আলপিনটা কার পাছায় গেঁথেছিল
বেলাল বেগ
প্রথম আলোর 'আলপিন' বর্তমান বাংলাভাষার সংবাদ জগতে একটি অতুলনীয় সাময়িকী। সম্পুর্ন আধুনিক মনষ্ক, বুদ্ধিদীপ্ত, পরিশীলিত ও রাষ্টন্সীয়-সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পন্ন এ রঙ্গরস মাগাজিনটার জন্য তার জন্ম থেকে পাঠকেরা অপেক্ষা করে থাকত সপ্তাহের সেদিনটিতে যেদিন তা বাজারে আসত। বীজানুমুক্ত সামাজিক আকুপাংচারের এই আলপিন নি:সন্দেহে বাংলাদেশের অর্জিত অনেক কৃতিত্বের একটি।
'আলপিন' এর মতই গৌরবদীপ্ত বেশ কটা বিভাগ ও বিষয় রয়েছে প্রথম আলোর। শিশিরের কার্টুন ছাপা হলে পাঠকমাত্রই হেডলাইন দেখার আগে ওটা চোখে দেখে। সরস চোখে জাতি, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের এমন নির্মোহ হৃদয়গ্রাহী সমালোচনা করার প্রতিভা সমসাময়িক কজন শিল্পীর আছে আমার জানা নেই। শিশির এবং আলপিন মিলে গোটা প্রথম আলোকে এমন একটি আলপিনে পরিনত করেছে যে তার ভয়ে ধর্ম, রাজনীতি, প্রশাসন এবং সকল পেশার সকল মুখোসধারীরা সব সময় তটস্খ থাকে। পেশাগত দক্ষতা, সম্মিলিত মেধা ও বুদ্ধির দীপ্তিতে পত্রিকাটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহন করে মতামত প্রভাবের দারুন ক্ষমতা অর্জন করে। ঐ ক্ষমতার কারনে আলপিনের খোঁচা-খাওয়া মানুষগুলি যন্ত্রণা চেপে ডায়রিয়া রোগীর মত হাসত এবং পরবর্তী খোঁচার ভয়ে সাবধানতা অবলóðন করত। কেউ কখনো পাল্টা খোঁচা দেবার সাহস করতনা।
সেদিন হঠাৎ করে প্রথম আলোর হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল। ম্যাগসেসে পুরস্কার প্রাপ্ত এশিয়াখ্যাত ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশে সুশীল সমাজের সংগঠক ও নেতা, স্বাধিন মত ও পথ প্রকাশের অতুলনীয় ক্ষমতাধর সম্পাদক, মুক্তবাজার অর্থনীতির আলোকে বাংলাদেশ ঢেলে সাজানোর লড়াকু প্রবক্তা, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান আলপিনে প্রকাশিত একটি অতি মামুলি কার্টুন প্রকাশের জন্য জনসমক্ষে মাফ চেয়েছেন। কারন বায়তুল মোকাররমের হেডবক্তা বাংলাদেশী জিহাদী নেতাদের নিয়ে সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকারে তাদের এজেন্ট ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের সংগে দেখা করে বলেছেন প্রথম আলোর কার্টুন দেশের ধর্মপ্রান মানুষের অনুভুতিতে আঘাত করেছে। দেশে যে স্খিতিশীলতা রয়েছে প্রথম আলো তা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছে। মোদ্দাকথা, প্রথম আলোর আলপিনটা তার পাছায় বিঁধেছে। অতএব প্রথম আলোর পাছায় পিনের বদলে গজাল ঢুকাতে হবে। যেই সেই কথা! জামাতে ইসলাম ক্ষমতা নিলে যে মসজিদ-সমাজ কায়েম হবে, তার হেড অফিস হবে এই বায়তুল মোকাররমের মসজিদ আর তার ইমামই হবেন আল্লার আইনের প্রধান বিচারপতি। সেটা যে হবেই তার আলামত আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। এই সেদিন 'তত্ত্ববোধ-উদ্ভাবক' সরকার সৎ মানুষের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসাবে মসজিদে দূর্নীতিবিরোধী খুৎবা দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে। সে অনুযায়ি প্রথম খুৎবা দিলেন বায়তুল মোকাররমে আল্লার আইনের প্রধান বিচারপতি ওবাইদুল হক। ক্ষুরধার বাক্য তরবারি দিয়ে জিয়ার বেটাকে জবাহ করে দিলেন। ও কাজটা জামাত নিজে করার মাঝে বিপদ আছে কারন পতিত সরকারে তারাও ছিল। একই সম্পর্কের কারনে জামাতে ইসলামির হয়ে এই খতিবই বলেছিলেন, 'আমেরিকা একটা শয়তানের দেশ'। মজার কথা, আমেরিকা কিন্তু কিছু বলেনি কারন তার পোষা এই ধর্মান্ধদের ইমেজবৃদ্ধি আমেরিকান পলিসিরই অংশ। এমন কি সুশীল সমাজের চরিত্রগত বাকস্বাধিনতা, নৈতিকতা ও ব্যক্তিগত সন্মনের মাথা খেয়ে সম্পূর্ন নির্দোষ একটি কার্টুন ছাপার কারনে একজন সাংবাদিকের জেলে যাওয়া সমর্থন করে, অন্যজনকে চাকুরিচ্যুত করে, আলপিনের সংখ্যা প্রত্যাহার করে, মতিউর রহমান কাপুরষতার যে প্রমান রাখলেন তা সভ্য, শিক্ষিত বাঙালীর জন্য একটি লজ্জাকর পরাজয়। একটি মুহুর্তেই মতিউর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধিনতার জন্য বাংলাদেশের সাংবাদিকদের গৌরবোজ্জðল ঐতিহ্যকে ভাগাড়ে ফেলে দিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলামিষ্টদের কাছে বিনা প্রতিবাদে মাথা নত করে মতিউর রহমান কেন তাদের শক্তির প্রতি সমর্থন দিলেন? এটাও কি আমেরিকার নীতি সমর্থন? আলপিনের পাঠকেরা বহু বছর ধরে সমাজের নানা অসসংগতির উপর কার্টূন ও সরস লেখা পড়ে এসেছে। এতদিন গোয়েন্দারা তার খবরও রাখেনি। দেশে লক্ষাধিক মানুষ জেলে আছে, দূর্নীতি উচ্ছেদ কার্যক্রমে সর্বশক্তি নিয়োগ করে সরকার ব্যস্ত। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে মানুষ দিশেহারা ও ক্রুদ্ধ। সুযোগ পেলে জনগন এ সরকারকে যে দেখে নেবে সামপ্রতিক ছাত্র ও শিক্ষক বিক্ষোভ তার ইংগিত বহন করছে। এমন কঠিন সময়ে একটি মামুলি, প্রায় বালখিল্য বিষয়কে হঠাৎ করে গোয়েন্দারা রসূলের প্রতি ব্যঙ্গ হিসাবে ঠাওড়াবার গবেষণা করার সময় কোথায় পেলেন। স্পষ্টত: গোয়েন্দাদের সাহায্য করারও বাহিনী আছে। আসলে বিষয়টি মৌলবাদী ইসলামিষ্টদের একটি সাজানো চক্রান্ত যেটার ইন্ধন খোদ সরকারই যোগিয়েছে। পেছনে সরকার আছে বলেই জরুরী অবস্খায় ৩০০০ মানুষ মিটিং মিছিল করার সাহস করেছে, প্রথম আলোর কপি পুড়িয়েছে রাস্তায়। । এরা কারা, সরকার, সেনাবাহিনী ও ইসলামীদের সংগে ওদের সম্পর্ক কি এটা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট।
অতি চালাকের গলায় দড়ি। প্রথম আলোর সম্পাদকের আলপিন মৌলবাদীরা তাঁরই পাছায় সিঁধিয়ে দিয়েছে। গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এমন কি সুশীল সমাজের পক্ষে তাঁর কোন কথার আর দাম রইল না। সম্পাদক হিসাবে মতিউর রহমানের হাস্যষ্পদ মৃত্যু বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৌতূক।
নিউইয়র্ক
সেপ্টেম্বর ২০, ২০০৭
বেলাল বেগ, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক।