পরিস্থিতি উদ্বেগজনকঃ দেশমাতা শ্রেষ্ঠ-সন্তানদের আত্মত্যাগ চায়
বাতেন শাইখ
অগনিত জনমানুষের আত্মদানের বিনিময়ে এশিয়ার এ অঞ্চলে মুক্তিসংগ্রামে স্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এই সম্ভাবনাময় ছোট্ট দেশটির জন্ম হয়েছিল- একাত্তরে। কিন্তু তারপরই শুরু হয় আশাভঙ্গের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। একদিকে নিজ-দেশীয় শাসকদের সীমাহীন দুর্নীতি ও গণসমম্পদ লুণ্ঠণ এবং তার বিপরীতে অকল্পনীয় দারিদ্র, অকালমৃত্যু ও জনজীবনের উপর নানান উপদ্রব। ৩৭ বছর লাগাতার প্রতারণার দ্বারা সৃষ্ট সংকটের এক পর্যায়ে জরুরি অবস্থা ঘোষনার মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহন করে। কিন্তু এরা জনমানুষের মধ্যে যে ধরনের আশা জাগিয়েছিল তা দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। সম্প্রতি দুর্নীতি দমনে নমনীয়তা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতা, গণমানুষের আশাভঙ্গ ও দুর্বৃত্তের পুণঃক্ষতায়নের আশংকায় এক উদ্বেগজনক জাতীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ক্ষমতায়-থাকা সরকার এবং দ্রুত ক্ষমতায় ফিরতে আগ্রহী দুবৃত্তায়িত রাজনৈতিক দল এবং গণজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বুদ্ধিজীবীগণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে এমন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যা খণ্ডিত, কখনো বা বিকৃত, সর্বোপরি গড়পড়তা মানুষের জন্যে বিভ্রান্তিকর। সংকট সম্ভাবনার পূর্বশর্ত। কিন্তু পরিস্থিতির যথাযথ অনুধাবন ও সেইমত দেশের যোগ্যসন্তানেরা সাড়া না দিলে তা হতে পারে দুর্ভাগ্যজনক।
দূর্নীতিবাজদের বিচারঃ গত ১১জানুয়ারী ২০০৭-এ গঠিত এই সরকার গণক্ষোভ প্রশমন করতে দুর্বৃত্তায়িত ক্ষমতাকে আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়। তৃতীয় বিশ্বের এই অনুন্নত রাষ্ট্রে এই কাজটা মোটেই সহজ নয়। তথাপি সুনির্দিষ্টভাবে তালিকা করে দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার এবং বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিষয়টি নাড়া দেবার পর বাঙলাদেশের ভুমি-নদী-পাহাড়-ব্যাংক-আদালত সর্বত্র সম্প্রসারিত দুর্নীতির শতরকমের অপকর্মের পরিসংখ্যান ও ডাইমেনশন-এর ব্যাপকতায় মানুষ অবাক হয়ে যায়। এরপর এটা প্রত্যাশিত ছিল, স্বকীয় উদ্যোগে বিভিন্ন দল নিজ দুর্বৃত্তদের আইনের হাতে তুলে দেবে- যেমন অতিষ্ট পিতা সন্তানকে পুলিশে দেয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল অন্যরকম। ৩৭ বছর অপশাসনের আমলনামায় মাত্র ২০০ দুর্নীতিবাজকে দুদকের তালিকায় পাওয়া গেল। তন্মধ্যে এমন একজনকেও পাওয়া গেল না যিনি নিজ অপরাধ স্বীকার করেন কিংবা জনতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনায় আগ্রহী। বরং অনেকে পালিয়েছেন। অন্যেরা বিত্তবান হবার প্রচলিত সুযোগে বারবার আইনকে আইন দিয়ে ঠেকিয়ে রাখছেন, আইন (জেলকোড) লংঘন করছেন, কখনো আইনকে নাজেহালও করছেন। দৃষ্টান্তঃ অতি সম্প্র্রতি আপনারা লক্ষ্য করেছেন- গডফাদার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দুর্নীতি দমন আদালতে বিচারক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের ভবিষ্যৎ স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন; নিজেকে ‘রাজাকার’ ঘোষণা দিয়ে ধৃষ্টতাপুর্ণ বক্তব্য রাখছেন। আদালতে এ জাতীয় ফ্রি-ষ্টাইল আত্মম্ভরিতা মানুষকে দ্বিধায় ফেলে, কে অপরাধী- আসামী না আদালত? এই দেশে সাধারণ মানুষের সন্তানেরা, প্রত্যহ আদালতের কাঠগড়ায় দাড়ায়, কিংবা জেলখানায় ঢুকে—তাদেরকে কড়ায় গণ্ডায় আইন মানতে বাধ্য করা হয়। ওদের বেলায় ব্যতিক্রম কেন? সরকার এর কী সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দেবে? সাধারণ মানুষ মনে করে- সরকারের অনাবশ্যক নমনীয়তা, আইন প্রয়োগে দ্বৈততা, তদন্ত ও চার্জগঠনে অপক্কতা, আমলাদের অদক্ষতা ও অসততা সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে। সরকারকে স্পষ্টভাবে জানানো দরকার: যদি এমন কেউ থেকে থাকেন আসলেই দুর্নীতি করেন নাই, হয়রানি থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি দেয়া হোক। আর যারা বিচারের প্রক্রিয়ায় (প্রাইমাফেসী) আছেন তাদের যথাযথ প্রমান, তদন্ত ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করা হোক। এর মাঝামাঝি কোন অবস্থান থাকতে পারে না। কারণ দ্বিধা ও দুর্বলতার কারনে ইতোমধ্যেই দুর্নীতিবাজদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেছে। যা জাতীয় পর্যায়ে ক্ষোভ, দুশ্চিন্তা ও হতাশার কারণ বলে আমরা মনেকরি। সরকার মানুষের নিকট বারবার বক্তব্য দিয়ে আশা জাগিয়ে তারপর জনমানুষকে আবার আশাহত করতে পারেন না। কারণ এর পরিণতি ভয়াবহ।
বহিঃদেশীয় হস্তক্ষেপঃ এই প্রসঙ্গটি প্রায়শঃ জাতীয় দৈনিক প্রত্রিকায়, অন্যান্য মিডিয়ায় ও এমনকি সরকারের বক্তব্যে এমনভাবে উত্থাপিত হয়েছে যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই ঃ যে বিদেশীরা বাঙলাদেশের বিচারাধীন অপরাধীদের মানবাধিকার নিয়ে উচ্চকিত হচ্ছেন তারা বিগত তিনযুগের অপশাসন, মানবাধিকার লংঘন, নারীধর্ষণ, মফস্বলে সাংবাদিক হত্যা, মতপার্থক্যের জন্যে রাজনৈতিক হত্যাসহ লাগাতার নারকীয় দুর্বৃত্তপনার শিকার জনমানুষের দিকটাও বিবেচনায় রাখবেন। আমরা আশা করব- এই রাষ্ট্রকে দুর্বল ভেবে তারা কূটনীতির সীমানা ডিঙাবার চেষ্টা করবেন না।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা, গণমানুষের দুর্ভোগ, সেই সুযোগে স্বার্থান্বেষী প্রচারণার দ্বারা সৃষ্ট পরিস্থিতির ফাটলকে উপযুক্ত গুরুত্ব না-দিলে দেশ যে কোন সময় উল্টো দিকে মোড় নিতে পারে বলে মানুষের মধ্যে আশংকা বাড়ছে। এই দরিদ্রতম দেশে মানুষ চালসহ অত্যাবশ্যকীয় কতিপয় ভোগ্যপণ্যের বাজারদরের মাপকাঠিতে দেশ-শাসকের বৈধতা বিবেচনা করে থাকে। এটা বোঝার জন্যে অর্থনীতিবিদ হবার প্রয়োজন পড়ে না। আন্তর্জাতিক বাজার কিংবা দেশীয় দুর্বৃত্তপনা যেই দায়ী হোক মানুষ তার ব্যাখ্যা বা কার্যকারণ শুনতে চায় না। সরকারের পারঙ্গমতা দেখতে চায়। ভাতে-কষ্ট-পাওয়া মানুষের যে চিত্র ভেসে আসছে তা এক ধরনের সতর্ক সংকেত দিয়ে যায়। বিদেশী পরামর্শ বা খোলাবাজারের নিকট আত্মসমর্পণ না-করে সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ করবেন- এ তো ন্যূনতম প্রত্যাশা। অধিকন্তু আমরা বলতে চাই : প্রয়োজনে দুর্নীতিবাজদের বিপুল কালোটাকা, মূল্যবান গাড়ি ও সম্পদ নিলাম দিয়ে প্রাপ্ত