয়া হয়।  আমাদের বই দুটো নিয়ে ঢাকায় সেমিনারেরও আয়োজন করা হয়।  ‘প্রাণের উন্মেষ ও বিবর্তন’ বিষয়ক এই সেমিনারটির উদ্যোক্তা ছিল শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ।  সে সেমিনারে প্রাণের উপত্তি এবং বিবর্তনের রহস্যকে প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছিলেন আসিফ, ড. ম. আখতারুজ্জামান, ড. অজয় রায়, দ্বিজেন শর্মা, ড. শহিদুল ইসলাম, ড. এইচ কে এস আরেফিনের মত বরেণ্য  ব্যক্তিরা।  সে সেমিনারে বার বারই উঠে এসেছে মুক্তমনার কথা, মুক্তমনা লেখকদের লেখা সাম্প্রতিক বই-পত্রের কথা, তাদের অবদানের কথা।

 

ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে ডেইলি স্টার থেকে হঠা করেই মুক্তমনার একটি সাক্ষাকার নেওয়া হয়। মুক্তমনার পক্ষ থেকে সাক্ষাকার দেই আমি, জাহেদ আহমেদ এবং মেহুল কামদার।  ‘Freethinkers of Our Time’ শিরোনামে  আহমেদ হুসাইনের ফিচারটি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারীর নয় তারিখ ।  এই নিবন্ধটি আরো একবার সংগঠণ হিসেবে মুক্তমনা এবং এর কর্মকান্ডকে বাংলাদেশের পাঠকদের সামনে তুলে ধরল।

 

এর পর বছরের মাঝামাঝি সময় (জুলাই মাসে) মুক্তমনাকে ইউনিকোডে রূপান্তরিত করে ফেলা হয়। এটি ামাদের জন্য একটি বিরাট অগ্রগামীতা। এর ফলে আমাদের সাইটের বাংলা হরফগুলো যে কোন দেশের যে কোন ইউনিকোড কম্প্যাটিবল কম্পিউটারে বসে দেখা যাচ্ছে। শুধু দেখা নয়, যে কোন জায়গায় গিয়ে যেখানে বিজয় বা বর্ণসফট ব্যবহারের কোন আপশন নেই, সেখানেও বাংলা ব্যবহরো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।  আর তাছাড়া, সার্চ করার সুবিধা তো আছেই। সাইটটি ইউনিকোডেড হওয়ায় পৃথিবীর যেকোন সার্চ ইঞ্জিন -তা সে ইয়াহুই হোক কিংবা গুগোলই হোক, সেটা খুঁজে বের করতে পারছে।

 

জুলাইয়ের শেষ দিকে ঢাকা থেকে বেরোয় মুক্তান্বেষা, শিক্ষা-যুক্তি-বিজ্ঞান-মানবতা বিষয়ক প্রথম  ম্যাগাজিন। প্রথম আবির্ভাবেই এটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বৌদ্ধিক সমাজে স্থান করে নেয়। বিশশতকের গোড়ার দিকে শিখা গোষ্ঠি যেভাবে  বলেছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, যুক্তি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’, ঠিক সেভাবেই মুক্তান্বেষা একবিংশ শতাব্দীতে বাংলার রেনেসাঁর পুনর্জাগরণ ঘটালো নতুন বারতা নিয়ে –‘শিক্ষা, যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবাতা হোক আমাদের আলোকবর্তিকা’। মাত্র কয়েকমাসেই  পত্রিকাটির একহাজার কপি নিঃশেষিত হয়ে যায়। এর পরে আরো পাঁচশ। ২০০১ সালের ২৬ শে মে এক স্নিগ্ধ সকালে মুক্তমনা ফোরামের মাধ্যমে যে অ্যামেচার লেখকেরা তাদের স্বপ্নের স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন, তারই পরিণত বৃক্ষের রূপায়ণ  যেন ‘মুক্তান্বেষা’।  এর আগে আমাদের  সিলেট-নিবাসী যুক্তিবাদী সদস্য অনন্তের উদ্যোগে ফেব্রুয়ারী মাসে বেরোয় যুক্তি।  এ ম্যগাজিনটিও বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

 

বছরের শেষ দিকে,  জাহেদ আহমেদের আহবাণে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কিত অনলাইন আর্কাইভ গড়ে তুলবার প্রয়াসটি মুক্তমনার আরেকটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। উদ্যোগটি প্রথম-আলো সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রশংসিত হয়েছে। যতদূর জানি এর পেছনে আমাদের নিয়মত সদস্য এবং মুক্তমনার অকৃত্রিম বন্ধু নুরুজ্জামান মানিকেরও অনেক অবদান আছে। জানিয়ে রাখি, জাহিদ-মানিক কোলাবরেশন কিন্তু নতুন নয়।  এ বছরের জুলাই মাসে এরা আহমেদ ছফার উপরে একটি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে এরা (আহমদ ছফার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে 'মুক্তমনা'-র শ্রদ্ধান্জলি  দ্রষ্টব্য) আমাদের অবাক করে দিয়েছিল।

 

দুঃখজনক হলেও সত্য,  গত বছরটিতে মুক্তমনার প্রেক্ষাপট যতটা আলোকোজ্জ্বল ছিল, বাংলাদেশ ততটা নয়।  গোটা ২০০৭ সাল জুড়ে দুঃসহ জরুরি অবস্থা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রহর গুনেছে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বি একটি স্থিতিশীল দেশ পাওয়ার১১ জানুয়ারি এক অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় বর্তমান তথাকথিত ‘আর্মি ব্যাকড সরকার’গণতন্ত্র সুরক্ষা এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এলেও জরুরি আইন জারি করে নিষিদ্ধ করে সকল রাজনৈতিক তপরতারহিত করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার গোপনে গোপনে গড়ে তুলছে নাম-সর্বস্ব রাজনৈতিক দল।  ‘তুচ্ছ ঘটনায়’ শিক্ষকদের করেছে কারাবন্দী।  ধর্মান্ধদের তোষণ চলমান রাখতে ‘মোহাম্মদ বিড়ালের’ দোহাই পেড়ে বাচ্চা একটা কার্টুনিস্ট ছেলেকে নিয়ে গেছে রিমান্ডে।  এখনো সে গারদেই দিন কাটাচ্ছে।

 

বিগত বছরটিতে নিষিদ্ধ রাজনীতি এবং অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত করার তীব্র আকাংক্ষা নিয়ে যে অবিরাম প্রয়াস চালিয়েছে দেশের জনগ,  নতুন এই বছরে তার প্রাপ্তিযোগ ঘটবে কি? বিগত বছরের শেষ দিকে  মুজাহিদ-হান্নানদের আস্ফালনের চোটে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ধর্মীয় সংগংনগূলোকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার যে দাবী দেশব্যাপী দানা বেধেছে, ২০০৮-এ কি বিড়ালের ভাগ্যে সে শিকে ছিড়বে?  সে সুদিনের প্রত্যাশায়।

 

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

 

জানুয়ারী ১, ২০০৮


ড. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক ইমেইল : [email protected]