জেনারেল মঈন এবং বাঙালী প্রতিভা
বেলাল বেগবাকধারা ও প্রবচন একটি জাতির প্রতিভা ও মানসিক ত্বেজস্বীতার দর্পন। আমাদের বাঙালী জাতির প্রবচন থেকে প্রতিভাত হয় আমরা একটি প্রতিভাবান জাতি। আমরা যখনই নিজেদের সন্বন্ধে সচেতন হয়েছি, তখনই ইতিহাস গড়েছি যেমন ১৯৫২, ১৯৭১। আর আত্ববিস্মৃত হওয়া মাত্রই অপমানিত ও নিগৃহীত হয়েছি। ১৯৭৫ সনে আত্ববিস্মৃতির অপমানকর যে কৃষ্ঞপক্ষ শুরু হয়েছে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারী তার অবসান ঘটেছে বলে মনে হয়েছিল অনেকের কাছে।
ঐতিহাসিক এক-এগারর পর বিশ্বের সদিচ্ছা জয়ের অভিযানে বেরিয়েছিলেন সমপ্রতি এক-এগারর নায়ক জেনারেক মঈন ইউ আহমদ। লন্ডনে পৌঁছে জেনারেল মঈন বলেছেন তিনি রাষ্ট্রপতি হতে চান না। 'দেশে সামরিক আইন জারি হবেনা' ওই বহুল ঘোষণার সংগে জেনারেলের এই উচ্চারন যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশে গনতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন সম্ভাবনার মশাল জ¦লে উঠেছিল। কিন্তু নিউইয়র্কে এসে সেনাপ্রধান ওই ব্যক্তব্য সংশোধন করলেন। বললেন আমি রাষ্ট্রপ্রধান হব না বলিনি, বলেছি আমার 'ইনটেনশান' নেই। এতে বাঙালীর একটি প্রবচন মনে পড়েছে, 'ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনা'। পরে আরো বললেন অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু ঘটবে। এবার আমাদের বুক কাঁপার পালা। জেনারেল যে কলা চুরি করতেই ঠাকুর ঘরে ঢুকেছেন, এতে আমাদের আর সন্দেহ রইলনা।
এক এগারর ট্রেসার ¹ানের রঙিন উজ্জ¦ল আলো আমাদের অনভ্যস্থ চোখ আশায় ভরে দিয়েছিল। এরপর অপরাধ ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে ঝটিকা আক্রমণ দারুন উৎসাহে জাগিয়ে তুলেছিল আমাদের জনগনকে। তারপর বিচার বিভাগের স্বাধিনতা, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সাভিস কমিশন সংস্থাগুলিকে স্বমহিমায় ও স্বশক্তিতে অধিষ্ঠিত করে দিয়ে প্রচ্ছন্ন সেনাশাসন দেশবাসীর সমর্থন আদায় করে নিল। ইতিপূর্বকার সরকারের নজীরবিহীন দুঃশাসন ও শোষণে হতবল ও ভগ্নমনোরথ জনসাধারন, দ্রব্যমূল্যের নির্মম কশাঘাত সত্বেও, নতুন ত্রাতাদের দুবাহু বাড়িয়ে বরন করতে শুরু করে। এবার বুঝি বাংলাদেশি বাঙালী-জীবনে কৃষঞপক্ষের অবসান হল। কিন্তু জয় করেও ভয় যায়নি আমাদের বিপর্যয়-ত্রাতা সেনাবাহিনীর রহস্যপুরুষদের। তারা ইসলামি জঙ্গীদের মত রাজনীতিকে দূর্নীতি ভেবে তার উপর হামলা করে বসলেন। দিগি¦জয়ের উত্তেজনায় তাঁরা খেয়াল করেননি যে রাজনীতি এবং সমরনীতির লক্ষ্য ও কর্মপন্থাসমূহ সম্পূর্ন ভিন্ন। তাঁদের এ মারাত্বক ভুলের জন্য ইতিমধ্যেই একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই জের হিসাবে বর্তমান নেপথ্যশক্তির প্রকাশ্য নায়ক আমাদের প্রিয়মুখ জেনারেল বড় বেকায়দায় পড়েছেন। এখন বাধ্য হয়ে চারদলীয় জোট তথা সামপ্রদায়িক রাজনীতি ও স্যেকুলার রাজনীতির দুনৌকায় পা দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন হবার কথা ছিলনা। প্রায় সবার ধনুকভাঙা পণ ছিল আমাদের এ সরকারকে কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেয়া যায়না।
আমাদের খুঁজে দেখতে হবে এ অবস্থা কে বা কারা করেছে এবং এ থেকে বাঁচার উপায় কি? খোঁজার কাজটিও দ্রুত সারতে হবে কারন কোন হিকমতে দুনৌকায় পা যদি কেউ দিতে পারেও, দুর্ঘটনা বেশিক্ষন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। দুর্ঘটনা ঠেকিয়ে রাখতে হলে জেনারেলকে মার্শাল ল দিতেই হবে। অথবা কোন এক পক্ষের পতাকা নিজে হাতে তুলে নিতে হবে। সেখানেও বাঙালীর প্রবচন স্মর্তব্য- 'ন্যাড়া দুবার বেলতলায় যায় না'। জিয়ার পরে এরশাদ সেনাবাহিনীকে জোর করে দ্বিতীয়বার বেলতলায় আনার পরিণাম সেনাবাহিনীসহ দেশবাসী স্বচক্ষে দেখেছে।
এক এগারর পর ক্ষমতায় আসা সেনা-চয়নিত সরকার দ্রুত একটি ক্র“টিমুক্ত নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। এমন সময় নেপথ্যের শক্তি হঠাৎ দেশের রাজনীতির কাঠামো বদলে দিতে চাইল। এ কাজটি ছিল একান্তই জনগনের কারন তারাই রাষ্ট্রের মালিক এবং ক্ষমতার উৎস। যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক-এগারর অভ্যুত্থান, তার প্রকৃত লক্ষ্যই ছিল জনগনের প্রকৃত নেতৃত্বের হাতে রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা। কিন্তু সে কর্তব্য ভুলে গিয়ে নেপথ্যের 'বিগ ব্রাদার' বা ব্রাদারগন নিজেরাই জনগনের রায় তৈরি করে দিতে চাইলেন। ওরা কারা?
আমরা লক্ষ্য করেছি, জনগন জানতে উন্মুখ হয়েছিল বাংলাদেশের এ নতুন নায়করা কারা। আমাদের সেনা প্রধান নিজেই প্রথম একটি সেমিনারে জানান দিলেন বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম-প্রধান দেশ, এখানে ইসলাম ধর্মের একটি ভূমিকা থাকবে। অন্যকথায় আমরা জেনে গেলাম জিয়া এবং এরশাদ গেছেন যে পথে, 'মডারেট মুসলিম কান্ট্রি বলে যে পথ আমেরিকা অনুমোদন করেছে, সে পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে আমাদের জেনারেলগনও চলবেন। আমরা জানি বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা, বাংলাদেশের জাতীয় পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মহজিবকে হত্যা করে, বাঙালীর স্বভাবজাত স্যেকুলার গনতন্ত্র ও সাম্যবাদের ভিত্তিতে রচিত সংবিধানকে বুটের নীচে ফেলে বেহেস্তগামী এই সেতুপথ রচনা করেছে আমাদের সেনাবাহিনী। আমরা এও জানি বাংলাদেশকে ১৯৪৭'র সাম্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে পুনরায় গড়ে তোলার জন্য একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করা জামাতে ইসলামিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করেছে এই সেনাবাহিনী। সুতরাং এক এগারর অভ্যুত্থানের পিছনে জামাতে ইসলামির হাত রয়েছে এমন কথাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে উঠতে পারে অভ্যত্থান না হলে পরিকল্পনানুযায়ী ঐ একই মতাদর্শে বিশ্বাসী জোটই ত ক্ষমতায় আসত, তাহলে অভ্যুত্থানের দরকারটাই বা কি ছিল? এর উত্তরে বলা যায়, বিএনপি তার নেতা-কর্মীর অকল্পনীয় দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এমন ভয়ঙ্কর ও অপ্রতিরুদ্ধ দানবদলে পরিণত হয়েছিল যে তার হাতে আওয়ামি লীগ কেন খোদ জামাতেরও মৃত্যু হতে পারত। ওদিকে চারদলীয় জোট বিশেষ করে জামাতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ইসলামি জঙ্গীবাদ এতই পরাক্রমশালী হয়ে উঠে যে আন্তর্জাতিক সুবিধাভোগকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্যও তা সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারত। এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দক্ষিন ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়ায় আমেরিকান ও ইউরোপীয় স্বার্থেরও পরিপন্থি হয়ে উঠতে পারে বিবেচনায় রাষ্ট্রক্ষমতা ১৯৭৫ এর মতই সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ে আসা দরকার হয়ে পড়ে। এসব কথা জনগনকে বলা যায় না। তাই বর্তমান শাসকদের নানা মুখোস পরে নানা ছলাকলা অবল¤¦ন করে বহুরূপী সাজতে হচ্ছে।