শিক্ষা-যুক্তি-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি বিষয়ক ষাণ্মাসিক পত্রিকা
‘শিক্ষা, যুক্তি, বিজ্ঞান, মানবতা হোক আমাদের আলোকবর্তিকা’ এ স্লোগান ও আশাবাদকে চেতনায় লালন করে প্রকাশিত হয়েছে ষাণ্মাসিক পত্রিকা মুক্তান্বেষা। শুধু আক্ষরিক অর্থেই নয়, প্রকৃত অর্থেই মুক্তান্বেষা একটি ব্যতিত্রক্রমী পত্রিকা। ফরিদ আহমেদের ‘মার্গারেট মিড : নৃতত্ত্বের রাণী’ রচনাটি পত্রিকাটির প্রবেশ গদ্য। মার্গারেট মিড নারীবাদের প্রবক্তা না হলেও তিনি ছিলেন প্রারম্ভিক নারীবাদীদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমান, অতীত, এমনকি তার সমসাময়িক অনেক নারীবাদীর সঙ্গে ছিল সুস্পষ্ট মতানৈক্য। প্রচলিত নারীবাদের একটি প্রচলিত ধারা বা ধারণা হলো নরবিদ্বেষী মনোভাব ও কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করা। মর্গারেট মিড এ ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সমাজের লৈঙ্গিক ভূমিকা পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। ফরিদ আহমেদ নারীবাদের পরিকাঠামোর সঙ্গে রিডের নৃতাত্ত্বিক ধারণার তুলনা করেছেন চমৎকারভাবে। পরের গদ্যটি ‘পল কার্জ’-এর ‘কেন আমি সংশয়বাদী’। অনুবাদ করেছেন জাহেদ আহমদ ও অভিজিৎ রায়। বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে সংশয়ের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে লেখক দেখিয়েছেন সংশয়বাদীদের ঈশ্বর সংক্রান্ত মনোভাব। দেখিয়েছেন মৌলবাদীদের সম্পর্ক। অজয় রায় লিখেছেন ‘ভৌত বাস্তবতাঃ আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ’ নামে গদ্য। আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের কথোপকথন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমেই তিনি আলোচনা করেছেন আইনস্টাইনের ‘ভৌত বাস্তবতার তত্ত্ব নিয়ে’। আলোচনা করেছেন ভৌত বাস্তবতার প্রকৃতি, আইনস্টাইনের মৌলিকনীতি, স্থূল জগৎ ও আণুবীক্ষণিক জগতের দ্বন্দ্ব নিয়ে। রবিঠাকুর সম্পর্কে আইনস্টাইনের বক্তব্য কী ছিল এবং আইনস্টাইন সম্পর্কে রবিঠাকুরের কী ধারণা ছিল, সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি। তারপর পাওয়া যায় কাঙ্খিত কথোপকথন। ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাায় দার্শনিক সংকট’ শিরোনামে গদ্য লিখেছেন আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া। এতে তিনি দেখিয়েছেন শিক্ষার সঙ্গে কতিপয় প্রয়োজনীয় উপকরণের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। দর্শন, শিক্ষা পদ্ধতি, রাজনীতি, সস্ত্রাাস ও মূল্যবোধ, ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা, মানুষের আত্মবিশ্বাস প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কী এবং সম্পর্কটি কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে তিনি চমৎকার লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষা একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাা। শিক্ষা দর্শন হলো সেই ব্যবস্থার এক ধরনের আদর্শিক নির্দেশনা।’ ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অজয় রায়। কথায় কথায় উঠে এসেছে তার শিল্পী জীবনের কথা, ছোটবেলার কথা, শিক্ষা জীবনের কথা, সংগ্রামী জীবনের কথা। উঠে এসেছে একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি। শেষে ছাপা হয়েছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে লেখা অম্লান দত্তের অনেকটি চিঠি। কানসাট বিদ্রোহ নিয়ে লিখেছেন সাইফুর রহমান তপন। কবিতা লিখেছেন হোসাইন কবির। অভিজিৎ রায়ের ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করেছেন বিনয় বর্মণ।আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে পশ্চাৎপদতার বহু ছাপ। বহুবিধ কারণই এর জন্য দায়ী। রুদ্ধচিন্তা, অন্ধবিশ্বাস, প্রশ্নহীন আনুগত্য, ধর্মীয় কুসংস্কার, অর্থহীন প্রথা পালনে দ্ব্যর্থহীনতা, প্রশ্নহীন মানবিকতা, বিজ্ঞান বিষয়ে দারুণ অজ্ঞতা প্রভৃতি কারণে আমরা সাংস্কৃতিক-প্রতিবন্ধী। আলোকোজ্জ্বল পথ বিনির্মাণের জন্য আমাদের প্রয়োজন নিরাবেগ যুক্তি, বিজ্ঞানমনস্কতা, গভীর বিশ্লেষণ, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তার আলোকপাত; তবেই না রচিত হবে সুন্দর আগামী এবং আগামীর মানুষ। একটি পত্রিকা উল্লিখিত ব্যাপারগুলোর দায় একাই বহন করার ক্ষমতা রাখে না; কিন্তু উসকে দিতে পারে। ‘মুক্তান্বেষা’ সেই উসকে দেয়ার দায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। এটি কম কথা নয়।
মুক্তান্বেষা-সম্পাদক : অজয় রায়; প্রথম বর্ষ : দ্বিতীয় সংখ্যা : জানুয়ারি ২০০৮
এমরান কবির
লেখাটি দৈনিক সমকালে এপ্রিল ৪, ২০০৮ তারিখে প্রকাশিত