বানান নিয়ে বকবকানি
দিনে দিনে মুক্তমনার জনপ্রিয়তার সাথে সাথে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বাঙালিদের কাছ থেকে দারুণ দারুণ সব লেখা পাচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে মুক্ত বিহঙ্গের স্বাধীনতা থাকার কারণে নিত্য নতুন চমকপ্রদ বিষয়ের উপর অত্যন্ত সুখপাঠ্য, জ্ঞানগর্ভ ও আনন্দদায়ী লেখাতে প্রতিদিনই উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে মুক্তমনার প্রধান পাতা। এটা নিঃসন্দেহেই অত্যন্ত সুখের খবর, গর্বেরও বিষয়। প্রতিদিন হালনাগাদ করা হয় এরকম বাংলা আন্তর্জালিক পত্রিকা সংখ্যায় এতই কম যে গুণতে মনে হয় আঙুলেরও প্রয়োজন পড়বে না ।
মুক্তমনায় যে লেখাগুলো আসে তার সবগুলোই আমি অসীম আগ্রহ নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ি। মুক্তমনার বেশিরভাগ লেখকের লেখারই দারুণ ভক্ত আমি। কারো কারো লেখাতো এতো অসাধারণ, সাবলীল এবং ঝরঝরে যে পড়ার পর নিজে কি সব ছাইপাশ লিখি সেটা ভেবে রীতিমত লজ্জায় কর্ণ লতি রক্তিম হয়ে যায় আমার। মুগ্ধ আবেশে অবাক বিস্ময়ে ভাবি এত সুন্দর লেখা মানুষ লেখে কি করে। আমি হাজার মাথা কুটে গণনযন্ত্র১ ভেঙে ফেললেওতো ওরকম লেখা আমার চাবি-ফলক২ দিয়ে বের হবে না। একারণেই মাঝে মাঝে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে ফেলি যে আর লিখবো না এই সব ছাইপাশ। তবে আমার ধনুকটা অত শক্তপোক্ত নয় বলেই হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই আবারো বেহায়ার মতো টুক টুক করে আঙুল চালাই চাবি-ফলকে।
যাইহোক, এই লেখার বিষয়বস্তু কিন্তু কার লেখার মান কি রকম সে বিষয়ে নয়। আমাদের অনেক লেখকই চমৎকার লেখেন সে বিষয়টা নিয়ে শুধু আমার কেন হয়তো কারো মনেই কোন সন্দেহ নেই। ভাল একটা লেখাতো আর এমনি এমনিই আসে না। এর জন্য গভীর যত্ন নিতে হয়, ঠিকমত জল টল দিতে হয়, সেই সাথে আন্তরিকতার মশলা মিশিয়ে দিতে হয় পরিমাণমত। তারপরই না পাওয়া যায় সুস্বাদু মচমচে জিনিষ। আমার মত চাবি-ফলকে ঝড় উঠিয়ে হুম হাম করে যা মনে এলো তাই লিখে ফেলা, সেরকম করে নিশ্চয় খুম কম লোকই লেখেন। তবে অনেক সময় যেরকম কুড়মুড়ে মুড়মুড়ে জিনিষও সামান্য লবনের অভাবে বিস্বাদ হয়ে যেতে পারে, সেরকম শুধুমাত্র বানান ভুলের কারণে অসাধারণ একটা লেখাও কখনো কখনো অত্যন্ত বিরক্তিকর পর্যায়ে নেমে আসতে পারে। যার কিছুটা লক্ষণ বাংলায় যারা লেখালেখি করেন তাদের সবার মধ্যে না হলে কারো কারো মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
আমি খেয়াল করে দেখেছি যে, কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমরা বাংলা বানানের প্রতি খুব একটা যত্নশীল না। হরহামেশাই ভুলভাল বানানে লিখে ফেলি যা লেখার তা। এর জন্য তেমন কোন লজ্জাবোধ বা আত্মগ্লানিতেও ভুগি না আমরা। আমি নিজেও যে ধোয়া তুলসী পাতা তা বলছি না। আমার নিজের লেখাগুলো যে সম্পূর্ণ বানান বিভ্রাটমুক্ত এমন দাবী করার মত সৎ সাহস অন্তত আমার নেই। অবশ্য এই লেখাটা আমি সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে লিখছি। ( বুদ্ধি করে একটা অভিধান নিয়ে বসেছি। কাজেই বলে নিচ্ছি ভুল টুল কিছু হলে অভিধান বেটাই দায়ী, আমি না।)। বানান ভুল সংক্রান্ত নিয়ে লেখায় বানান ভুল থাকুক এটা নিশ্চয় খুব একটা প্রীতিকর কিছু নয়। তারপরও কেউ কেউ হয়তো আমার এ লেখাতেই সামান্য চেষ্টা করলে বেশ কিছু বানান ভুল আবিষ্কার করে ফেলতে পারবেন। তবে এটুকু অন্তত আশা করছি যে কেউ আমাকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে আঙুল তুলে বলবেন না, ‘বাপু হে, আগে নিজের কাছাখানা সামলাওতো দেখি’।
তবে এটাও সত্যি বাংলা বানানের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য কোন বানান রীতি গড়ে উঠেনি। দুই বাংলায় দুই ধরনের বানানতো আছেই, সেই সাথে বানানের ব্যাকরণ রীতিটাও বড্ড বেশি জটিল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে। চোখ বন্ধ করেতো দূরের কথা চোখ খোলা রেখেও ভরসা করার মতো কোন অভিধান আমাদের নেই। বাংলা একাডেমীর অভিধানের সাথে পশ্চিম বাংলার সংসদ অভিধানের যথেষ্ট পার্থক্য সাদা চোখেই যে কারো কাছে দৃশ্যমান হবে। এর অবশ্য কারণও আছে। পশ্চিম বাংলায় বাংলা অনেকটা স্থির, আঁটোসাঁটো নিয়মের মধ্যে কাঠামোবদ্ধ অবস্থায় আছে। সেই তুলনায় বাংলাদশের বাংলা চপলা কিশোরীদের মত বড় বেশি চঞ্চলা, বড্ড বেশি বল্গাহীন এবং ভয়াবহ রকমের গতিশীল। এই গতির কারণেই বাংলাদেশের বইয়ের পাতার প্রমিত বাংলা ভাষা আর মানুষের মুখের ভাষায় গড়ে উঠেছে আসমুদ্র হিমাচল দূরত্ব। বা বলা যায় যে বাংলাদেশে মানুষের মুখের ভাষা প্রমিত বাংলাকে হঠিয়ে দিয়ে উঠে আসছে বইয়ের পাতায়। এতে অবশ্য সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। যে যেভাবে শব্দগুলোকে উচ্চারণ করে এখন সেইভাবেই লেখার একটা প্রবনতা দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে। এতে করে কোন কোন শব্দের সর্বজনগ্রাহ্য বানানও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনেকসময়। ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মত। তার নিজস্ব নিয়মে সে বিবর্তিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। এতে আমার বা আমার মত অনেকেরই হয়তো কোন আপত্তি নেই। কিন্তু একই সময়ে একই জিনিষ একেকজন বানান লিখবে একেকভাবে সেটা মেনে নেওয়াটাও বেশ কষ্টকর।
বাংলা উচ্চারণ রীতিও বানান ভুলের জন্য বেশ কিছুটা দায়ী। গরু, তরু, জরু অনেক বেশি সঠিক উচ্চারণ আসে গোরু, তোরু বা জোরু লিখলে। ন এর সাথে ণ, ই এর সাথে ঈ বা স এর শ, ষ এবং স্ব পার্থক্য করাও কঠিন। গণ লিখলেও যে উচ্চারণ আসে গন লিখলেও সেটাই আসে। রীতিকে রিতী লিখলেও উচ্চারণ পাল্টাবে না একবিন্দু। সাভাবিক আর স্বাভাবিকের মধ্যে উচ্চারণগত পার্থক্য কি আমরা করতে পারি? পারি না। তাহলে উচ্চারণ রীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বানান লেখা হবে কিভাবে? নাকি বানানের ক্ষেত্রে উচ্চারণকে উপেক্ষা করে ব্যাকরণকে প্রাধান্য দিতে হবে? মহা জটিল সমস্যা দেখছি!
ভাগ্য ভাল এটা আমার সমস্যা না। যাদের মাথা ব্যথা সেই ব্যাকরণবিদরা মাথা ঘামাক ওগুলো নিয়ে। আমার সমস্যা অন্যখানে। আমি যে কারণে এত বকবক করছি সেই বিষয়ে আসা যাক এবার। মুক্তমনা ইউনিকোডে যাওয়ার আগে আমরা লেখকদের পাঠানো পিডিএফ ফাইল বা তাদের ডক ফাইলকে মুহুর্তের মধ্যেই ঝটপট পিডিএফ করে সেটাকেই সংযোগে জুড়ে দিতাম। বড্ড সহজ ছিল কাজটা। আহা! কি আরামের দিনই না গেছে তখন। ভুলভাল বানান যা থাকতো তার সব দায়দায়িত্ব লেখকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যেতো তখন অনায়াসে। আমরা থাকতাম ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ইউনিকোডেড হওয়ার পর থেকে আমাদের কাজ গেছে ঢের বেড়ে। বেশিরভাগ লেখকেরা এখনো বিজয় বা বর্ণসফট চাবি-ফলক ব্যবহার করে থাকেন। সেগুলোকে ইউনিকোডে রূপান্তর করার সময় রূপান্তরক৩ মহাশয় বাংলা অক্ষরের সাথে সাথে আরো বিচিত্র সব অজানা হিজিবিজি চিহ্ন জুড়ে দিয়ে জগাখিচুড়ি যে জিনিষটা উগড়ে দেন তাকে বাংলা বললে বাংলাকে রীতিমত অপমান করা হয়। জগাবাবুর সেই খিচুড়ি থেকে পরে ডাল বাছার মত এক এক করে ওইসব বিচিত্র চিহ্নগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে হয় চাবি-ফলকে বাংলা অক্ষর মুদ্রণ৪ করে করে। সেই সময় যেহেতু কিছুটা হলেও লেখায় হাত পড়ে যায়, কাজেই ভুল বানানগুলোকে ঠিকঠাক করার জন্য আঙুলগুলোও নিশপিশ করতে থাকে তখন। গভীরকে গভির, স্বভাবকে সভাব বা মানুষকে মানুস দেখলে কারই বা আঙুল স্থির থাকবে বলুন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সময়ের অভাবে সেটা করা হয়ে উঠে না আর। তবে মনের মধ্যে খুঁতখুঁতানিটা থেকে যায় ঠিকই।
বিদঘুটে এই খুঁতখুঁতানি থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারেন একমাত্র লেখকেরাই। যে গভীর ভালবাসায় লেখাগুলো লিখছেন আপনারা, সেই একই গভীর ভালবাসা নিয়ে বানান গুলোকেও একটু ঠিকঠাক করে দিন দয়া করে। এজন্য খুব বেশি কিছু করতে হবে না আপনাদের। শুধু লেখা শেষ হওয়ার পর পরই কালবিলম্ব না করে ইয়া আলী বলে বিকট এক হুংকার দিয়ে মোটাসোটা একটা বাংলা অভিধান হাতে নিয়ে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আপনার অজান্তে চাবি-ফলকের ভূত যে বানানগুলোকে ভুলভাল করে লিখেছে সেগুলোকে কোন রকম দয়া মায়া না দেখিয়ে আচ্ছা মত চাবুক মেরে জন্মের মত সোজা করে দিন। এরকম কিছুদিন নিয়মিত কষে চাবুক পেটা করলে ভূত বাবাজী বাপ বাপ করে পালিয়ে কূল পাবে না আপনার চাবি-ফলক থেকে। ভূতের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে তখন আপনার লেখাও হয়ে উঠবে আরো বেশি ঝকঝকে এবং তকতকে।
আর বানান বিভ্রাটমুক্ত ঝকঝকে তকতকে একটা লেখা পেয়ে আপনার গুণমুগ্ধ পাঠকেরা তাদের ভালবাসা উদারহস্তে দ্বিগুণ বা তিনগুণ করে আপনাকে ফেরৎ দেবেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন।
এই লেখা লিখতে যেয়ে অজান্তে কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ভাল থাকুন সবাই। সেই সাথে নতুন বছরের বিলম্বিত শুভেচ্ছা মুক্তমনার লেখক এবং পাঠকদেরকে।
------------------------------------
১ গণনযন্ত্র- কম্প্যুটার
২ চাবি-ফলক- কিবোর্ড
৩ রূপান্তরক- কনভার্টার
৪ মুদ্রণ- টাইপ
মায়ামি, ফ্লোরিডা। [email protected]
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।