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশমতৃকার বেশ ক'জন মেধাবী মানুষ এ অঘোষিত সামরিক সরকারে থাকা সত্বেও, ক্ষমতাসীন নেপথ্য শক্তিজোট বরাবরের মতই বাঙালীকে বোকা ভেবে বারবার হাইকোর্ট দেখাচ্ছে। আমাকে অতি কষ্ট ও দুঃখের সঙ্গে ডঃ ইউনূসের রাজনীতিতে প্রবেশ উপলক্ষে জননেতা রাশেদ খানের সে বিখ্যাত প্রবচনটির নতমুখে উধৃতি দিতে হচ্ছে ( কারন আমি তার একটি কঠোর সমালোচনা করেছিলাম), 'হাতি ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল'। আমরা ফেরদৌস কোরেশীর নতুন দল গঠনের নাটক দেখলাম, দেখলাম সংস্কারর-কুসংস্কার রাজনীতির খেলা, দু'নেত্রীর দেশছাড়া, দেশে থাকা ও জেলবন্দীর সুপার ড্রামা। এমন কি দেখলাম ইসলামি বিপ্লবের মহড়া হিসাবে প্রথম অলোর ডাকসাইটে সম্পাদক মতিউর রহমানের তওবা এবং 'ইমার্জেন্সি'কে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো ইসলামি জঙ্গী মিছিল। সর্বশেষ দেখলাম নির্বাচন কমিশনে জামাতে ইসলামির প্রকাশ্য ঘোষনা- জামাত স্বাধিনতা বিরোধী ছিলনা। এখন স্বাধীন নির্বাচন কমিশনে দূরপনেয় কালিতে সীলমোহর পাওয়া জামাতকে আর স্বাধীনতাবিরোধী বলা যাবেনা। যুদ্ধাপরাধী বলে তাদের বিচারও করা যাবেনা।
এদিকে নাটকের অন্য দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতেই নিহত জাতির পিতা শেখ মুজিবকে জেনারেল মুঈন এখন 'জাতির পিতা' হিসাবে এবং একই সংগে জাতির পিতার সকল স্বপ্নের নস্যাৎকারী জিয়াউর রহমানকে জাতীয় বীর হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি মুজিব হত্যাকারীদের বিচারের কথা কিছু বললেন না। এ হাইকোর্ট তিনি কাকে দেখালেন? তবে কি তিনি পার্লমেন্টারী শাসনে বিশ্বাসী আওয়ামি লীগ ও বিএনপির একত্র পুনরুত্থানে ভয় পাচ্ছেন? স্বর্গবাস প্রতিজ্ঞাকারী ইসলামি বিপ্লবে বিশ্বাসী জামাত এবং পাপময় মর্ত্যরে সমাজে বিশ্বাসী বিএনপি-আওয়ামি লীগের এই দুই নৌকায় এ জন্যই কি জেনারেল মঈন পা দিয়েছেন?
বাঙালী-মেধা বহু যূগ আগে আবিস্কার করেছে দুই নৌকায় পা রাখা যায় না। ওটা করা না গেলে ভবিষ্যতে আরো বহু কিছু ঘটবে বলে জেনারেল ঘোষনা দিয়েছেন। এ সব শুনে বোকা বাঙালীরা হয়ত ভয় পেয়ে যাবে। আসলে বাঙালীকে যারা বোকা ভাবে তারাই বোকা। জেনারেলগন এবং তাদের দেশি-বিদেশী পরামর্শদাতারা কি করতে পারেন আর পারেন না, বাঙালীরা কিন্তু ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে। আসলে বর্তমান ক্ষমতাসীন শক্তিজোট ও তাদের প্রতিভূ জেনারেল মঈন কায়মনোবাক্যে বাঙালী নন। যদি হতেন, তা হলে এতদিনে বহু কিছু হয়ে যেত। পঁচাত্তর ও তৎপরবর্তী সকল পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত হত এবং একাত্তরের স্বাধিনতায় লক্ষ লক্ষ স্বজন ও অপূরনীয় ধন-সম্পদহারা সর্বপ্রকার ত্যাগ ও কষ্টস্বীকার করা বাংলাদেশের ১৫ কোটি বাঙালীকে তাদের জীবনের ধন- স্বাধিনতা ও বাঁচার অহংকার আত্বসন্মান ফেরৎ দেয়া হত।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকে লুটেরা মধ্যবিত্তের দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করে যে সেনাবাহিনী জনগনের মন জয় করেছে, তারা কিন্তু এ জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত সবচেয়ে বড় দূর্নীতি- 'ধর্মের নামে স্বাধিনতার ধর্ষণ' তার বিরুদ্ধে কিছুই করেনি। সুতরাং অপারেশন ক্লিনহার্ট, র্যাবের নরহত্যার মতই চমকপ্রদ 'দূর্নীতি ধ্বংস অভিযান'ও একটি স্মরনীয় ঘটনা হয়ে থাকবে পরবর্তী ক্যমিউনাল মডারেট মুসলিম শাসনামলে। বড়জোর জেল-জুলুম ও নরহত্যা ছাড়া নতুন কিছু দেখাতে পারবেন বলে মনে হয় না জেনারেল এবং ভবিষ্যত প্রেসিডেন্ট মঈন ইউ খান।
বেলাল বেগ, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক।