অসমাপ্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ডাক
বেলাল বেগ

ছত্রিশ বছর পরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জীবিত সকল অধিনায়ক নিজেদেরকে একটি সংস্থায় সঙ্ঘবদ্ধ করেছেনযে পরিবেশ পরিস্থিতিতে তাঁরা এ সংগঠনটি গড়লেন এবং সংগে সংগেই তা চালু করলেন, তার গুরুত্ব ও তাপর্য উপলদ্ধী করা প্রত্যেক বাংলাদেশীর জন্য অপরিহার্য

বাঙালী আড়াই হাজার বছরের একটি প্রাচীন জাতি প্রাণের বিবর্তনের মত এর বিকাশ ঘটেছে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙালীর মাঝে আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রকাশ দেখা যেতে থাকেএর শক্তি ও সম্ভাবনা দেখে দখলদার  বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভীত হয়ে পড়েছিল বাঙালীকে দূর্বল করার জন্য তারা ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতা উসকে দিতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সুবায়ে বাঙালা বা বঙ্গদেশের মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটিকে সামপ্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে অঙ্গীভূত করে দেয়নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে 'বাঙালী' হিসাবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেলে, নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের জন্য বাঙালীকে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এত সংগ্রাম ও রক্ত বিসর্জনের প্রয়োজন হত নাযাইহোক, বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অকুতোভয় নেতৃত্বে বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বাধিনতা সংগ্রামের উস ও প্রেরণা 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ' একাত্তরে এসে চূড়ান্ত পূর্ণতা লাভ করে একারনেই একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর জাতিস্বত্ত্বাকে অতি উচ্চ মর্যাদায় মানবসভ্যতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেএ যুদ্ধই বাঙালীকে তার নিজস্ব সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত এনে দিয়েছেএ যুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে এগারজন মহাবীরের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁদের দেশপ্রেম মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়েও শক্তিশালী ছিল, শত্রহনন হিংস্রতায় ও ক্ষিপ্রতায় সিংহের চেয়েও তীক্ষè ছিল তাঁদের পঞ্চেন্দ্রিয় চারপাশে যুদ্ধের ধ্বংস ও বিভীষিকার মাঝে তাঁরা ছিলেন শ্যান-চোখ, ধীর-স্থির, অবিস্ফোরিত বোমার মত শান্ত ও আত্ববিশ্বাসীআমাদের মহত্তম এই সন্তানদের অবিস্মরনীয় বীরত্ব ও নেতৃত্ব-লদ্ধ বিজয়ের ছত্রিশ বছর পরে আজ যেখানে কৃতজ্ঞ জাতির ভালোবাসায় রচিত সুখ-কুঞ্জকাননে তাঁদের অবস্থানের কথা, সেখানে তাঁরা নেইকেন নেই, শ্রেয়তর মেধা ও ধীশক্তির কারনে ওই কথা আমাদের চেয়ে তাঁরাই ভাল করে জানেন কারন একদিন জীবন-মৃত্যুর চরম সত্যকে হাতে নিয়েই তাঁরা মৃত্যুর সংগে পাঞ্জা লড়েছেনআমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেকক্টর কমান্ডারগন এতকাল বীরশোভন ধৈর্য ও সহিষঞুতার সাথে সবকিছু দেখে শুনে, কখনো কখনো নিজেদের হাত পুড়িয়ে, পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সৈনিক হিসাবে মাহেন্দ্রক্ষণ চিনতে তাঁরা বিন্দুমাত্রও ভুল করেন নি।  তাঁরা নীরব বজ্রের মত গর্জন করে পথে এসে দাঁড়ালেন এবং ঘোষণা করলেন- স্বাধিনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবেএ যেন স্বাধিনতা যুদ্ধের সময় কোন বিশ্বাসঘাতকের প্রতি তাঁদের হাতে ধরা অকম্পমান পিস্তলতাঁদের বার্তার ভুল ব্যখ্যা করার উপায় নেই- না সরকারের না জনগনের

একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংস ও কল্যাণ চিন্তার মধ্য দিয়ে বাঙালীর সাহস, বল-বীর্য, প্রত্যুপন্নমতিতা, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বক্ষমতার সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, প্রবল আক্রোশে বিস্ফোরিত হয়েছিলধ্বংস ও মৃত্যুর ঐ গর্জায়মান জলোচ্ছ্বাস বাঙালীর সকল কূপমন্ডুকতা, হীনমন্যতাবোধ, পরশ্রীকাতরতা, অর্থ-বিত্ত ও সামাজিক উঁচু-নীচুর ভেদবুদ্ধি, ষড়যন্ত্র-কলহপ্রিয়তা প্রভৃতি আত্ব-অবমাননাকারী চারিত্রিক বৈশিষ্টসমূহ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলসেখানে ভাস্বর হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবোধের অজর শক্তিগুলি- আত্বসন্মানসহ আত্বোপলদ্ধী, অসামপ্রদায়িক ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য ও মানবতাবোধ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সামাজিক দায়িত্ববোধ মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালীত্বের যে মহাপ্লাবন দেখা গেছে তার যে কোন স্মৃতি বর্তমানের নষ্ট সময়ে অসম্ভব বলে মনে হয় বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছে পাঁচ পাঁচ বার দূর্নীতিতে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হবার পরেও, ইচ্ছা করলে, বাঙালী এখনও পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ জাতি হবার ক্ষমতা রাখে

দুর্ভাগ্যবশতঃ, মুক্তিযুদ্ধকালে সকল স্তরের সকল বয়সী সকল বাঙালী মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখে বিজয় অর্জনে যে ইস্পাতকঠিন সংকল্প ও বহুমুখি সৃজনপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিল তার কোন সমকক্ষতা খুঁজে পাওয়া যায়নি শান্তিকালীন পুনর্গঠন ও পুনর্যাত্রা সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাঙালী তার ঐ সময়কার বাঙালিত্ব ধরে রাখতে সমর্থ হলে, আমাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক গাঁয়ে মানেনা আপনিমোড়লদের উপদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের করূণার প্রয়োজন হত না স্বাধিনতাবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহাই যে একটি জাতির জাগরন ও অগ্রগতির প্রধান শর্ত একাত্তুরের বাঙালী সেটাই দেখিয়ে দিয়েছে

একাত্তর পরবর্তী শান্তিকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় অনভিজ্ঞতাবশতঃ স্বাধীন বাঙালী তার বিজয়লদ্ধ চেতনার লক্ষ্যসমূহ হারিয়ে ফেলতে থাকেগরুর মরার প্রতীক্ষায় শকুন যেমন ওঁ পেতে থাকে, এই ক্ষনটুকুর জন্য একাত্তরের শত্ররাও সর্বশক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিলসুযোগ বুঝেই তারা সপরিবার বঙ্গবন্ধুসহু  ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেরাতের আঁধারে সংবিধান পরিবর্তন করে একাত্তরের শত্ররা বাঙালীর নতুন রাষ্ট্রটির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে এটিকে কার্যতঃ আবার ধর্মের নামে প্রতারক পাকিস্তান বানিয়ে ফেলেযে জামাতে ইসলামি ও তার অঙ্গসংগঠন রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, ছাত্র সঙ্ঘ  একাত্তরে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে বাঙালীদের হত্যা করেছে, মা-বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, বাড়ীঘর লুট করেছে, আগুনে জ¦ালিয়েছে, ওদের আবার রাষ্ট্র ও সমাজে পুনর্বসান ও ক্ষমতায়ন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পিঠে ছরিকাঘাতকারী জিয়া বাঙালীর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অজর্ননগুলিকে কেবল অর্থহীনই করে যান নি, তাঁর গৃহীত ব্যবস্থাগুলি পাকাপোক্ত করার জন্য ধর্মের ব্যটারী দিয়ে চলবে এমন একটি সিভিল-মিলিটারী দলও প্রতিষ্ঠা করে যানজামাত রাজনীতির পুনঃ প্রতিষ্ঠা তথা মুসলিম বাংলা গঠন ও তার রক্ষনের জন্য জীবনপাত করতেও মরীয়া জামাতকেই রক্ষা করার জন্যে মূলতঃ বিএনপি তৈরি করা হয়েছিল শত্রদের প্ররোচনায় স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুত্থান বিরোধী দেশী-বিদেশী যৌথশক্তি এখন অর্থ, অস্ত্র ও জনশক্তিতে এমনই বলীয়ান হয়েছে যে ওরা প্রকাশ্য বলে দিয়েছে, বাংলাদেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি; হয়েছিল পাকিস্তানের একটি সিভিল-ওয়ার অর্থা ওরা স্বাধীন বাংলাদেশের  অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসেছেওদের বিরুদ্ধে সরকার যদি কোন ব্যবস্থা না নেয় বা নিতে অক্ষম হয়, এর অর্থ দাঁড়াবে ওরা মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তি দেবারও ক্ষমতা অর্জন করেছেএমনই লগ্নে আমাদের সেক্টর কমান্ডারগন তাদের বিচারের দাবী নিয়ে জাতির সামনে উপস্থিত হয়েছেনসরকার কতৃক তাদের এ দাবী পাশ কাটিয়ে যাবার অর্থ জনগনের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবেজনগন চায় না এক- এগারর সরকার ধর্মবাজ স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষে থাকুক এবং সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারুক

আমাদের পোড়খাওয়া বীর সেনানয়কগন দেশোন্নয়নে ডঃ ইউনূস, ডঃ বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, ডঃ কামালের মত কোন বিজ্ঞ সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা বা স্বপ্নের কথা বলেন নিএমন কি নির্বাচনের কথাও বলেন নিকারন তাঁরা জানেন ১৯৭৫ সনে বাংলাদেশ যারা যারা দখল করেছে, তাদের হাত থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হয়নিগত ৩২ বছরের শাসন ও শোষনের ফলে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের জনগন আবারো তাদের স্বাধিনতাবোধ ও স্বাধিনতাস্পৃহা হারিয়ে ফেলেছেতাদের উপর জগদ্দল পাথরের মতই বসে আছে একাত্তরের পরাজিত শত্র“- জামাতে ইসলামী ও তাদের দোসরগুলি-রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, ছাত্র-শিবিরতাদের উখাত করা হলেই কেবল জনগনের রাষ্ট্র জনগনকে ফের দেয়া সম্ভব হবে নবজাগরনের এটিই একমাত্র পথ। 

আমাদের সেক্টর কমান্ডারগনের মিলিত কন্ঠস্বর জাতির কন্ঠস্বরবয়সেও তাঁরা জাতির মুরব্বী, জাতির বিবেকআজকের দিনে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি জনগনের আস্থা হারিয়েছে, যেখানে সরকারের সুস্পষ্ট ভাবমূর্তি নেই এমন কি এক এগারর স্থপতি সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করা হয়, এমন দৈন্য মাঝে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমাদের সেক্টর কমান্ডারগনই হচ্ছেন সেই কবি যাদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, '' এ দৈন্য মাঝারে কবি, স্বর্গ হতে নিয়ে এস বিশ্বাসের ছবি''এর পর 'জয় বাংলা' স্লোগানটি আর আওয়ামি লীগের একার সম্পত্তি নয়, ওটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাঙালীর শ্বাশ্বত বিজয়-নিনাদএটি অসমাপ্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অবিরাম সাইরেন


 বেলাল বেগ, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক।