হাসিনার জেলে যাওয়া উপলক্ষে দুটি গল্প
বেলাল বেগ



আধুনিক বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে জেলে যাওয়া ছিল দেশপ্রেমের রাজটিকা। বৃটিশ আমলে জেলে গেলে কোন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর খ্যাতি রাতারাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। তার স
সাহস, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং আাÍত্যাগের নানা গল্প তার অনুসারী এবং সাধারন দেশবাসীর কাছে আরও প্রবল সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরনা যোগাত। ১৯৪৭ সনে বৃটিশের ভিক্ষা দেওয়া স্বাধিনতা উত্তর কালে জেলের ভয় দেখানো বা জেলে দেয়া প্রতিপক্ষকে বশে রাখার একটি খেলা হয়ে উঠে। পাকিস্তান আমলে জেলে যাওয়া ডালভাত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতা জেলে যাবার প্রস্তুতি হিসাবে একসেট কাপড় আলাদা করে রাখতেন। বড় মাপের নেতারা জেলে গেলে সাধারন মানুষ ধরে নিত সহসা একটা বড় সিদ্ধান্ত হবে। তবে শ্রেনী-শোষণমুক্ত সমাজের জন্য যারা আন্দোলন করতেন তারা জানতেন জেলে যাওয়া মানে হাঙ্গড়ের পেটে যাওয়া এবং ফিরে এলেও বিকলাঙ্গ হওয়া। এজন্য তাঁরা হুলিয়া মাথায় নিয়ে নিজেদের জীবনপণ সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন। কিংবদন্তী নেতা মণি সিং প্রায় আজীবন হুলিয়া মাথায় কাটিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধিন হবার পরেও অবহেলিত বঞ্চিত জনগনের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা না আসায়, বাঙালির প্রকৃত মুক্তির জন্য অসংখ্য মানুষ কারার করাল অন্ধকারে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন কিংবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে, রোগে ভুগে মৃত্যু বরন করেছেন। তাদের আত্বত্যাগের আলোকিত গল্পগুলি আমরা শুনতে পাইনি। মোদ্দা কথা, সাচ্চা দেশপ্রেমিক রাজনীতিক তার দেশ ও মানুষের জন্য জেলে যেতে কখনো ভয় পায় না। জেলে গিয়ে শেখ হাসিনা নতুন কোন উদাহরন সৃষ্টি করেননি। তবে তিনি কেন জেলে গেলেন সে স¤¦ন্ধে আমার দুটি গল্পের কথা মনে হয়েছে। শুনুন তাহলে :


প্রথম গল্পটি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের মৃত্যু স¤¦ন্ধে। বাবরের প্রানপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনের একবার খুব অসুখ হল। হেকিম-কবিরাজেরা আশা ছেড়ে দিল। তখন বাবর হুমায়ুনের শয্যাপাশে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়লেন এবং আল্লার কাছে মুনাজাত করলেন এই বলে যে আল্লাহ যেন তাঁর পুত্রের জানের পরিবর্তে তাঁর জানটা গ্রহন করেন। মুনাজাত শেষে বাবর সাতবার হুমায়ুনের শয্যা প্রদক্ষিন করলেন। গল্পে আছে, আল্লাহ তাঁর প্রর্থনা কবুল করেছিলেন। হুমায়ুন ধীরে ধীরে সেরে উঠেন আর বাবর রোগাক্রান্ত হয়ে একদিন মৃত্যু বরণ করলেন।


১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের কালো রাতে স্বাধীন বাঙালির শত্র“রা কতিপয় বিশ্বাসঘাতক বাঙালি সেনাপতি ও সৈন্যের মাধ্যমে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে এবং জেলখানায় বন্দী অবস্থায় আওয়ামি লীগের চারজন শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রটির দখল নিয়ে এটিকে অঘোষিতভাবে আবার বৃটিশের ঔরসজাত পাকিস্তান বানিয়ে দেয়। সেই থেকে অদ্যাবধি দখলদার শক্তিটির কাছে নির্লজ্য ভাবে আত্বসমর্পিত, চরিত্রহীন নব্য বাঙালী মধ্যবিত্তের সীমাহীন লোভ, অযোগ্যতা ও সংগ্রামবিমুখতার কারনে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামি লীগকে জাগিয়ে তুলতে পারছিলেন না। তাই তিনি সম্রাট বাবরের প্রদর্শিত পথে আওয়ামি লীগের সমস্ত রোগ নিজের উপর টেনে নিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর পথে চলে গেলেন। এখন আমরা অবশ্যই দেখব তাঁর জানের বিনিময়ে আওয়ামি লীগের জান ফিরে এসেছে; পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যাকে গ্রাস করার শক্তি নিয়ে একাত্তরের আওয়ামি লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে।


শেখ হাসিনার জেলে যাবার তা
ক্ষনিক ফল কি হয়েছে এবার সে সম্বন্ধে ডঃ নূরুন নবীর ইতিহাসময় অসাধারন আত্বজীবনী ' জন্মেছি এই বাংলায় ' থেকে একটি গল্প তুলে ধরছি। শোষণ ও বঞ্চনাময় দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত সত্বেও সুখে-দুঃখে অসামপ্রদায়িক বাঙালির জীবন কেমন করে কাটত তারই একটি সত্য কাহিনী 'বড়শি ডাক্তার'।


'' আমাদের এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাতে-গোনা কয়েকজন ডাক্তার ছিল। থানা সদর গোপালপুরে নজিবর রহমান নামে একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছাড়া বাকি সবাই এল এম এফ এবং হাতুড়ে। এ ছাড়াও ছিল দু'একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। অসুখে মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হত না বলে দরিদ্র মানুষদের সামান্য অসুখ গুরুতর হয়ে ওরা মারা যেত। এ সুযোগে চিকিৎসা বিদ্যা ছাড়াই অনেকে ডাক্তারি করত।


জামাতৈল গ্রামের সামান্য লেখাপড়া জানা এক হিন্দু ভদ্রলোক নাটক ও খেলাধূলা করে দিন কাটাতেন। একদিন তিনি রাতারাতি ডাক্তার বনে গেলেন। মাথায় খাকি রঙের হ্যাট, পরনে প্যান্ট, সাইকেলে ঔষধের ব্যাগ বেঁধে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখা ছাড়াও নিজ বাড়িতে রোগী দেখতেন। ....... তাঁর বড়শি ডাক্তার হবার ঘটনাটি আমাদের গ্রামে ঘটেছিল। দরগাবাড়ির এক গরীব কৃষকের বউ সন্তানসম্ভবা। তার প্রসববেদন চলছে কয়েকদিন ধরে কিন্তু সন্তান বের হচ্ছেনা। মহিলা চিৎকার করেই চলেছেন। সারা গ্রামে এটি একটি চিন্তার বিষয়। গ্রামের মুরব্বিস্থানীয় মহিলারা নিশ্চিত করে বলছেন সন্তান পেটের ভিতর মরে আছে কারন তার পেট ফুলতে আরম্ভ করেছে।


জামাতৈল গ্রামের ডাক্তার বাবুকে ডাকা হল। মহিলাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন মহিলার সন্তান জীবীত নেই। মাকে বাঁচাতে হলে মরা-সন্তান বের করতে হবে। তিনি সার্জন নন; তবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কিন্তু কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ। সাফল্যের কোন নিশ্চয়তা নেই; এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন। দায়দায়িত্ব থেকে নিস্কৃতি পেলে তিনি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এ ছাড়া উপায় না থাকায় রোগীর মৃত্যুর দায়দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়। গ্রামের মুরব্বিরা সাক্ষী হিসাবে সই করেন।


ডাক্তারবাবু অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁর ব্যাগ থেকে মাছ ধরার একটি বড় বড়শি বের করলেন। প্রায় তিন ইঞ্চি ল¤¦া কালো লোহার বড়শিটি গরম পানিতে কয়েক মিনিট ফুটিয়ে নিলেন। মৃত বাচ্চাটির স্কন্ধের হাড়ে বড়শিটি লাগিয়ে ধীরে ধীরে টেনে ওটাকে বের করলেন। মহিলাটি ব্যথায় চিৎকার করতে করতে একসময় সজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন কিন্তু বেঁচে যান''।


এ প্রত্য
পন্নমতিতাসম্পন্ন ডাক্তারকে নিজ বাড়িতে গুলি করে ডাকাতেরা হত্যা করেছিল।


স্বাধিনতার স্বপ্নের মৃত সন্তান গর্ভে নিয়ে গত ৩২ বছর বাংলাদেশ আকাশ-বাতাস মথিত করে অবিরাম চি
কার করে যাচ্ছিল। জীবীত, মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এ যন্ত্রনা সহ্য হচ্ছিল না। 'বড়শি ডাক্তার' হাসিনা মৃত-স্বপ্নকে জঠর থেকে বের করে দিয়ে বাংলা-মাকে বাঁচিয়ে দিলেন।


দেশের সরকার তাঁকে এখন জেলে দিয়েছে।

 


 বেলাল বেগ, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক।