দুর্নীতি প্রতিরোধ আন্দোলন ও দ্বিতীয় মুক্তি-সংগ্রামের ডাক
বাতেন শাইখ
আজ অনেকেই এটা অনুধাবন করছেন যে, বাংলাদেশ এর জন্মের পর সবচে স্পর্শকাতর সময় অতিক্রম করছে। ৭১-এর পর আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সমাজিক পূর্বলক্ষণসমূহ দেখা যাচ্ছে। ৩৬ বছরে একদিকে দারিদ্র ও অন্যদিকে সীমাহীন দুর্নীতির দীর্ঘ প্রতারণার ফলে সমাজের সংকট (কনট্রাডিকশনস) বিস্ফোরণের পর্যায়ে অবস্থান করছে। যদিও তা অবদমিত আছে। এ জাতীয় পরিস্থিতি পেশাদার বিশ্লেষকের পক্ষেও দুরূহ। কারণ তা দেশের অগ্রগতি ও সর্বনাশের সমান সম্ভাবনা ধারণ করে। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে দেশ এগিয়ে যেতে পারে আবার দুর্ভাগ্যজনক মোড় নিতে পারে উল্টোদিকে। যা নির্ভর করে দেশমাতার যোগ্যসন্তানেরা এই পরিস্থিতিতে কিভাবে সাড়া দেবেন তার ওপর। অগ্রসর মানুষেরা সাধারণের জন্যে আবার সাহসের সঙ্গে কতটা ঝুঁকি নেবেন, তাদের স্বার্থ সমন্বিত করে কতটা শক্তির সমাবেশ ঘটাতে পারবেন একাত্তরের মতো- তার ওপর। তাই এই সময়ে নিজেদের করণীয় নির্ধারণের প্রসঙ্গ যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে।
আমরা যখন কোন জাতীয় দুর্যোগে বা কোন বিশেষ উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে সমবেত হই, প্রথমেই নির্মমভাবে অনুভব করি- যারা একাত্তরে সঙ্গী ছিলেন তাদের অনেকেই নেই হয়ে গেছেন। ওরা আলো আনবার জন্যে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। আর আমরা যারা যুদ্ধ জয়ের পর স্বাধীন দেশে দুর্নীতিগ্রস্তদের পায়ের তলে চাপা পড়ে বেঁচে আছি, সেদিন যুদ্ধকালে, অনেকেই কিশোর কিংবা প্রথম যৌবনের বয়স আমাদের। যে বয়স পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে অবাক হবার বয়স, নারী ও সৌন্দর্যকে প্রথম স্পর্শ করার বয়স। সে বয়সে আমাদেরকে স্পর্শ করতে হয়েছিল ধাতব মারণাস্ত্র। এটাই তৃতীয় বিশ্বে জন্ম নেয়া তারুণ্যের দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা। আমরা সেই বাস্তবতার ঝলসানো আগুনে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। সাহস ও আত্মবলীদানের মানদণ্ডে যে ক’টি মুক্তির যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে দাগ কেটে গেছে বাংলাদেশের একাত্তর তার একটি। এবং এশিয়ার এই অঞ্চলে সকল নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হিসাবে আজো তা স্মরণীয় বলে গণ্য করা হয়।
তারপর সবাই জানেন, আর আমরা নিজেদের জীবনের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জানলাম, কিভাবে আশাভঙ্গের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া শুরু হল। যুদ্ধে যারা অপরাধ করলেন, রাজনীতির অবিমৃশ্যতকারীতার কারণে তাদের প্রথমে ক্ষমা, পরে পরিপুষ্ট করা হলো। আর আমরা যারা অগ্রণী অবদান রাখলাম, কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই তাদেরকে নিরস্ত্র করে ক্ষমতার বাইরে রাখা হল। আমাদেরকে সূর্যসন্তান মহানসন্তান বলে, অভাবের দেশে রাজনীতির প্রলোভনে নষ্ট করে, তেজস্বী যারা তাদের হত্যা করে, ডাকাত কিংবা ভিক্ষুক বানিয়ে, হুইল চেয়ারে বসিয়ে নানান নির্মম প্রক্রিয়ায় নিস্ক্রিয় করা হল। ফলে ৩৬ বছরের প্রক্রিয়ায় বিশ্বস্ত প্রহরীর অভাবে রাষ্ট্র বেহাত হল জনতার। বিজয়ী জনগণকে মারজিনালাইজড্ করল নিজ দেশীয় অপশাসন। আর সারা পৃথিবী দেখলো বিস্তীর্ণ বাংলাদেশ জুড়ে দুর্নীতিবাজদের উল্লাসনৃত্য। একদিকে অকল্পনীয় দারিদ্র, অবিচার ও আহজারি এবং তার বিপরীতে গণসম্পদের নির্লজ্জ লুণ্ঠন- ভূমি নদী পাহাড় পরিবেশ থেকে নগণ্য ত্রাণসামগ্রী পর্যন্ত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যতটা সম্প্রসারণ সম্ভব, এবং তা বিদ্যমান রাখার জন্যে গণতন্ত্রের যত্তরকম বেইজ্জতি সম্ভব তার প্রায় সবটুকুই সম্পন্ন হল এই সম্ভাবনাময় ছোট্ট দেশটায়। আমরা রাজনীতিকে স্বপ্নপূরণের আদর্শ উপায় হিসাবে দেখলাম, এবং তাতে বাধা দেবার কারণে একাত্তরে এমনকি নিজ হাতে ঘনিষ্ঠজনদেরকেও হত্যা করলাম। আর সেই রাজনীতিকে এরা নামিয়ে আনল স্রেফ বেচাকেনার পর্যায়ে। কে অস্বীকার করবে যে, এদেশে মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা এমপি হওয়া একটি লাভজনক ব্যবসা নয়? ব্যবসায় লোকসান আছে, প্রকল্প ব্যর্থ হতে পারে, আল্লাহ মোনাজাত কবুল নাও করতে পারেন; কিন্তু একরাব এমপি হওয়া গেলে, আমরা দেখলাম, তিন পুরুষ ধরে অর্থ-বিত্তের আর কোনো অভাব হয় না। এবং এই অসৎ অর্জনের সন্ধান পেয়ে- আপনারা জানেন, পত্রিকায় দেখেছেন, কিভাবে বিদ্যুতের মিটার-রিডার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আমলা পর্যন্ত অর্জিত কালো টাকায়, ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, খুনের মামলার ফৌজদারী আসামী- সবাই যার যার পেশা ছেড়ে মানিকমিয়া এভিনিউর ওই দালানটায় প্রবেশ করার জন্যে সর্বোচ্চ ইনভেস্টমেন্ট করতে কি রকম মরীয়া হয়ে উঠল? সেটা কি গণতন্ত্রের জন্যে? তিন-চার জন অধঃপতিত মানুষের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার বাধ্যকতার নাম কি নির্বাচন ? আন্তর্জাতিক সংস্থাও হিসেব দেয়, ১০ থেকে ২০ কোটি কালো টাকা ব্যয়িত হয় মূলত খুনখারাবি ও ভোট কেনার জন্যে, আর সরকারি কাগজে নির্বাচন ব্যয়-বিবরণ দেয়া হয় ৫ লাখ টাকার! অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি হবার মহান পেশার শুরুটাই হয় নিজের সম্পর্কে সত্য গোপন করার ফলস্ স্টেটমেন্ট দিয়ে। যার জন্যে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুযায়ী শুরুতেই তাদের অধিকাংশের জেল হবার কথা ছিল। কিন্তু হাইকোর্টসহ দেশের সবকটি বিচারাদালত, স্বরাষ্ট্রসহ সকল মন্ত্রণালয়, পুলিশ প্রশাসনের সকল রাষ্ট্রীয় নেটওয়ার্ক এই ডাকাত এবং তাদের সহযোগীদের নির্লজ্জ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এবং সাধারণের দাঁড়াবার মতো কোনো জায়গা খোলা থাকে না।
এই রকম পরিস্থিতিতে অনগ্রসর দেশে প্রকৃতির তরফ থেকে যে ধরনের গজব নাজেল হতে পারে এক-এগারো তার একটা। সমাজতাত্ত্বিক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ মনে করে না যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে স্থগিত রাখা কোন অগ্রসর কাজ। কিন্তু এই পাপ কার? দুর্নীতি একটা মাত্রায় সব দেশেই থাকে কিন্তু দলীয় লুটতরাজের কোন পর্যায় মানুষের সহ্যের সীমানার বাইরে যায় এবং অতীষ্ট মানুষ কখন ক্ষমতার যে কোনো পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়? অনুন্নত দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সিভিল-মিলিটারী আন্তঃসম্পর্কের বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাস বলে-
Military intervention into civilian affairs is usually not precipitated by the military groups. In most cases, civilian turn to the military for support when civilian political structures and institutions fail, when factionalism develops and when constitutional means for conduct of political actions are lacking. (Amos Perlmutter/The Praetorian State and the Praetorian Army, p.390)
সামরিক বা স্রেফ শক্তিনির্ভর দেশশাসন স্থায়ী ব্যবস্থা নয়, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তা কাম্যও নয়। কিন্তু রাজনীতি যে প্রক্রিয়ায় চলছিল তাও কাক্সিক্ষত নয়। সংক্ষেপে এটাই সংকট। শংকিত দেশমাতা তার নির্ভরযোগ্য সন্তানদের কাছে জানতে চাইছেন- বারবার ঘুরেফিরে আসা এই চক্র থেকে বের হবার উপায় কী? করণীয় কী?
একাত্তরে মুক্তির সংগ্রাম সূত্রপাত হয়েছিল মূলত শোষণের বিরুদ্ধে ও অসাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্যে। আজ সর্বমহলে স্বীকার করা হয় যে, মুক্তির সেই সংগ্রাম লক্ষ্য অর্জন করেনি, করতে পারেনি। ফলে জাতির সামনে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা বা দল থেকে প্রায়শ আহবান করা হয় অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তকরণ কিংবা দ্বিতীয় স্তরের মুক্তিযুদ্ধের। সচেতনে, অবচেতনে, মহান উদ্দেশ্যে কিংবা হতে পারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আহবান আসে। কারণ বিদ্যমান জাতীয় সংকটের দাবি এটা। অতীষ্ট মানুষ তার নির্যাতনকারীর হাত থেকে রেহাই পেতে চায়, আর একবার। কিন্তু প্রেক্ষিত বদলেছে- এটা একাত্তর নয়। কার জন্যে মুক্তি? কার বিরুদ্ধে? কে লড়বে, কার ডাকে? লড়ে লাভ কি? সময় এখন যথেষ্ট ধারালো, মানুষ ঝুঁকি নেবার আগে জানতে চাইবেই। ভুল মানুষেরা গোঁজামিল-দেয়া এজেন্ডায় আহবান করলেই অগণিত মানুষ ঝঁপিয়ে পড়বে- বাংলাদেশে সম্ভবত সেই পর্যায় শেষ হয়েছে।
১৯৪৭-পর্যন্ত জাতীয় প্রতিরোধের সংগ্রাম হয়েছে বিজাতীয় বৃটিশ বেনিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৭১-এ ইন্টারনাল কলনিয়েল এক্সপ্লয়টেশনের জন্যে দায়ী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। বর্তমান পর্যায়ে, ২০০৮ কিংবা হতে পারে ২০১০ সালে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এবার নিজেদের মধ্যে, এবং নিজেদের বিরুদ্ধে। এটা যথেষ্ট কনফিউজিং এবং একই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ। এই নতুন বাস্তবতা নিয়ে ইতিহাস আবার আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ কাটিয়ে বেশিদূর যাবার উপায় নেই। এর একপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে তাদের বুকে পিঠে পা রেখে উপরে উঠে যাওয়া দুর্নীতিবাজ যারা রাজনীতিকে উপার্জনের উপায় হিসাবে ব্যবহার করে অর্থসম্পদ করেছেন, কিন্তু আইনসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। যে কারণেই হোক বর্তমান সরকারের দ্বারা তাদের ডিফেন্স ভেঙে যাওয়ায় তারা নগ্ন হয়ে পড়েছেন। ফলে চিহ্নিত করার কাজ পূর্ণাঙ্গ না হলেও সহজ হয়েছে। তবে এমন হতেই পারে এমন ব্যক্তি অভিযুুক্ত হয়েছেন যারা বিচারের প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি পেতে পারেন। আবার এমন অনেকে রয়ে গেছেন যারা এর অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পারে না। কিন্তু যা অবাক করার মতো- পৃথিবীর বহুল আলোচিত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে হাতে-নাতে ধরা পড়ার পরও ক্ষমতাচ্যুত অপরাধীরা যা আমাদের বোঝাতে চাচ্ছেন- তাদের ক্ষমতাকালে বাংলাদেশে দুর্নীতি হয় নাই; হলেও সেটা তারা করেন নাই; করেছে হয়তো অন্য কেউ? তাহলে মাথাপিছু এক ডলারের নীচে গড়আয়ের হতদরিদ্র দেশে মাত্র ৫/৬ বছরে নিজের এবং স্ত্রী সন্তান ও সাঙ্গ-পাঙ্গদের নামে বেনামে দেশে বিদেশে আয়সঙ্গতি বিহীন অবিশ্বাস্য কোটির অংকের ব্যাংক একাউন্ট, এফডিআর সনাক্ত হল কার? জব্দ করা বিভিন্ন থানার অর্ধশত এবং এখনো বেওয়ারিশ ফেলে রাখা কোটি টাকার গাড়ি পাওয়া যায় কার? এদেশে ৩ কোটি বেকার, হতাশায় নিমজ্জিতরা ৫ হাজার কোটি টাকার নেশাদ্রব্য সেবন করে ফি বছর। তাদের জন্যে শিল্পনির্মাণের কথা বলে কারা ব্যাংকঋণের খেলাপী টাকা দিয়ে বানায় ব্যাংক, লন্ডনে-ন্যূইয়কে-দেশে ফ্ল্যাট, বাগান বাড়ি- সামনে হরিণ!। এদেশে মায়ের অপুষ্ট জঠরে বছরে ১০ লাখ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়, কারা তাদের নাবালক সন্তানের একাউন্টে সরকারি অর্থ জমা করে? কার টাকায় দেশমাতার কুলাঙ্গার সন্তানদের জন্যে তোরণ নির্মাণ করা হয়; আর অভাবী যুবক রাজনৈতিক খুনাখুনি কিংবা ক্রসফায়ারে প্রাণ দেয়। স্বরাষ্ট্রে শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি যখন ঘুষের টাকার বিনিময়ে খুনীকে অব্যাহতি দেন, তখন যে কেউ অনর্থক খুন হতে পারে এ দেশে। অথর্ব আদালতে বিচারের নামে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ বছরের পর বছর; আর রাজনৈতিক সন্ত্রাসীর মারসি পিটিশন মন্ত্রীর মাধ্যমে দ্রুত রাষ্ট্রপতির হাতে পৌঁছায়। যে রাজনৈতিক কাঠামো এই রকমের দুশ্চরিত্র শাসকের জন্ম দেয় আমাদের জন্যে তার আর দরকার আছে কি না? অতঃপর বিস্মিত আমরা এও জানলাম, দশ বছর ধরে এই রাষ্ট্রের মহামান্য নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি জনগণের ট্যাকস-এর টাকা নিয়মিত ফাঁকি দিয়ে এসেছেন; আজ দায়ে পড়ে অপ্রদর্শিত কালো টাকা পরিমাণসহ নিজেই হঠাৎ ঘোষণা করেন- সেই রাষ্ট্র নৈতিক অধঃপতনের কোন পর্যায় নির্দেশ করে? এই মাপের লোকদের দ্বারা শাসিত হবার জন্যে এই রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ায় হাজার বীরসন্তান আত্মাহুতি দিয়েছিল কি না? আমরা কি বধ্যভূমিগুলিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি? সম্মানীয় সাংবিধানিক পদে থেকে কোন লাভজনক বাড়তি আয়-উৎসের সঙ্গে জড়িত থাকবেন না বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে শপথ করার পর যারা ধরা পড়লেন তারা জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে পারতেন। কিন্তু ঘটলো উল্টোটা। এই বৈল্পবিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে প্রিন্ট মিডিয়ায়, শক্তিশালী ক্যামেরায়, আদালতের প্রকাশ্য রেকর্ডে, গ্লোবাল ওয়েভে, ইন্টারনেটে সর্বোপরি নিজেদের চোখে আমরা তাদের অবৈধ অর্থবিত্তের হাজার কিসিমের আলামত প্রতিদিন দেখলাম। তারপরেও বলা হলো- এসব মিথ্যা, ষড়যন্ত্র; শুধু তাই নয় বলা হল- রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। পতিতেরও স্পর্ধা থাকতে পারে, কিন্তু তার সীমা কদ্দুর?
এই পর্যন্ত সরকারি হিসাব মতে দুর্নীতিবাজদের থেকে উদ্ধার করা অবৈধ টাকার পরিমাণ ৮২০ কোটি; এখনো হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে তার কয়েক গুণ। তাদের বিচার নিষ্পন্ন করতে রাষ্ট্র্রের খরচ হবে আরো কয়েক কোটি টাকা। অথচ বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবার আগেই এরা নিজেদের নির্দোষ দাবী করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন। এবং সুবিধাজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জানালা কেটে বের হয়ে আসার আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের ভি চিহ্ন দেখাচ্ছেন এবং আমরা আশংকা বোধ করছি। যাদের পাপে, দেশের স্বাভাবিক অবস্থা তছনছ হলো এবং আমরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলাম, তাদের পূর্ণাঙ্গ বিচার প্রক্রিয়া ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অঙ্গীকার থেকে সরে আসার কোনো অবকাশ নেই বর্তমান ক্ষমতার। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে এদের অন্তত কারো কারো ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হয়ে যাওয়া দারকার। যেন এই দেশে, এই ১৪ কোটির মধ্যে স্রেফ ভাতে-কষ্ট-পাওয়া ১১ কোটি অভাবী মানুষের দেশে, গণসম্পদ লুণ্ঠনের অমানবিক চিন্তা করতে ভবিষ্যতে কারো বুক কেঁপে উঠে।
এই ঐতিহাসিক কাজ আইনের দ্বারা হয় না। এটা কোনো হাত-পা বাঁধা সাময়িক সরকারের একার কাজ নয়। যে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের মোবিলাইজ করে প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। জনগণের জীবনের যথার্থ সংগ্রামের কোনো প্রক্সি হয় না, তাদের নিজেদেরই তা করতে হয়। যেমন করেছে একাত্তরের বাংলাদেশ। আমরা তো দেখেছি, সেদিন যুদ্ধের মাঠে যারা ছিলেন পঁচাশি ভাগ মাঠের কৃষক- কৃষকের সন্তান, গড়পরতা মানুষ। তারা লড়াই করেছে নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার নির্মম প্রয়োজনে। গণসম্পদ লুণ্ঠন প্রতিরোধের সেই প্রয়োজনে একই শর্ত নিয়ে পরিবর্তিত প্রেক্ষিতে আবার আমাদের সামনে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ। আজ প্রতিরোধ করবে যারা সর্বত্র জুড়ে আছে সেই মুক্তিযোদ্ধা যারা নষ্টের জীবাণু ধারণ করে না, শক্তিধারণ করে। এবং সেই জনতা- যাদের সাহায্য ছাড়া একদিন যুদ্ধ চলতো না । সঙ্গে আছে আমাদের সন্তান নতুন প্রজন্ম মূলত যাদের জন্যে দেশকে বাসযোগ্য করতে আবার এই ঝুঁকি নেয়া। সেই রাজনৈতিক কর্মী যারা প্রাণ দিয়ে নেতা বানায়, তাদের নেতারা সম্পদ বানায়, তাদের পরিবার অপমৃত্যুর সংবাদ ছাড়া কিছুই পায় না। সেই সংবাদকর্মী- পাপ উন্মোচন করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া সহকর্মীর জন্যে যে কষ্ট লালন করে গভীরে। সেই মেধাবী মানুষ- যারা ক্রান্তিকালে সামনের দিকে দেখতে পায়, গড়মানুষকে বিভ্রান্ত করে না। এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষ পেছাবার জায়গা নেই বলে যারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন।
এইসব মানুষের সমন্বিত শক্তিকে আহবান করছে দুর্বৃত্ত কবলিত বাংলাদেশ। আর একবার বোঝাপড়ার জন্যে ইতিহাসের আসন্ন আয়োজন। সংকট সম্ভাবনার পূর্বশর্ত। আমরা জেনেছি, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নীত হবার সবরকম যোগ্যতা পূরণ করে এই দেশ। প্রয়োজন আজ তিন দশকে প্রমাণিত অসতের ক্ষমতাকে অসম্ভব করে তোলা। এবং তা অসম্ভব নয়। যখন ব্যক্তি-কষ্টের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ইতিহাসের নির্মাণের আলোকিত আহবান শুনতে পাওয়া যায়-
“আমি তো প্রান্তে আছি, দিনদিন পিছিয়েছি
হেরে যাওয়া ছাড়া কিছু নেই হারাবার,
আবার প্রস্তুত আছি, ঘরে ঘরে গ্রামান্তরে
দুর্বৃত্তের মুখোমুখি দাঁড়াবার।”
মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ গবেষক।
[মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে ০১.০৯.২০০৭ তারিখে জাতিয় প্রেসক্লাবে প্রদত্ত বক্তব্য (পরিমার্জিত)