নিজভূমে পরবাসী

দিগন্ত সরকার

 

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসএবার এই দিন সোমবারে পড়েছে বলে এখানে মিছিল-মিটিং-ধিক্কারের সংখ্যা কমতাও শুনলাম কাশ্মীরে আর কোলকাতায় কোনো কোনো জায়গায় কিছু বিচ্ছিন্ন সভা আয়োজন হচ্ছেলোকে এখন আজকাল এতোটাই কেরিয়ার-সচেতন যে অফিস কামাই করে দুটো মিটিং-এ যোগ দেবার সদিচ্ছা কারো নেই তাও যদি ইস্যুটা হয় অন্যের মানবাধিকারসবাই নিজের নিজের ইস্যুতে সিদ্ধহস্ত, নিজের অধিকার সচেতন, কিন্তু অন্যের অধিকারের বিষয়ে গা নেই স্বভাবতই এখানে মানবাধিকার দিবস অলিখিত হিসাবে সরে চলে এসেছে রবিবারেতাই কাল ভাবলাম এদিকে ওদিকে একটু ঢুঁ মেরে দেখেই আসি কোথায় কি চলছে

আমাদের সাথে কাজ করে রাহুল রাজদান বলে এক কাশ্মীরী (নামে কাশ্মীরী নিজেকে ইউরোপিয়ান বলে দাবি জানিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে যেকোনো জায়গায়)যাহোক তিনি আমাদের আগেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদের মৌন মিছিলে যোগদান করার জন্যঅনেক খুঁজে পেতে গিয়ে হাজির হলাম তাদের সংস্থা রূটস ইন কাশ্মীরের (RIK) মিটিং-এএকটা বড় রাস্তার পাশে ১০-১২ জন ছেলে-মেয়ে কিছু প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেকপালে লাল ফেট্টি বাঁধা লেখা RIK রাহুল সহ আর কয়েকজন পাশে ল্যাপটপে পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেসেন্টেশন দিয়ে চলেছে কাশ্মীরে পণ্ডিতদের ওপর কিরকম কি অত্যাচার হয়েছেএকের পর এক স্তুপীকৃত লাশের বা ভাঙা দালানের ছবি আর পাশে স্থান-কালআমরা যেতে খুব খুশী হল আর অনেকবার ধরে ধন্যবাদ জানালোসাথে দিল কয়েকটা প্যামফ্লেট যাতে অসংখ্য রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো আছে কি সমস্যা তাদের কিভাবে সরকার আর জঙ্গীদের মাঝে স্যান্ডুইচহয়ে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে দিনে দিনে প্রতিবছর এই কয়েকজন পণ্ডিত মিলে হায়দ্রাবাদে রোড শো করে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাইকে জানান দিয় যান - যে তারা হায়দ্রাবাদে থাকলেও তারা আসলে কাশ্মীরী

কাশ্মীরে পণ্ডিতেরা হল আদি কাশ্মীরী কয়েক হাজার বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দাআগে বেশ কয়েক দফায় এই সম্প্রদায়ের লোকজন কাশ্মীর থেকে পাতাতাড়ি গুটিয়ে ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বাসা বেঁধেছেএখন এরা তাই সংখ্যায় খুবই কম মাত্র পাঁচ কি ছয় লাখ হবেভোটের দেশে চিরকালের মত এখানেও সংখ্যালঘুদের পাত্তা এমনিতেও কম তার ওপর যদি জায়গাটা হয় কাশ্মীরের মত Disputed১৯৮৯ সালে যখন প্রথম কাশ্মীরে সংঘর্ষ শুরু হল, তখন প্রথম আক্রান্ত হয় এই পণ্ডিতেরাইভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এদের প্রক্সি দাঁড় করিয়ে শুরু হয় জঙ্গীদের অত্যাচারমসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা শুরু হয় পণ্ডিতদের ঘরছাড়া করার আদেশশুরু হয় যাকে বলা হয় এথনিক ক্লিনসিং বছরের পর বছর সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার যে খেলা চলে এসেছে তারই আরো এক দফাএকের পর এক পণ্ডিতকে দলে দলে মারা শুরু হয় - কোথাও গলায় দড়ি দিয়ে, কোথাও গুলি করে, কখনো হাত-পা কেটে আর কখনও বা জ্যান্ত পুড়িয়েএসব লোমহর্ষক কাহিনী এখন আমাদের কাছে পুরোনো হয়ে গেছে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে শুধু উদ্বাস্তু পণ্ডিতেরা যারা কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচে আছে জম্মু আর দিল্লীর কিছু রিফিউজি ক্যাম্পে সংখ্যার খাতিরে বলে রাখা ভাল ১৯৮৯ সালের পরে কাশ্মীরে হামলায় মৃত ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার হলেন সম্প্রদায়ভুক্ত (অত্যাচার করে মারার ঘটনা প্রায় ,১০০র মত) আর রিফিউজি’-র সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের মধ্যে (সরকারি ভাবে যদিও সংখ্যাটা এক-দেড় লাখের বেশী নয়) আক্রান্ত প্রায় একশো মন্দিরের মধ্যে অনেকগুলোই এখন পরিত্যক্ত জংগীদের ঠেলায় কাশ্মীর উপত্যকার শতকরা নব্বই থেকে পচানব্বই ভাগই এখন থাকেন জম্মু আর দিল্লীর ক্যাম্পে ত্রিপলের তাঁবুতে

আরো মজার কথা, যারা ছিলেন এই গণহত্যার দায়িত্বে, তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন গণহত্যার কথাযেমন ধরা যাক ইয়াসিন মালিক বা বিট্টা কারাটের (ফারুক আহমেদ দার) কথাএরা গণহত্যার পরে এখন হিরোহয়ে বেঁচে আছেনকাল বিট্টা কারাটে ইন্টারভিউ দেখলাম ইউটিউবেশান্ত গলায় সে দাবী জানাল সে বিশ জনকে মেরেছে আর তার জন্য সে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ফাঁসির সাজা আশা করছে (২০০৬ সালে ছাড়া পেয়েছে ফারুক, এখনো কাশ্মীরে আছে) বিবিসির সাথে ইন্টারভিউতে একইভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন ইয়াসিন মালিকও কিন্তু এদের বিচারের ব্যবস্থা নেই যেমন নেই গুজরাটে দাঙ্গাকারীদেরও

কালরাতে বাড়ি ফিরে আরো একটু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা ভারতের নিজভূমে পরবাসীদের (Internally Displaced People) মাত্র অর্ধেকবাকি অর্ধেকের মধ্যে আছে আসামের সাঁওতালরা যাদের এককালে আসামে এনেছিল ব্রিটিশেরা চা বাগানে কাজ করানোর জন্যআছে গুজরাটি দাঙ্গাপীড়িতরা, মিজোরামের উপজাতিরা যারা আশ্রয় নিয়েছে ত্রিপুরাতে আর মাওবাদী হামলায় ঘরছাড়া গ্রামবাসীরাএর সাথে শুরু হচ্ছে কর্পোরেট ডিসপ্লেসমেন্ট মানে শিল্পের জন্য জমি নিতে গিয়ে উচ্ছেদ কম করেও ছয় লাখ লোক আছেন এই নিজভূমে পরবাসীদের দলেদিন যাচ্ছে, কারোর দেশে ফেরার কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না সরকার পুনর্বাসনের জন্য কথাবার্তা চালাচ্ছেমাঝে মাঝে মনে হয়, আদিম মানুষেরা নিজের জায়গায় থাকার অধিকারটা অন্তত নিশ্চিত করেছিলআমরা অনেক এগিয়ে গিয়ে কি সেই পুরোনো অধিকারটাই হারিয়ে ফেলছি? তবে ওই অন্যের মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ? তাই আজ আমিও আবার পুরোপুরি কাজে ডুবে গেছি স্বার্থপরতা জিন্দাবাদ!!

পুনশ্চ - অশোক পণ্ডিতের একটি তথ্যচিত্র ইউটিউবে দেখতে পারেন কাশ্মীরী পণ্ডিতদের নিয়ে - প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড