আকালের শব্দ শুনি

ফরিদ আহমেদ

 

বাংলাদেশে কি দুর্ভিক্ষ আসন্ন? খুব শীঘ্রই কি বড় ধরণের কোন মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা? বেশিরভাগ পত্রপত্রিকাই বেশ কিছুদিন ধরে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে বলে ক্রমাগত রিপোর্ট করে চলেছে। তবে ভাবগতিক যা দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে যে, নীরব দুর্ভিক্ষ সরব হতে খুব বেশি সময় লাগবে না বোধহয়।

দৈনিক সমকালের প্রথম পাতায় সস্তায় চাল কেনার আশায় বিডিআরের দোকানে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের বিরাট লাইন দেখে গভীর আতংকে বুক হিম হয়ে গেছে আমার। এরকম এক চরম আতংকজনক স্মৃতি স্থায়ীভাবে গেঁথে আছে আমার মগজে দীর্ঘদিন ধরে। চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষের সময় নিতান্তই বালক বয়সে স্কুল শিক্ষক বাবার সাথে চটের ব্যাগ নিয়ে রেশন দোকানের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি চিরতরে খোদাই হয়ে আছে মস্তিষ্কের নিওরনে।  আজো চোখে ভাসে অসহায় পিতার সেই হতাশাক্লিষ্ট উদ্বিগ্ন মুখখানি। এতো বছর পরে লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের চোখে মুখে সেই সুদূর শৈশবে দেখা জনকের মুখের পরিচিত অনুভূতিই যেন অবিকল দেখতে পাচ্ছি আমি। এই লাইন শুধুমাত্র বিডিআরের দোকানের সামনেই নয়। সারাদেশের স্বল্পমুল্যের সব চালের দোকানের সামনেই তৈরি হচ্ছে বড় বড় লাইন প্রতিদিন। কাক ডাকা ভোর থেকে, কোথাও কোথাও গভীর রাত থেকে মানুষজন এসে দাঁড়াচ্ছে লাইনে। সময়ের আগেই ফুরিয়ে যাচ্ছে চাল, শুধু ফুরাচ্ছে না অফুরন্ত মানুষের লাইন। 

চাল নিয়ে এই চালেসমাতি কায়কারবার শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। জলপাই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হু হু করে বেড়ে চলেছে চাল ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম। দামের পাগলা ঘোড়া বিরাট বিরাট লাফ দিয়ে চলে গেছে দরিদ্র মানুষের ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। যে কেউ কান পাতলেই এখন বাংলাদেশে শুনতে পাবেন শুধু হাহাকার আর হাহাকার। ফেরেশতা সরকার প্রথম থেকেই তার দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে এর জন্য দায়ী করে আসছেন। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাঁড়াশী আক্রমন চালানোর কারণেই নাকি বাজারে এই মন্দাভাব শুরু হয়েছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার তাই না! দুর্নীতির সময়ে যদি মানুষের পেটে ভাত থাকে, আর ফেরেশতাদের দুর্নীতিমুক্ত সময়ে যদি না খেয়ে থাকতে হয়, তাহলে তো দেখা যাচ্ছে দুর্নীতিই অনেক ভাল জিনিষ।  

বাজার নিয়ন্ত্রনের জন্য উদ্ভট সব হাস্যকর কায়কারবারও করেছে আমাদের অতি প্রিয় জলপাই বাহিনী। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাজারে হানা দিয়ে অস্ত্রের মুখে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্পমূল্যে জিনিষপত্র বিক্রি করতেও বাধ্য করেছে তারা। লেফট রাইট করা এই নির্বোধদের কে বোঝাবে যে রাজনীতি আর বাজারনীতি এক জিনিষ নয়। রাজনীতিকে অস্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা গেলেও বাজারকে করা যায় না। বাজার চলে অর্থনীতির মৌলিক সূত্র ধরে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, অচিরেই চালের দশা হয়েছে ভয়াবহ বেচাল।   

আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষের হচ্ছে সবদিক থেকেই করুন দশা। একেতো পেটে ভাত নেই তারপর আবার উচ্চপর্যায়ের লোকজনের নানান ধরনের নির্মম রসিকতার শিকার হতে হয় তাদেরকে প্রতিনিয়ত। একের পর এক লঞ্চ ডুবে অসংখ্য লোক মারা গেলে বলা হয় আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়েছেন। কলকারখানা বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয় করে দিয়ে বলা হয় কই তারাতো ভালই আছে। কেউ খারাপ আছে বলেতো আমি জানি না। এই যেমন কিছুদিন আগেই এক বিজ্ঞ উপদেষ্টা লোকজনকে আপাতত কিছুদিন কম খেয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পরে বেশি বেশি করে খেয়ে তা পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। পরে যখন সাংবাদিকরা তাকে চেপে ধরেছেন তখন তিনি বেশ হাসিমুখে বলেছেন যে, আপনারা ঠাট্টা তামাশাও বোঝেন না। আমিতো রসিকতা করেছি মাত্র। গরীব মানুষের দুর্দশা যে তাদের কাছে নির্মল রসিকতার বিষয় সেটা না বুঝেই আমরা খামোখাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম তার কথা শুনে। 

আমাদের চার তারার জেনেরেল সাহেব অবশ্য ঠাট্টা তামাশার দিকে যাননি। পুরোপুরি মারফতী রাস্তায় হেঁটেছেন তিনি। আল্লাহর দরবার থেকে কিভাবে যেন তিনি খবর পেয়েছেন যে আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করছেন। কিসের পরীক্ষা সেটা অবশ্য তিনি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে বলেননি। তার মতে সিডর দিয়ে আল্লাহ আমাদের গত বছর পরীক্ষা নিয়েছেন। সেই পরীক্ষায় লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করেছি আমরা, কেউই না খেয়ে মারা যায়নি তখন। এ বছর তার কাছে পাকা খবর আছে যে আল্লাহ আগামীতে সুন্দর দিন দেওয়ার জন্য বসে আছেন। শুধুমাত্র এই পরীক্ষাটাতে পাশ করলেই হবে। আমি অবশ্য বুঝতে পারি না আল্লাহ কেন শুধু গরীব গুর্বাদেরকেই কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলেন। বড়লোকেরা সবসময়ই কেমন করে যেন আল্লাহর পরীক্ষার হাত থেকে বেঁচে যায়। তিনি অবশ্য সেই আশায় একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে ভাতের বদলে আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। জেনারেল সাহেব নিজে ভাতের বদলে আলু খাবেন কিনা তা অবশ্য খোলাসা করে বলেননি। চার তারার জেনারেলরা কি আলু খায়? আমার অবশ্য জানা নেই। নাকি এই দাওয়াই শুধুমাত্র গরীব মানুষের জন্য?

দেশে যে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে সেটা কোনভাবেই স্বীকার করতে রাজী নন আমাদের জলপাই সরকার। খাদ্য উপদেষ্টাতো পত্রপত্রিকায় নীরব দুর্ভিক্ষ ব্যবহারের বিষয়ে রীতিমত গোস্বা করেছেন। নামের আগে ডক্টরধারী এই পন্ডিত ব্যক্তি দুর্ভিক্ষের সংজ্ঞা বিশ্লেষন করে বলেছেন যে ব্যাপকহারে  লোকজন মারা গেলেই তবেই তাকে দুর্ভিক্ষ বলে। লোকজন কি পটাপট রাস্তায় মরে পড়ে আছে নাকি? একবেলা দুবেলা নিয়মিত না খেয়ে থাকলেই তাকে দুর্ভিক্ষ বলে না। একে বলে হিডেন হাঙ্গার। এরকম একবেলা আধবেলা না খেয়ে দেশের লোক এখনই যে আছে তা নয়। আগেও এরকম না খেয়ে লোকজন থেকেছে। এটা এমন বিরাট কিছু ঘটনা না। কাজেই শুধু শুধু তাদেরকে দোষ দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য উপদেষ্টার কাছে নীরব দুর্ভিক্ষ আর হিডেন হাঙ্গার যতই আলাদা শব্দ হোক না কেন, যারা না খেয়ে আছে তাদের কাছে না খেয়ে থাকাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কঠিন সত্যি।

আকালের যে শব্দ হাঁটি হাঁটি পা পা করে এসে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের পাশে তাকে যত দ্রুত এই সরকার বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। তবে পারবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে আমার। দেশের  ঘড়িতে বারোটা বাজানোর সুমহান মিশন নিয়ে যারা মাঠে নেমেছে তারা কি আর এতো সকালেই হাল ছেড়ে দেবে? বারোটা বাজিয়ে তবেই না ছাড়বে।

মায়ামি, ফ্লোরিডা

===============================================

মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।