আইন্সটাইনের চিঠি
দিগন্ত সরকারআমি আগে আইন্সটাইনের ধর্মচিন্তা নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধ অনুবাদ করেছিলাম। একটা ব্যাপার তা থেকে পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল যে আইন্সটাইন অনেক কথাতেই ধর্ম বা ঈশ্বরের কথা উল্লেখ করলেও তিনি ধর্ম হিসাবে প্রচলিত বিশ্বাসকে মানতেন না। উনি বরং এক মহাজাগতিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।
এহেন চিন্তাধারার একটি চিঠি সম্প্রতি প্রায় রেকর্ড দামে নিলামে বিক্রি হল। এমনটা যে হবে তা কিন্তু সবাই আশা করেন নি। নিলাম আয়োজনকারী সংস্থা এর মূল্য অনুমান করেছিল মাত্র ছয় থেকে আট হাজার পাউন্ডের মধ্যে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে তাদের টনক নড়ে। শেষ অবধি নিলামে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে ১১টি টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করতে হয়। চিঠিটির দাম ওঠে ১ লাখ সত্তর হাজার পাউন্ড আর সব খরচা মিলিয়ে নিলাম-বিজয়ী ক্রেতা ২ লাখ-এর কিছু বেশী পাউন্ড খরচা করেন এই চিঠিকে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আনতে। এই মূল্য এর আগে তার স্ত্রীকে লেখা আইন্সটাইনের ৫৩টি চিঠির নিলামে ওঠা দামের চেয়ে কিছু কম হলেও এটিই তার এককভাবে বিক্রিত সর্বাধিক মূল্যের চিঠি।
কি ছিল সেই চিঠিতে? ১৯৫৪ সালে এরিক গাটকিন্ডকে লেখা এই ব্যক্তিগত চিঠির কিছু অংশে তার ধর্মচিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। গার্ডিয়ানের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেল চিঠির কিছু অনূদিত অংশ। মূল চিঠিটি জার্মান ভাষায় লেখা ও তা থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন জোয়ান স্ট্যামবাগ। ধর্ম-বিজ্ঞান সংক্রান্ত অংশটুকু বাংলায় অনুবাদ করলাম নিচে -
উদ্ধৃতি
"ঈশ্বর শব্দটি আমাকে মানুষের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই মনে করায় না। বাইবেল আসলে অনেকগুলো সম্মানিত অথচ ছেলেভোলানো গল্পের একটা সংকলন ছাড়া কিছুই না। নতুন করে তার মানে অনুসন্ধান করে আমার এই ধারণায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এইসব নতুন করে খুঁজে বের করা অনুবাদগুলোর সাথে মূল বক্তব্যের কোনো যোগসূত্রই নেই। আমার কাছে প্রচলিত অন্য সব ধর্মের মত ইহুদী ধর্মও এরকম কিছু শিশুসুলভ কুসংষ্কারের সম্মিলিত রূপ। আমি নিজে ইহুদী হওয়া সত্ত্বেও বলতে পারি যে ইহুদীদের সাথে অন্য ধর্মের আরো দশজন মানুষের কোনো তফাৎ নেই। আমি মোটেও ইহুদী জনগোষ্ঠীকে ঈশ্বরের বাছাই করা কোনো গোষ্ঠী বলে মনে করি না।
সাধারণভাবে আমি মানুষ হিসাবে আর ইহুদী হিসাবে আমার দুই আলাদা গর্বের স্তম্ভের মধ্যে যোগসাধন করতে যথেষ্ঠ যন্ত্রণাবোধ করি - কারণ এদের মধ্যে এক সুউচ্চ প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ হিসাবে আমি যেমন কার্যকারণ সূত্রের সন্ধানে সাধনা করি বলে গর্ববোধ করতে পারি, তেমনই ইহুদী হিসাবেও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসের কারণে গর্ববোধ করতে পারি। স্পিনোজাই হয়ত প্রথম লক্ষ্য করেন প্রাচীরের একপাশে কার্যকারণ সূত্রের এই সীমাবদ্ধতা আদপে কার্যকারণের অস্ত্বিত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই না। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে 'জীবন্ত' ধরে নেবার প্রচেষ্টা ঈশ্বরের মেরুকরণের মাধ্যমেও সৃষ্ট একেশ্বরবাদেও দূর করা যায় নি। এই দুই (কার্যকারণ আর ঈশ্বর) বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনার মাঝে এক কৃত্রিম প্রাচীর দাঁড় করিয়ে আমরা নিজেদের বোকা বানাই অথচ আমাদের নৈতিকতাবোধও এর মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয় না।"
দিগন্ত সরকার, কম্পিউটার প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞান লেখক।