অথঃ বিড়ালং সমাচারেৎ
দিলরুবা সুলতানা
প্রাচীন ভারতের এক বিখ্যাত রাজনীতিবিশারদ ছিলেন চানক্য পন্ডিত। আরেক নাম কৌটিল্য। কৌটিল্য হতেই কুটিল শব্দটির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও তিনি ছিলেন সুপন্ডিত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতের একটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ। এই প্রাচীন মনীষির প্রতি সম্মান জানাতেই নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র এলাকার নাম চানক্যপুরি রাখা হয়েছে। তবে চানক্যদেব যতো বড়ো রাজনীতি কিংবা অর্থনীতিবিশারদই হোন না কেন, প্রাচীন সমতট তথা অধুনা বাংলাদেশের আর্থরাজনৈতিক সিষ্টেম অবলোকন করলে তিনি যে তার সুত্রসমুহ নুতন করে লিখতেন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। চানক্যীয় রাজনীতির সুত্র অনুসারে যখন রাজনীতির ময়দানে সুনসান নীরবতা বিরাজ করার কথা- বাংলাদেশের মাটিতে এসে তা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। অনুরুপে চানক্যীয় অর্থনীতির সুত্র অনুসারে যখন জিনিসপত্রের দাম কমার কথা, তখন চড়চড় করে তা আকাশে যেয়ে ঠেকে ! গুটিকয়েক সাম্প্রতিক উদাহরণ নিন।
১- চানক্যের সরল সুত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের সমস্ত অঘটনের পেছনে আছে আওয়ামী লীগের কালো হাত। বস্তুতঃ বাংলাদেশ নামক অঘটনটির পেছনেও আছে আওয়ামী লীগ। ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকারের ডার্লিং নিজামি সাহেব পষ্ট করেই বললেন সে কথা। ২২শে সেপ্টেম্বার (২০০৭) বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন- ‘একাত্তরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ ইসলামের বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছিল। চুয়াত্তরে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত করে স্পষ্ট করেছিল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থান। এবার ধর্মভিত্তিক দলগুলিকে নিবন্ধন না দেয়ার দাবী করে পুনরায় ইসলামের বিরুদ্ধে তার অবস্থান আরও স্পষ্ট করেছে’। অর্থাৎ জামাতই হচ্ছে ইসলাম এবং ইসলাম হচ্ছে জামাত। নিজামি সাহেবের এই আদর্শ ধারণ করেই হয়তো উদ্দিন সরকার প্রথম খেপেই আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনা এবং তার প্রধান প্রধান সাঙ্গপাঙ্গদেরকে খাঁচায় পুরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন- চানক্য পন্ডিতের থিওরী মোতাবেক ইসলাম একেবারেই নিরাপদ এখন। কিন্তু রাত না পেরুতেই চানক্য-থিওরী আবার হোচট খেল। সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুনসান রাজধানী তথা সারাদেশে আগুন জ্বলে উঠলো। প্রবল প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে দেখা গেল হ্যাট ফেলে এমন দৌড় দৌড়াতে যার সাথে তুলনা চলে একমাত্র জোট এমপি সালাহউদ্দিনের সেই বিখ্যাত ম্যরাথন রেসের। বিবিসি’র খবরে হেডলাইনের মর্য্যাদা পেল সে দৌড়-। পলায়নরত সেনাসদস্য, তার পেছনে ফ্লাইং কিক্ প্র্যাক্টিসরত এক সিভিলিয়ানের ছবি। বিশ্বের কোথাও এমন চিত্র ইতিপুর্বে দেখা গেছে কিনা আমার জানা নেই। তবে বড়ো সরস মন্তব্য করেছিল বিবিসি- If a single image can sum up the thorny mess into which Bangladesh has once again stumbled, then this is perhaps this”. (যে জটিল সমস্যার আবর্তে বাংলাদেশ পুনর্বার নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে, তার চিত্র যদি একটিমাত্র ছবিতে বাক্সময় করে তোলা যায়- তবে এটিই সম্ভবত সেই ছবি)। ভাগ্যিস শেখ হাসিনা এবং তার অধিকাংশ লেফটেন্যান্ট আগে থেকেই জেলে ছিলেন। বাইরে থাকলে তাকে হয়তোবা ডাবল ফাঁসিতে লটকাতো উদ্দিন সরকার। তাকে হাতের কাছে না পেয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ধরে মনের খেদ কিছুটা হলেও মেটানো গেছে।
২- ছাত্র আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক গ্যাঞ্জাম। এবারকার ইস্যু টোকাইর কোলে একটা নিরীহ দর্শন বিড়াল। চানক্য থিওরী অনুসারে অকারণে লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল করার ট্র্যাডিশন ধারণ করে শুধুমাত্র আম্লীগ ও তার সমমনা দলগুলি। কিন্তু এবারও চানক্য থিওরী ভন্ডুল করে আওয়ামী দুবৃত্তদের পরিবর্তে মিছিল করেছে ডার্লিং নিজামির ভাবানুসারী তথাকথিত আলেম সম্প্রদায় ! দুর্ভাগ্যক্রমে মিছিল করার ছুতোটাও তৈরী করে দিয়েছে ঘোরতর আওয়ামী বিরোধী বলে পরিচিত মতিউর রহমান ও তার প্রথম আলো। ভাগ্যের ফের আর কাকে বলে? খোদ্ চানক্য পন্ডিতও কি কল্পনা করতে পারতেন যে বিপ্লবী মতিউর রহমান হাত জোর করে আলেম ওলামাদের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করছে? ক্ষমাভিক্ষা করছে এমন একটা কল্পিত অপরাধের জন্যে যার কোনই ভিত্তি নেই। যে কার্টুনটি প্রকাশের জন্যে মতিউর রহমানকে হাত জোর করে ক্ষমা চাইতে হলো সেটি উকিলদের ভাষায় যাকে বলে একেবারেই মেরিটলেস। ইসলাম ধ্বংস কিংবা রাসুলের চরিত্রহনন দুরে থাক, তার ধারে কাছেও নেই। ইন্টারনেট পাঠকমাত্রই জানেন, হুবহু একই ধরণের কার্টুন খোদ জামাতি ম্যাগাজিন কিশোর কন্ঠে বেরিয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তখন যদি ইসলাম ধ্বংস না হয়ে থাকে, এবার কী করে হয়? ‘মহম্মদ কদু’ লিখলে যদি মহম্মদের চরিত্রহনন না হয় তা হলে ‘মহম্মদ বিড়াল’ লিখলেই চরিত্রের বারটা বেজে যায়! আমাদের প্রিয় নবীর চরিত্র কি এতই ঠুনকো যে দু’চরজন সালমান রুশদী কিংবা তসলিমা নাসরিনের কলমের আঘাতও সহ্য করতে পারে না তা? কই, খৃষ্টানদের নবী যীশুর চরিত্র তো এতো ঠুনকো নয়। পশ্চিমের খৃষ্টান মূল্লুকে হরহামেশা যীশুকে নিয়ে হাজারটা ব্যঙ্গ কার্টুন বেরুচ্ছে, এমনকি সিনেমা পর্য্যন্ত বেরিয়েছে। (১৯৮৮ সালে Martin Scorsese নির্মিত ‘দ্য লাষ্ট টেমটেশন অব ক্রাইষ্ট’ The Last Temtation of Christ স্মর্তব্য)। ধর্মপ্রাণ খৃষ্টানরা এই ছবির নিন্দা জানিয়ে পত্রিকায় কলাম লিখেছে, কিন্তু আমাদের দেশের মোল্লাদের মতো উন্মাদ আচরণ কেউ দেখেছে? নাকি যীশুর ইমেজের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পেরেছে ঐসব কার্টুন, সিনেমা? যীশুর বেলায় যা ঘটতে দেখা যায় না, মহম্মদের বেলায় কেন তা দেখা যায়? মহম্মদের চরিত্র কি কাচঘরের মতোই ঠুনকো যে সামান্য আঘাতেই তা চৌচির হয়ে যাবে? প্রকৃত সত্য হলো এই যে হাজারটা রুশদি হাজারটা তসলিমার সাধ্য নেই ইসলামের নবীর ইমেজের বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধন করার। ইমেজের প্রকৃত বারটা যদি কেউ বাজিয়ে থাকে তবে তারা হলো ধর্মের লেবাসধারী ঐসব মোল্লা-মৌলবী। এইসব দোজখের প্রহরীদের কীর্তিকলাপের কারণেই সারা বিশ্বে ইসলাম আজ নিন্দিত, দেড়হাজার বছর আগে আবির্ভুত একজন আধুনিকমনস্ক মনীষির চিত্র মসীলিপ্ত। আরব মূলুকের রাজপথগুলির আনাচে কানাচে অগনিত বিড়াল আছে। রাস্তায়ই এসব বিড়ালের জন্ম, রাস্তায়ই মৃত্যু। দুপুরের প্রখর রৌদ্র থেকে গা বাচাতে এসব বিড়াল প্রায়ই পার্ক করা গাড়ীর নীচে শুয়ে থাকে। মালিক এসে গাড়ী ষ্টার্ট দিবে, বিড়াল নড়ছে না। মালিক কৌতুক করে বলছে- ‘তায়াল, ইয়া মহম্মদ, তায়াল। আলহিন মাছায়া, হাবিবাতিক ফি এন্তেজারেক’ (এসো হে মহম্মদ, বেরিয়ে এসো। সন্ধে হয়ে গেছে, তোমার প্রিয়া তোমার অপেক্ষায় আছে)। বস্তুত অচেনা যে কোন লোককেই এরা মহম্মদ বলে সম্বোধন করে। কৌতুকচ্ছলে বিড়ালকেও তাই মহম্মদ বলে ডাকছে। এই ডাক নেহায়েতই কৌতুক, এর পেছনে কেউ নবীর চরিত্রহননের চক্রান্ত আবিস্কার করে না সেদেশে। কারণ ইসলামের সুতিকাগারে আর যাই হোক আমাদের দেশের মতো ধর্মব্যবসায়ী নেই। রাজপথে কুর্দনরত একরাশ দোজখের প্রহরী নেই, ধর্ম বিক্রি করাই যাদের একমাত্র উপজীবিকা।
এই বিড়াল নাটকের আরেকটি দিক আছে। অত্যন্ত চাতুর্য্যরে সাথে নাটকটি মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরিচালক আইনমন্ত্রী জনাব মইনুল হোসেন টিভি ক্যমেরায় পোজ দিয়েছেন ঠিক, তবে প্রযোজকবৃন্দ পর্দার আড়ালেই রয়ে গেলেন। নাটকটির কল্যানে খতিব জনাব ওবায়দুল হক, ‘আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগান’ এই বিখ্যাত শ্লোগানের উদ্গাতা হুজি নেতা (কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য) জনাব ফজলুল হক আমিনী, আরেক হুজি নেতা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান বাংলাদেশের ইসলামী শক্তির একমেবাদ্বিতীয়ম গার্ডিয়ানরুপে স্বীকৃতি পেয়ে গেলেন। নিন্দুকেরা বলে আসছেন- উদ্দিন সরকারের মিশন হচ্ছে যে কোন উপায়ে আরও পাঁচ বছরের জন্যে জামাতকে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা। বিগত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে জামাত তার শিকড় গাড়তে সমর্থ হয়েছে। আর বছর পাঁচেক সময় পেলে শারিয়া আইন প্রবর্তন করার মিশনে তারা এমন জায়গায় পৌছবে যেখান থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। সীমাহীন দূর্ণীতির কারণে বিএনপি’র গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শুন্যের কোঠায়। তাদের আবার ক্ষমতাসীন করা প্রায় অসম্ভব ব্যপার। সিভিল সোসাইটি নামধারী এক দঙ্গল ক্লাউনের কাঁধে সোয়ার করে জামাতকে আবারও ক্ষমতাসীন করা অসম্ভব কোন মিশন নয়। আওয়ামী লীগ- বিএনপি বিহীন মাঠে যেসব খেলোয়ার থাকবে (যেমন ডঃ কামাল, ব.দ. চৌধুরি, ফেরদৌস কোরেশী, ভঙ্গবীর ইত্যাদি), তাদের মধ্যে একমাত্র জামাতেরই থাকবে গোল করার ক্ষমতা। বিশ জনের ক্যাবিনেটে যদি তিন জন জামাতও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে- কেল্লা ফতে। এ জন্যেই বিগত পাঁচ বছরের দূর্ণীতির সমস্ত অপবাদ কাঁধে নিয়ে ম্যাডাম জিয়াকে সপুত্রক জেলে যেতে হয়, কিন্তু পাঁচ বছর ধরে সমস্ত কুকীর্তির ভাগীদার নিজামি-মুজাহিদিরা অক্ষত থাকে। জরুরী আইন ভঙ্গের দায়ে ইউনিভার্সিটির সম্মানিত শিক্ষকদের ভাগ্যে জুটে পুলিশি রিমান্ড ও হাজতবাস। পক্ষান্তরে জরুরী আইন ভঙ্গ করেও খতিব-আমিনী-মুহিউদ্দিনরা হয়ে যায় পীরানে পীর দস্তগীর। তাদের সামনে বিনা কারণে একটি প্রথম শ্রেণীর সম্পাদককে করজোর হতে হয়, একজন প্রতিশ্র“তিশীল তরুন কার্টুনিষ্টের কপালে জোটে হাজতবাস। কাদিয়ানীরা একটি নিরীহ ধর্মসম্প্রদায়। বিগত পাঁচ বছর ধরে তাদের বিরুদ্ধে যে সহিংস আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, সেই আন্দোলনের নায়ক মাওলানা মমতাজি, মাওলানা নুরানি তাদের বিরুদ্ধে কী এ্যাকশন নিয়েছে এই সরকার?
সুতরাং সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ। ধৈয্য ধরে আর কয়েকটা মাস অপেক্ষা করুন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ব্যাক্ড এই সরকার অভিনীত নাটকের দুই-তৃতীয়াংশ প্রায় সমাপ্তির পথে। আড়াই শ’র মতো লোককে রাজনৈতিক নির্বাসনের নীল-নক্সা প্রায় চুড়ান্ত। ফিল্ডে থাকবে কিছু হিজড়া রানীতিবিদ ও জামাত। তার পরই শুরু হবে নাটকের ফাইনাল পর্ব। এমন একটা নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ হবে বিশ্ববাসী আজও যা প্রত্যক্ষ করেনি। আপনারা পাবেন খাটি শরীয়তভিত্তিক একটি রাষ্ট্র, আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন।
বাংলাদেশী মুসলমানদের এর চেয়ে বেশী আর কী চাওয়ার আছে, পাওয়ার আছে? একটাই শুধু ভয়। চানক্য পন্ডিতও যা প্রেডিক্ট করতে পারেনি সেই আপাত সুপ্ত জনগোষ্ঠির আনপ্রেডিক্টেবল ক্রোধবহ্নি। ঢাকা ভার্সিটির একটি তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে যা বিসুভিয়সের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। কোন্ ছিদ্র দিয়ে আবার না তা জ্বলে উঠে সাজানো বাগান তছনছ করে দেয়। ডান্ডা মেরে কি তা ঠান্ডা করা যাবে?
লেবানন- বৈরুত ২৫-০৯-২০০৭ e-mail: [email protected]