রাহুগ্রস্ত দেশের ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’
চিররঞ্জন সরকার


কোনো গণতান্ত্রিক দেশে পার্লামেন্ট কখনো মরে না। শান্তিকালীন সময়ে তো নয়ই এমনকি যুদ্ধের সময়েও না। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতিকরা আইন করেছেন ‘তিন মাসের জন্য পার্লামেন্ট থাকবে না’। বিএনপি-জামায়াত জোট ও তাদের বশংবদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই দেশে পার্লামেন্টহীন অবস্থায় ১১ই জানুয়ারির কাণ্ড ঘটে। এরপর নতুন সরকার ঘোষণা দেয়, মিডিয়াই আমাদের নতুন পার্লামেন্ট। দ্বিতীয় পার্লামেন্ট। একদা মিডিয়াকে কেবল ফোর্থ স্টেট বলা হতো। ১১ই জানুয়ারির পরে নতুন শব্দ তৈরি হলো ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’।

প্রথম পার্লামেন্টের শীর্ষ মহাজনরা কারাগারে, বিদেশে, কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, দ্বিতীয় পার্লামেন্টের অবস্থা কি? দ্রব্যমূল্যের আগুনের তাপের মধ্যে এই পার্লামেন্টের অর্থনৈতিক ভিত্তি কতটা শক্তিশালী? এক নজর তাকালেই মনে হয়, এই পার্লামেন্টের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি যেন ক্রমশ কোমায় চলে যাচ্ছে। এই চলে যাওয়াটা কত অনিবার্য, কত বড় মহতী কারণে তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু কোমায় যাচ্ছে কিনা তা-ই বড় কথা। কারণ দ্বিতীয় পার্লামেন্টের মৃত্যু ঘটলে তার বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়তে বাধ্য। এটা এমনকি একটি অরাজনৈতিক সরকারের স্থিতিশীলতা ও অস্তিত্বের সঙ্গেও সম্পর্কিত বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সিএসবি বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে ৩০০ সাংবাদিক-কর্মচারী বেকার হয়ে গেছেন। এটি বন্ধ না করেও সমাধান খোঁজা যেতো। একটি চিঠি জাল। অন্যটি তো সহি ছিল। তারপরও বড় অঙ্কের জরিমানা করে চ্যানেলটি চালু করার পক্ষে মত দেয়া যেতো। বন্ধ করা যতটা সহজ, একটি চ্যানেলের জন্ম দেয়াটা কিন্তু এর চেয়ে বেশি কঠিন। এটি বন্ধ হতে না হতেই দৈনিক আজকের কাগজ হঠাৎ করেই লে-অফ ঘোষণা করা হলো। কেবল রাজধানীতে নয়, দেশ জুড়ে পত্রিকাটির সাংবাদিক-কর্মচারীরা বেকার। জানা যাচ্ছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আজকের কাগজের প্রকাশনা অব্যাহত রাখাকে মালিকপক্ষ আর ‘যৌক্তিক’ মনে করতে পারেননি।

দৈনিক যুগান্তর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সার্কুলেশনের দৈনিক। এর মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল। বড় শিল্পপতি। দুদকে সম্পদের হিসাব দিতে এসে কারারুদ্ধ হন। এনটিভি, আরটিভি ও দৈনিক আমার দেশের মালিক মোসাদ্দেক আলী ফালু শুরুতেই কারাবন্দি হন। সেই থেকে এখানকার পুরো গোষ্ঠী মন্দাক্রান্ত। তিনটি প্রতিষ্ঠানের শ’ শ’ সাংবাদিক কর্মচারী উদ্বেগে। তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। স্পষ্ট লক্ষণ হচ্ছে, সাংবাদিকরা ভাল সুযোগ পেলে এসব প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাচ্ছেন। একই অবস্থা চ্যানেল ওয়ানে। এই প্রতিষ্ঠানের এমডি গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ওয়ান/ইলেভেনের ধারাবাহিকতায় জেলে যান।

দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া একদা বলেছিলেন, তার প্রতিষ্ঠান থেকে কারো কোনোদিন চাকরি যাবে না। সম্প্রতি ইত্তেফাকের বিপুল সংখ্যক কর্মীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক মেনে নিতে হয়েছে। পত্রিকাটির অন্যতম রূপকার আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এখন বিদেশ-বিভূঁইয়ে কাটাচ্ছেন।

দৈনিক জনকণ্ঠের মালিক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ কারাগারে যাওয়ার আগেই ভবনটিতে খরা চলছিল। জনাব খানের কারাগারে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই অবস্থা আরও প্রকট হয়। সাংবাদিক-কর্মচারীরা নিজেদের অধিকতর অনিরাপদ ও ভঙ্গুর মনে করেন। দৈনিক সমকালের কর্ণধার এ কে আজাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। তিনি যদিও কারাগারে যাননি, কিন্তু পত্রিকাটির ওপর এই তালিকাভুক্তি একটা অনিশ্চয়তার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। দৈনিক দিনকাল সঙ্কটের মধ্যেই রয়েছে। দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের মালিক জেলখানায় রয়েছেন। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের একাধিক মালিকও বিভিন্ন মামলায় আটক রয়েছেন।

সবশেষে অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই এলো ট্রান্সকম গ্র“পের মালিক লতিফুর রহমানের নাম সন্দেহগ্রস্ত দুর্নীতিবাজদের তালিকায়। যদিও এই তালিকাটি এখনও মিডিয়া নামের পার্লামেন্টের চৌহদ্দিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দুদক এই তালিকা আমলে নিচ্ছে বা আদৌ নেবে কিনা সে তথ্য জানা যায় নি। শেষের ৮০ জনের তালিকায় দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার অর্থ যোগানদাতা মীর কাশেম আলীর নামও এসেছে। এভাবে সামগ্রিক চিত্রটি বিবেচনায় নিলে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মিডিয়া পার্লামেন্ট তছনছ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। কেবল সাংবাদিকদের ওপর সরাসরি ঝড়ঝাপ্টা এখনো সেভাবে আসেনি বলেই প্রকৃত চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় পার্লমেন্টকে অন্তত স্বাভবিকভাবে চলতে দিতে হবে

দেশে যারা দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি আছেন, যারা সংস্কার চান দেশের স্বার্থে, তারা দ্বিতীয় পার্লামেন্টের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। কেননা বর্তমানের অরাজনৈতিক এই সরকারকে টিকতে হলে দ্বিতীয় পার্লামেন্ট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই সরকারের কোনো রাজনৈতিক দল নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ নিউ ইয়র্কে বলেছেন, ‘অনির্বাচিত সরকারের বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়।’ কারণ একথা বড়ই সত্য যে, সরকার মাত্রেরই ভুল করা স্বাভাবিক। একটি সরকারের সব পদক্ষেপ শতভাগ সহি-শুদ্ধ হবে তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। কিন্তু একটি দলীয় সরকার অনেক ভুল করে টিকে থাকতে পারে। কারণ তার দেশ জোড়া সংগঠন থাকে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার পাঁচ বছর ধরে লুটের রাজত্ব চালাতে পেরেছে তার বড় কারণ তার সংগঠন ছিল। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন কেয়ারটেকার সরকার গঠন ভয়ানকভাবে অসাংবিধানিক ছিল। কিন্তু তার পক্ষে সাফাই বক্তব্য দেয়ার জন্য সমাজে লোকলস্করের অভাব ছিল না। আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন কিন্তু বিএনপির পতন নিশ্চিত করতে পারেনি। তাদের ট্রাম্পকার্ডের রাজনীতি দেশব্যাপী অস্থিরতা তৈরি করলেও বিএনপিকে হটাতে পারেনি। সুতরাং সরকারের কেবল প্রশাসন থাকলে চলে না। গণসংগঠন থাকতে হয়, সমর্থন থাকতে হয়। এটা নিয়ে বিতর্ক চলে না যে, বর্তমান সরকারের কোনো গণসংগঠন নেই। আর সরকারের সমর্থনের মাত্রাও আগের মতো নেই। আগামী নির্বাচনের আগে এরকম কিছু করার পরিকল্পনা সরকারের আছে বলেও শোনা যায়নি। কিন্তু এই সরকারকে তো ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়টা ভালোয় ভালোয় পার করতে হবে। আর আপদ-বিপদ কখন কোথা থেকে কিভাবে আসে তার ঠিকুজি কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতিগ্রস্তদের যেমন বিচার হতে হবে তেমনি সংস্কার কর্মসূচিকেও স্থায়ী রূপ দিতে হবে। প্রথমটি আধাসমাপ্ত রেখে চলে গেলেও সরকারকে কেউ দুষতে পারবে না। কেবল বলটা বিচার বিভাগের কোর্টে ঠেলে দিলেই হলো।

এ মুহূর্তে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া। এই ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা অনেক সদিচ্ছা ও উত্তম বড় কিছুকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। ব্যবসায়ী মহলে ভয় ঢুকিয়ে গোড়াতেই যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে আর বের হওয়া কি সম্ভব হবে? বাজার নিয়ন্ত্রণ করে কার্যকর বা যথেষ্ট ফায়দা মিলবে বলে মনে হয় না।

এদিকে অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা কিন্তু শঙ্কিত। মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২৫ ভাগ। এটা নজিরবিহীন। তেজি বাঘের মতো তড়বড়িয়ে ছুটছিল রিয়েল এস্টেট ও মোবাইল খাত। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মন্দা এখন ঘোরতর। জিডিপিতে রিয়েল এস্টেটের একক অবদান ছিল ১৪ ভাগ। সেখানে গত বছরের তুলনায় ফ্ল্যাট বিক্রি প্রায় ৬০ ভাগ কমে গেছে। নতুন প্রকল্প কেউ হাতে নিচ্ছেন না। অনেক ক্রেতা যারা গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ফ্ল্যাট কেনার জন্য সক্রিয় চিন্তা করছিলেন বা প্রাথমিক চুক্তি করেছিলেন তারা পিছুটান দিয়েছেন। এদিকে মোবাইল খাত হঠাৎ মন্থর হয়ে পড়েছে। সিম নিবন্ধন নিয়ে কড়াকড়ি ইত্যাদি চালুর ফলে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় কম হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড অনেকটা কমে গেছে। এর পরিণতিতে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও একটা শিথিল ভাব স্পষ্ট হচ্ছে।

উন্নয়নমূলক কাজ কমে যাওয়ায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তিও কম। এর মধ্যে দুর্নীতি রোধ করার নামে সাবেক রাজনৈতিক সরকার বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ডিএফপি’র কাছ থেকে বিজ্ঞাপন কেড়ে নিয়েছিল। বাস্তবে কি দাঁড়িয়েছে? দুর্নীতি রোধ তো হয়ই নি বরং দুর্নীতি জাতীয়করণ হয়েছে। দেয়াল পত্রিকা কিংবা অদৃশ্য পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপন পাচ্ছে নানা কৌশল আর ফন্দি-ফিকিরে। প্রিন্ট মিডিয়ায় এখন যে সঙ্কট চলছে, তা চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কিছু সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাবে। এসব ব্যাপারে সরকারের উচিত দ্রুত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। তানা হলে ফোরথ স্টেটই বলি আর দ্বিতীয় পার্লামেন্টই বলি, তাকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আর এভাবে একে একে সবই যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজ কীসের ওপর নির্ভর করে কার্যকরভাবে দাঁড়াবে?