বাঙলাদেশে দুর্নীতি ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন
বাতেন শাইখ
আমরা সবাই অবগত আছি, সমাজে বসবাসকারী মানুষ যে উদ্দেশ্যে একটি রাষ্ট্র গঠণ করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে তা নির্মমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল। তাই নির্যাতন ও প্রতারণায় অতিষ্ট এ অঞ্চলের মানুষ তাদেরই একসময়ের সমর্থিত দুশ্চরিত্র রাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। যার ভাঙন থেকে জন্ম নেয় আজকের বাঙলাদেশ। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস ছিল মূলত সাধারন মানুষ- যারা ভুক্তভোগি ও অরাজনৈতিক- প্রচলিত ভাষায় যারা “জনগন”। অতঃপর, সেই জনগনের জীবনের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পুরনের অঙ্গিকার করে নতুন রাষ্ট্র-শাসনের দায়ীত্ব নেয় নিজ দেশীয় রাজনৈতিক দল ও দলীয় শাসকেরা। যুদ্ধবিজয়ী যে জনতা অল্পেই তুষ্ট করা যেত, তাদের স্বপ্ন নিহত হল। আর সারা পৃথিবী তাকিয়ে দেখল, নতুন শাসকেরা অবৈধ অর্থ-বিত্ত অর্জনের জন্যে সমাজতন্ত্রের নামে লুটপাট, নির্বাচনের নামে গনতন্ত্রের বেইজ্জতি এবং রাজনীতির নামে যতটা দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব তাই সম্পন্ন করেছে বিগত ৩৬ বছরে। একদিকে পনর কোটি অভাবী-মানুষের ভাতের কষ্ট, শিশুর অকাল মৃত্য, আশাহীন যুবকের আত্বহনন, তৎসঙ্গে অরক্ষিত জনপদে বারবার সীমা-ছাড়িয়ে-যাওয়া দুর্যোগ- প্রাকৃতিক বন্যা কিংবা বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে পাহাড়-পরিবেশ-নদীর বেদখল, ব্যাংকঋণ থেকে ডেউটিন- দুর্নীতির শতরকমের উদ্বাবনী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সমাজ ও রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে গেছে। মানবিক-কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন যে কেউ স্বদেশের এই অধঃপতনের চিত্র দেখতে পায়। এর জন্যে কোন পরিসংখ্যান কিংবা তত্ত্বজ্ঞান প্রয়োজন হয় না এখন। এই দীর্ঘসময়ে দুর্নীতিগ্রস্থদের পায়ের তলে চাপা-পড়া মানুষের প্রতিরোধ-আন্দোলন বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্ত তা হয়েছে লক্ষ্যচুত, কোথাও তা সীমিত, কোথাও সম্ভানাময় হলেও তা রয়ে গেছে স্থানীয়। জনস্বার্থের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব না থাকায়, নিচু মাপের লোকজন রাজনীতির ও আন্দোলনের উচু-স্তরে পাথরের মত অবস্থান করায়, সৎ-সংবেদশীল মানুষের কোন যোগাযোগ বা সমন্বয় কাঠামো না থাকায়- মানুষের বিক্ষোভ-প্রতিরোধ ক্রমেই তীব্র আকার নিয়ে শেষের দিকে অধিকতর কেয়টিক রুপ ধারন করে। এই রকম পরিস্থিতিতে, অনগ্রসর দেশে যা হয়ে থাকে তাই হলো এক/এগার-এর রাজনৈতিক পট পরিবতন। অতঃপর গড়মানুষের সঙ্গত ক্ষোভ প্রশমন করতে দুনীতিগ্রস্তদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। কিন্ত তা করতে গিয়ে বিস্ময়করভাবে দেখা যায় যে, দুর্বৃত্তায়নের পরিসংখ্যান ও ডাইমেনশন বাংলাদেশে এত ব্যপক যে, পরিস্থিতির মোকাবেলায় সেই মাপের ব্যপকতায় জনতার অংশগ্রহণ বা সামাজিক আন্দোলন দাবী করে। তাই লক্ষ করা যায়, সমাজের বিভিন্ন এলাকা থেকে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে, আশা ছেড়ে-দেয়া অনেকেই আবার আশা করতে চাচ্ছেন, কেউ কেউ সাধ্যমত উদ্যোগও শুরু করেছেন। এমনকি সরকারের সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ বলছেন জনতার ব্যপক অশংগ্রহণ ছাড়া কার্যকরভাবে দুনীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। আমরা জানি, বর্তমান সরকার ব্যবস্থা স্থায়ী নয়, তা কাম্যও নয়। অন্যদিকে, গণসম্পদ লুন্ঠনে জড়িত আয়-উৎস বর্হিভুত সম্পদের কারনে আইনের দ্বারা সনাক্তকৃত অধঃপতিতের পুনরাবির্ভাব কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সৎ মানুষের বিচ্ছিন্ন কন্ঠস্বর শোনা গেলেও তা দেশের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে তা মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়।
এই ঐতিহাসিক শূন্যতা ও আশংকা, সর্বনাশ ও সম্ভাবনার বাস্তবতা নিয়ে আলেকবার আমাদের সামনে এসে দাড়িয়েছে বাঙলাদেশ । একে পাশ কটিনোর উপায় নেই। ১৯৪৭-এ জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বৃটিশ বেণিয়াতন্ত্র; ১৯৭১-এ ইন্টারনাল কলনিয়েল এক্সপ্লয়টেশনের জন্যে দায়ী পাকিস্থানের শাসকচক্র। বর্তমানে, ২০০৮ কিংবা হতে পারে ২০১০-এ, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়, জনতার বিপক্ষ নিয়েছে গণসম্পদ লুণ্ঠনে জড়িত দুর্নীতিবাজেরা। এটা নিজেদের মধ্যে এবং নিজেদের বিরুদ্ধে, তাই যথেষ্ট ব্যতিক্রমী এবং একইসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ। এই বাস্তবতা নিয়ে দেশমাতার যোগ্য সন্তানদের নিকট আর এক একবার আত্বত্যাগ দাবী করছে বাঙলাদেশ। অনেকেই উপলব্ধি করবেন, এখানে সময় হয়েছে- আর একধাপ এগুতে চায় ইতিহাস । আমরা জানি, একটি উন্নত আধুিনক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উন্নীত হবার সবরকম যোগ্যতা ধারন করে বাঙলাদেশ, কিন্ত বাধা হয়ে আছে অসতের রাজনীতি। এবং তারই আশকারায় প্রশাসন, বিচারাদালত, চিকিৎসালয় সহ সকল মৌলিক প্রতিষ্ঠানের মস্তিস্কে অসতের অবস্থান- মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতই তার চুরান্ত প্রমাণ। সমাজকাঠামোর সার্বিক স্তরে দুর্নীতি তাড়ানো কোন সরকারের দায় নয়, কোন মহৎ পলিসি, ব্যক্তি বিশেষের বিবেক বা চিন্তার দ্বারা সম্ভব নয়। ভুক্তভোগি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংগঠিত প্রচেষ্টাই তাদের স্থায়ীভাবে দুর্ভোগমুক্ত করতে পার্।ে যথার্ত মুক্তি প্রচেষ্টার কোন শটকাট নেই, এর কোন প্রক্সি হয় না। এইরকম একটি গনমানুষের আন্দোলনের প্রক্রিয়াই অসতের ক্ষমতায়নে কার্যকারভাবে বাধাদান ও যোগ্যদের রাজনীতি ও সমাজে নেতৃত্বের স্থান ঠিক করে দিতে পারে।
এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব কার?
এদেশে মানুষেরর নিকট যারা নেতা বা প্রতিণিধি হিসাবে স্মরনীয় তারা কেউ বিলাসী জীবন যাপন করেন নাই। যারা নিজেরাই প্রশ্নবোধক জীবিকা নির্বাহ করেন তারা মহত বক্তব্য দিয়ে অগনিত মানুষকে জাগিয়ে তুলবেন? ইতিহাসে এমন হয় না, আশা করা ঠিক না। সমাজতাত্ত্বিক কারনে চালাকের বুদ্ধি নিয়ে মহত ভুমিকা স্থাপনের কোন উপায় নেই। বারবার প্রতরণার দ্বারা অভিজ্ঞ বর্তমান বাঙলাদেশ সেই সব মানুষের অগ্রণী ভুমিকা দাবী করেঃ যাদের রাজনীতি যাদের ধান্ধা কিংবা উপার্জনের উপায় নয়। পদবী ও প্রাপ্তির স্পর্শকাতরতা নেই। শুধু তত্ত্ব নয় বিশ্লেষন নয়- যারা পরিস্থিতির পুর্ণাঙ্গ দায়িত্ব গ্রহণ করে, নিজস্ব উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তই দিয়েই নিকৃষ্টকে মোকাবেলা /প্রতিস্থাপন করতে পারে। নিজশ্ব¦ বিশ্লেষনী ক্ষমতা, সত্য-উচ্চারনে অপরাজেয় দৃঢ়তা- শুরুতে বেশী নয়, সামান্য কিছু সাহসী মানুষ খুজছে দুবর্ৃৃত্ত-আক্রান্ত বাঙলাদেশ। এবং বাঙলাদেশেই প্রত্যেকটি এলাকায় এরা আছেন। নামী-দামী নাও হতে পারেন্। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেও থাকতে পারেন কিংবা নিস্ত্রিয়- তুলনামূলকভাবে অপরিচিত কিংবা অরাজনৈতিক । এদের সবাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মোটামুটি বৈষম্যহীন সমাজ অর্থাৎ একটি অগ্রসর বাঙলাদেশের স্বপ্ন দেখেন।
স্বপ্নের জন্যে ঝুকি-নিতে-পারা দেশমাতার ৫ থেকে ৭ জন সাহসী সন্তান অধঃপতিতের বিপরীতে কাঙ্খিত সমাজ ও রাজনীতি নির্মানের এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বাঙলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে শুরু করতে পারেন। ঘুরে দাড়াবার এখনই সময়।
স্বপ্নের জন্যে বাস্তবে আশু করনীয়-
১. দুর্নীতিগ্রস্থদের উন্মেচিত করাঃ প্রতেকটি জেলায় / থানায় আইনসঙ্গত সকল উপায়ে দুনীতিগ্রস্থদের পরিচয়, পরিসংখ্যাান, তথ্য, বিবরণ, ভিডিও, ষ্টিকার, আলোচনার ও সংগীত ইত্যাদির মাধ্যমে উন্মোচিত করা। যাতে ভুক্তভোগি মানুষ ৩৬ বছরের তাদের দুর্গতির জন্যে দায়ী গণসম্পদলুণ্ঠনকারীদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়া সনাক্ত করতে পারে। এবং জনপ্রতিনিধি হবার অযোগ্যতা সস্পর্কে ধারনা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
২. অফিস-আদালতও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যা জনসেবা প্রদান করতে সাংবিধানিক কারনে বাধ্য তারা কিভাবে সাধারন মানুষকে অসম্মান ও হয়রানি করে আসছে- মাঠপর্যায়ে-থেকে দুর্নীতি ও দারিদ্রের স্থানীয়, জাতিয় ও আর্šÍজাতিক কারণসমুহকে মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে আনা।
৩. করখেলাপী,ঋণখেলাপী রাজনীতির নেতা, এমপি ও আমলাদের রাষ্টীয় বা জনগনের সম্পদ আত্বসাতের যে সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য দুদক বা অন্যান্যভাবে পাওয়া গেছে তা জানার অধিকার মানুষের আছে। সেই বিবরন জনগনের অবগতির সুবিধার জন্যে প্রকাশ্যস্থানে প্রচারের ব্যবস্থা করা। যাতে । সৎ লোকের নির্বাচন সহজ এবং অসতের জন্যে অসুবিধাজনক হয়- তিনি যে দলেরই হোন না কেন।
৪. দলীয় দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ: আইন বিভাগ বা দলীয় সংসদ সদস্যদের কবল থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে পৃথক করার করা। যাতে সাংসদরা আইন প্রণয়ন, জাতিয়/ সাংবিধানিক দায়ীত্ব নিয়ে গবেষনা বাদ দিয়ে স্থানীয় সরকারের ডিসি, টিএনও ইত্যাদির সঙ্গে আঁতাত অতঃপর ঠিকাদারী, নির্মানকাজ, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা-দ্রব্যসামগ্রী আত্বস্রাৎ- দুর্নীতির ও দুর্বৃত্তায়নের এক মূল উৎস্। এই উৎস বিচ্ছিন্ন করে দিলে এমপি হবার লোক পাওয়া যাবে না। এ ব্যপারে যে আইন প্রণয়নের কথা হচ্ছে তার জোরালো দাবী উত্থাপন করা সকল স্তরের গনমানুষের ঐতিহাসিক দায়।
৫. ৭১-এর আগে যারা গনসম্পদ লুন্ঠনের চুড়ান্ত পর্যায়ে জনগনের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছেন, অতঃপর একপর্যায়ে যুদ্ধাপরাধ করেছেন। এবং ৭১-এর পর যারা নিজদেশের জনগণের সম্পদ লুন্ঠনে করে দুর্নীতির অপরাধ করেছেন। উভয় অপরাধই ব্যপক গণস্বাথের্র বিরুদ্ধে সংগঠিত ও শাস্থিযোগ্য। তাদের বিচারের আওতায় আনা ও নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষনা করা সময়ের দাবী। এই দুই জ্বলন্ত গনইস্যু- যাতে একটি অন্যটিকে নস্যাত করতে না পারে সেই ভারসাম্য রক্ষার ঐতিহাসিক দায় গণআন্দোলনকারী তথা সকলের।
৬. দুর্নীতি কোষঃ অবিলম্বে সকল দল-মত-পেশার উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিবাজদের পরিচিতি তথ্য-চিত্র-বর্ণনা সম্বলিত সহজ ভাষায় একটি দুর্নীতি-কোষ আবশ্যক। ব্যপক জনগনের অবগতি ও সচেতনার জন্যে যা সারা দেশে বিতরন ও সহজলভ্য করা আবশ্যক।
মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ গবেষক।
[মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে ০১.০৯.২০০৭ তারিখে জাতিয় প্রেসক্লাবে প্রদত্ত বক্তব্য (পরিমার্জিত)