টাকায় গণরেশনিংয়ের ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হোক। আইনে বাধা থাকলে অর্ডিন্যান্স করে বাধা অপসারণ করা হোক। জাতির ক্ষুণিœবৃত্তির চেয়ে আইন বেশি গুরুত্ব পেতে পারে না। এ বিষয়ে উপযুক্ত গুরুত্ব না পেলে নানারকম সাবোটাজ হতে পারে- সমস্ত বাঙলাদেশে জুড়ে তার আলামত দেখা যাচ্ছে। যার পরিণাম হতে পারে- জেলে-থাকা দুর্বৃত্তদের বিচার শেষ না-হতেই পুনরাগমন, দলের সংস্কার ছ্ড়াাই গণতন্ত্রের নামে দুর্বৃত্ত নির্বাচন, যা নিশ্চিত করবে অসতের পূণঃক্ষমতায়ন- অর্থাৎ সেই অধঃপতিত সাংসদ, মন্ত্রী, দলানুগত বিচারক-আমলা-পুলিশ, দলীয় দুর্বৃত্তদের পায়ের তলে চাপা-পড়া আবার সেই বাঙলাদেশ! যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারঃ এ বিষয়ে ৭১-পরবর্তি দলীয় দেশ-শাসকদের পুর্ণাঙ্গ গরজ না-থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও সংবেদনশীল মানুষেরা ছাড় দিতে রাজী না হওয়ায় চাপের কারনে আজ সেটা গণদাবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন সেক্টর কমান্ডারগণ এর নেতৃতের অগ্রভাগে আছেন। এটা আমরা আশা করব, একটি গণযুদ্ধের অপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তারা সকল স্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করবেন। যাতে অতীতের মত আন্দোলনের ফসল কোনো দলীয় রাজনীতির গোলায় না উঠে। এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যা বলা দরকারঃ ’৭১-এর যারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন এবং ’৭১-পরবর্তি সময়ে যারা নিজদেশের জনগণের সম্পদ লুণ্ঠণ করে দুর্নীতির অপরাধ করেছেন- উভয় অপরাধই ব্যাপক গণস্বার্থের বিরুদ্ধে সংঘটিত ও শাস্তিযোগ্য। অতীতের ইস্যুকে বর্তমানের অপরাধীরা আত্মগোপনের উপায় হিসাবে ব্যবহার করতেই পারে। এই দুই জ্বলন্ত গণইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষার ঐতিহাসিক দায়ভার আন্দোলনকারী নেতৃত্বের।
সর্বোপরি, এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষমতা এখানে ৪টি উল্লেখযোগ্য দলের মধ্যে বিভক্ত—সরকার, রাজনৈতিক দলসমুহ, কতিপয় দূতাবাস (তৎপশ্চাতের শক্তিশালী রাষ্ট্রসমুহ) ও জনগণ। তন্মধ্যে জনগণ সবচে অসংগঠিত ও ক্ষতিগ্রস্থ। গণস্বার্থে রাষ্ট ও সমাজের সার্বিক স্তরে দুর্বৃত্ত বিতাড়ন কোনো সরকারে একক দায় নয়, নিছক আইনের দ্বারা তা সম্ভবও নয়। ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত জনতার সংগঠিত প্রচেষ্টাই তাদের স্থায়ীভাবে দুর্ভোগমুক্ত করতে পারে। এ কাজে এগিয়ে আসবেন মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের সাহসী নতুন প্রজন্ম, নতুন উপলব্ধি ধারণ করেন এমন রাজনৈতিক কর্মী কিংবা অরাজনৈকিত যে কেউ- দেশপ্রেমিক পেশাজীবী, ব্যবসাজীবী, সংবাদকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী যারা গণমানুষকে সংগঠিত করার মৌলিক দায়িত্ব পালন করবেন। একটি দুর্বৃত্তমুক্ত আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নীত হবার সবরকম যোগ্যতা পূরণ করে বাঙলাদেশ। অধঃপতিতের বিপরীতে একটি অগ্রসর বিকল্পের জন্যে দেশমাতা শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগ চায়, আর একবার।
মহাসচিব, মুক্তযোদ্ধা গণপরিষদ ।