রাজনীতির সংস্কার
বেলাল বেগনিউইয়র্ক ব্র“কলীনে চার্চ-মাগডোনাল্ড এলাকায় গেলেই আপনি একটি বড় হাটে এসে পড়বেন। হরেক রকম দোকানে নারী পুরুষ ক্রেতার ঠেলাঠেলি। চায়ের দোকানে ভীড়। ফুটপাতেও দোকান; সেখানেও কেনাকাটা লেগেই আছে। সন্ধ্যা নাগাদ পরিবেশটা আসল হাটের মত হয়ে দাঁড়ায়। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে প্রায় বারই পছন্দ। এ রকম আড্ডা ফেনী, সোনাইমুড়ি, সন্দীপ, বাঁশখালি যেখানেই যান না কেন, একই রকম। এমনকি আড্ডার বিষয়ও একই-পলিটিকস; পলিটিকস বলতেও একই বিষয় হাসিনা-খালেদা, আওয়ামি লীগ-বিএনপি এবং তাদের ডাকসাইটে নেতাদের কথা। আমি ১৯৯৫ সন থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত দেশ ও দেশের মানুষ দেখার জন্য সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। ১৯৯৫ সন থেকে ২০০৭ পর্যন্ত একযুগ পার হবার পরেও ঐ আড্ডার কোন হেরফের হতে দেখলাম না। সাধারন মানুষের এ আড্ডাগুলিতে আওয়ামি-বিএনপির মানুষ থাকে; অন্য কোন দলের মানুষ থাকেনা। চায়ের দোকানে আড্ডা হলে, একে অন্যকে চা খাওয়ায়, পরস্পরের নেতানেত্রী নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। কেবল ভোটের সময় এ আলাপগুলি উত্তপ্ত হয়ে উঠে; অনেক সময় তর্কাতর্কি হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এ মানুষগুলি মোট জনসংখ্যার প্রায় আশি- পঁচাশি জন। যে রাজনীতি মানুষের সমগ্র জীবনের গতি-পথ নির্ধারন করে, সমাজ-সংসার-সভ্যতার সংগে তার অস্তিত্বের সমন্বয় করে, তার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন মূল্যায়ন করে, সারা জীবন রাজনীতি করেও সাধারন মানুষ তার সন্ধান পায়না। ভোট কি, কেন দিলেন তার বিন্দুমাত্র ধারনাও তার হয়না। ফলে ভোটের
কটা দিন উত্তেজনায় গা গরম থাকলেও, ভোট শেষে যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই তারা ফিরে যায়। আগের মতই শোষণ-বঞ্চনার অভ্যস্থ খাঁচায় রাজনীতির গল্প করে সময় কাটায়। পাকিস্তানের অভিশাপ সামরিক শাসক আইউব খান এ জন্যই বলেছিলেন 'রাজনীতিবীদগন জনগনকে গরুভেড়ার মত কেবল পোলিংবুথে ঢুকায়'। যদিও ঐ একই কাজ তিনিও করেছিলেন ক্ষমতার নেশায়।
১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার, আত্বীয়স্বজন ও জেলখানায় রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকান্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাদলগুলি নিজেদের মধ্যেও ভয়ানক রক্তারক্তি করে। শান্তির সময়ে এমন অকল্পনীয় বিপুল বিশাল হত্যাকান্ড বাংলাদেশের মানুষকে বোবা বানিয়ে দিয়েছিল। কে কাকে কেন মেরে ফেলছে জনগন ঘুনাক্ষরেও জানতে না পেরে মনে মনে উদ্বিগড়ব ও আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘকাল পর্যন্ত শহর-গ্রামের মানুষ এ সকল হত্যাকান্ড নিয়ে কথা বলারই সাহস করতনা। তখন শহরে বন্দরে মানুষের মুখে এক ধরনের চাপা বেদনা লক্ষ্য করা যেত। মানুষের চিন্তাস্রোত যেন স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল, তাদের আলাপ আলোচনার তেমন কোন বিষয় ছিলনা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর জিয়া বিসমিল−াহ পালিশ দেওয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ব্র্যান্ডের চমকদার রাজনীতি বাজারে ছেড়ে দিতেই ফুলের বনে মধু নিতে অলি কূলের গুঞ্জরণ শুরু হয়ে গেল। জাতীয়তাবাদীদের হৈচৈয়ে জেগে গেল পাড়া। ওদিকে অসামপ্রদায়িক গনতন্ত্র ও মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী বিশাল জনগোষ্ঠির মানসিক আঘাতের ঘোর তখনও কাটেনি। জিয়া ও তার সেনা-আমলার দাপটে তারা আর আগের মত রাজনীতির তত্ত্বকথার কচকচানি করতে সাহস পেতনা। বহুকাল পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামি লীগ যখন একটু নড়েচড়ে উঠল, আওয়ামি লীগের আঁচলধরা পার্টিগুলিও নড়ে উঠল। আবার চারপাশে রাজনীতির আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এই সময়টাতে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের সকল শহর-বন্দর ও মফস্বল শহরগুলিতে ঘরোয়া জুয়া হিসাবে তাস খেলার ব্যাপক প্রচলন হয়। ১৯৭১ থেকে সে সময় পর্যন্ত অনবরত নরহত্যার ঘটনা মানুষের মনের গভীরে ভারী হয়ে থাকলেও তা তাসের টেবিলে চাপা পড়ে যেত। বলা চলে সে সময় তাসের ব্যাপক প্রচলন না হলে শহুরে, আধাশহুরে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ভয়ানক অবনতির আশংকা ছিল। জিয়ার পরে বাংলাদেশের আরেক দখলদার, যৌনরসিক সেনাপতি এরশাদের সময় থেকে বাংলাদেশের সমাজজীবনে ফূর্তি আনন্দের হালকা বাতাস বইতে আরম্ভ করে। এই একই সময়ে সামরিক প্রভুদের ছিটিয়ে দেয়া ভাতে তাদের রাজনীতি-বাহিনীতে হাজার হাজার সুযোগ সন্ধানীর ভীড়ভাট্টা শুরু হয়ে যায়। ততদিনে রাজনীতি তাসের আনন্দের সংগে শহর-বন্দরে হোটেলে, ক্লাবে, বাড়িতে বেডরুমে, বসারঘরে আমলারাজনীতিক, সেনাপতি, ব্যবসায়ী, যুবনেতাদের খোশগল্পের বিষয়ে পরিণত হয় ঠিক চার্চ-মাগডোনাল্ডের হাটুরেদের মত। এসব আড্ডায় সরকার পক্ষ, বিরোধী দলীয় নেতা, মন্ত্রী, এমপি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, মেজর, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার, সবাই পরস্পরের কাছ থেকে নানা ধান্ধা আদায় করে নেবার দিকে প্রধান মনোযোগ দিলেও রাজনীতির আলোচনার ছেদ পড়তনা। এভাবে রাজনীতি সাধারন মানুষের মত তাদেরও গল্পগুজবের বিষয় হয়ে পড়ে। সাধারন মানুষের মত তারাও তাদের জীবনে রাজনীতির কোন অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজে পেতনা।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ক্ষমতায় যাওয়া এবং তারপর কিছু পাওয়াটাই রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। ওদিকে কেউ পার্টির বড় দায়িত্ব নিতে চায়না কারন বড় দায়িত্বে গেলে নিজের জন্য কিছু করা কঠিন হয়ে যায়। সুতরাং পার্টি চালানোর সকল দায়িত্ব এসে পড়ে দুই গৃহবধুর ঘাড়ে। ওরা টেরও পাননি বড় বড় ধড়িবাজ নেতারা সেনাবাহিনী কতৃক নিহত তাঁদের নিকটজনের দোহাই দিয়ে কেমন করে তাঁদের ফাঁসিয়ে দিলেন ক্ষমতার ফাঁদে। বেচারা হাসিনা, খালেদা। চালাক নেতা-কর্মী, আত্বীয়স্বজনেরা যেমন তাদের মাথায় ক্ষমতার দুর্বহ বোঝা চাপিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে, তেমনি এখন বিপদে ফেলে সটকে পড়েছে। উল্টো দোষটাও ওই দুজনার ঘাড়ে স্তূপীকৃত করা হয়েছে।
' আমিত আপনার কথা শুনেই ঐ সিদ্ধান্ত দিয়েছি ' এমন কথাটি বলেই ওরা খালাস। তাহলে রাজনীতিটা দেশের কোন পর্যায়ের কোন মানুষেরা করেছে! মোদ্দা কথা যে রাজনীতি রাষ্ট্র, সমাজ ও সমাজের ব্যক্তিমানুষকে ক্রমাগত এগিয়ে নেবার কথা, সে রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে এদেশের কোথাও আর অবশিষ্ট ছিলনা। এমনকি এখনও ধূর্ত, চারদলীয় রাজনীতিক ব্যরিষ্টার মইনুল হোসেন ও জামাত-প্রিয় সেনাবাহিনী প্রধান যে রাজনৈতিক সংস্করের কথা বলেন, তারও কোন সুনির্দীষ্ট সংজ্ঞা নেই। কারন এতকাল রাজনীতি নামে যা চালু ছিল, তা ছিল নিহায়েত লুটেরা মধবিত্তের একটি লুন্ঠন পদ্ধতি যার মধ্যে তাদের জীবনও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত ছিল।
তাহলে রাজনীতির সংস্কার বলতে আমরা কি বুঝব। রাজনৈতিক সংস্কার বলতে যদি সাংগঠনিক পরিবর্তন বুঝায়, তা হবে একটি স্থুল চিন্তা। রাজনৈতিক সংস্কারের একমাত্র ফকরুদ্দীনের প্রিয়কবি, বাঙালী জাতির মানস-সরোবর রবীন্দ্রনাথ এজন্যেই বলেছিলেন ' বাধা দিলে বাধবে লড়াই '।আজকের পরিস্থিতিতে সন্মিলিত গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের মাধ্যমে মুক্তপরিবেশ উদ্ধারই রাজনৈতিক সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বেলাল বেগ, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক।