কনফিউজড এক জাতির গল্প
ফরিদ আহমেদ
পৃথিবীতে আমরাই বোধহয় একমাত্র জাতি যাদেরকে বলা যেতে পারে সবচেয়ে কনফিউজড জাতি। আমরা নিজেরাই জানি না যে আমরা কে। আত্ম-পরিচয়ের সন্ধানেই কেটে যাচ্ছে আমাদের সারাটা জীবন। বাংলাদেশের জন্মের এতো বছর পরেও আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি নাই যে আমাদের জাতিসত্তা আসলে কি। আমরা কি ধর্ম নিরপেক্ষ বাঙালি, নাকি মুসলিম বাংলাদেশী। আমাদের এক অংশ লোকজ ঐতিহ্যের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাবনত, বাংলার কোমল মাটি থেকে উঠে আসা হাজার বছরের সংস্কৃতিকে আপন ভেবে বুকে টেনে নিতে চায়। আরেক অংশ একে হিন্দুয়ানী বলে ছুড়ে ফেলে দিতে চায় আস্তাকুড়ে। তাদের কাছে দূর কোন অচেনা আরবদেশের শুষ্ক মরুর সংস্কৃতিকেই মনে হয় অনেক বেশি চেনা, অনেক বেশি আপন। আম, জাম, লিচুর চেয়ে খোরমা, খেজুরকেই মনে হয় অনেক বেশি রসালো। শ্যামল গায়ের কাঠাল গাছের ছায়ার চেয়ে মরুদ্যানের খেজুর পাতার ছায়াকে মনে হয় অনেক বেশি আরামদায়ক । পদ্মার স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানির চেয়ে জমজমের ঘোলা পানিকেই মনে হয় অনেক বেশি উপাদেয়। দূর কোন দেশের অজানা অচেনা মুসলমানকে যেখানে মনে হয় একই মায়ের পেটের ভাই, সেখানে একই ভাষায় কথা বলা, একই মাটির সন্তান ঘরের পাশের হিন্দু খ্রীস্টান বা বৌদ্ধকে মনে হয় বিজাতীয় কোন ঘৃন্য পশু। কোথাকার কোন বাবরী মসজিদ ভাংগার ক্রোধ এবং প্রতিহিংসায় আমরা নির্দ্বিধায় ছুরি চালিয়ে দেই প্রতিবেশী হিন্দুর গলায়। জিহাদী জোশে ধর্ষন করি তাদের বুড়ি থেকে ছুড়ি সব মেয়েদেরকে।
আমাদের এই কনফিউশন কিন্তু আজকে থেকে নয়। সেই সুদূর কাল থেকেই চলে আসছে আমাদের এই বিভ্রম বা মতিভ্রম। আমাদের এক অংশ নিজেদেরকে মুসলমান ভেবে সরিয়ে রেখেছে অন্য অংশের কাছ থেকে। তাদের কাছে আরব দেশের সামান্যতম সংযোগই ছিল শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। আনন্দ এবং গর্বের চরম উৎস। এই দেশে থেকেও এদেশের কোন কিছুর সাথেই নিজেদেরকে আপন করে নিতে পারে নি তারা। সে কারনেই আমরা দেখি আমাদের এক শ্রেনীর মুসলমানদেরকে আরব দেশ থেকে হিজরত করা সৈয়দ বা খোন্দকার বলে গর্ব এবং অহংকারের সাথে নিজেদের পরিচয় দিতে। বাঙালিত্ব তাদের কাছে নিদারুন অনাদর ও অবহেলার পাত্র, ক্ষেত্র বিশেষে চরম ঘৃনারও বিষয়। এদের মধ্যে অনেকেই হিন্দুয়ানী বাংলায় কথা বলতেও লজ্জ্বা বা ঘৃনাবোধ করতেন। আরবী, ফার্সি বা উর্দুর মত মুসলমানী ভাষাতে কথা বলেই দিলের সুখ মিটাতেন তারা। শত শত বছর বাংলায় বসবাস করেও নিজেদেরকে কখনোই বাঙালি মনে করেননি তারা।
এরই ফলশ্রুতিতে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় এই বাংলায় আমরা দেখি চরম বিশৃঙ্খলা। একদল নিজেদেরকে বাঙালি বলছেতো আরেকদল নিজেদেরকে পরিচয় দিচ্ছে মুসলমান বলে । বাঙালি আর মুসলমানের এই ঘোরতর দড়ি টানাটানিতে বেচারা বাঙালিরা খুব সুবিধা করতে পারে নাই তখন। নাকে খত দিয়ে মুসলমান হয়ে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বলে পাকি ভাইদের সাথে গলায় গলায় এক হয়ে সাচ্চা মুসলমানদের এক দেশ গড়ে তোলে তারা। তবে আরবের মরুভুমিতে বালি ঝড় হলে এই খানে এই বাংলাদেশে কাদামাটিতে উটের মত মাথা গুজলেও বাঙালি মুসলমানদের মুসলমানিত্ব নিয়ে পাকি ভাইদের যথেষ্টই সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই। তাইতো পাক ভাইয়েরা বুড়াকালে খৎনা করার মত বাঙালি মুসলমানদের নাপাক অপ্রয়োজনীয় বাড়তি জিনিষপত্র কেটে বাদ দিতে চেয়েছিল। হিন্দুয়ানী ভাষা বাংলায় কথা বলা যাবে না, মুসলমানদের দিয়ে রবীন্দ্র সংগীত লেখাতে হবে এই সব বাহানা নিয়ে একের পর এক হাজির হয় তারা। খৎনা করার ভয়েই কিনা কে জানে কিছু লোকের মধ্যে হঠাৎ করেই বাঙালিত্ব জেগে ঊঠে আবার। শুরু হয় নিজেদের বাঙালি প্রমানের সব ধরনের প্রচেষ্টা। ভাষার জন্য রক্ত দেয়া থেকে হেন কোন কাজ নাই যা তারা করেনি বাঙালি হওয়ার জন্য। শেষমেষ বেশ বড় সড় একটা যুদ্ধও করে ফেলে তারা পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধ শুধুমাত্র পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধেই ছিল না। এদেশের জল হাওয়ায় বড় হওয়া কিন্তু মনে-প্রাণে পাকিস্তানী একদল লোকের বিরুদ্ধেও করতে হয়েছিল। অবশেষে অসংখ্য মানুষের প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে বাঙালী পেয়েছিল তার নিজস্ব দেশ।
কিন্তু স্বাধীন দেশ পাওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের বাঙালি হওয়ার খায়েশ মিটে গেল চিরতরে। যে পাকিস্তানীরা তাদের সর্বশক্তি দিয়েও আমাদের খৎনা করতে পারে নাই, সেই আমরাই এবার নিজেরাই হাজামের কাছে গিয়ে স্বেচ্ছায় লুঙ্গি উচিয়ে ধরে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে নিয়েছি। বিসমিল্লাহ বলে হিন্দুয়ানী বাঙালিত্বকে বিসর্জন দিয়ে মুসলমান বাংলাদেশী হয়ে গিয়েছি পাকাপাকিভাবে।
বাংলাদেশী হওয়ার পর থেকে আমাদের অবশ্য আর কোন সমস্যা নেই, ইনশা আল্লাহ। ঈমানের জোর বেড়ে গেছে অনেক বেশি আমাদের এখন। আমাদের যে সব ভাইয়েরা একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় দালাল বুদ্ধিজীবিদের ধরে ধরে আল্লাহ আকবর বলে জবাই করতেন তারা আবার সগর্বে ফিরে এসেছেন। দেশ স্বাধীনের পর তারা সাময়িকভাবে কিছুটা বিপদে পড়েছিলেন। বিচ্ছুদের ভয়ে ইঁদুরের মত গর্তে লুকাতে হয়েছিল কিছু দিনের জন্য। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে তারা আবার বীর বিক্রমে ফিরে এসেছেন। সরকারের মন্ত্রী মিনিষ্টার হচ্ছেন তারা, দামী দামী গাড়িতে চড়ছেন। যে পতাকাকে আতুড় ঘরে মারতে চেয়েছিলেন সেই পতাকাওয়ালা গাড়িতে চড়েই সবার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। এই যে নতুন জলপাই সরকার, যাদের দাপটে বাঘে ছাগলে সব এক ঘাটে পানি খাচ্ছে। তারেক জিয়ার মতো মহাচোর ছিচকে চোরের সাথে একই রুমে ঘুমাচ্ছে। হুদা মিয়া, ফালু মিয়ারা মালির কাজ করছে। চির বৈরি হাসিনা-খালেদা এক হাড়ির খাবার খাচ্ছে। সেই সরকারও তেনাদেরকে সৎ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আর পায় কে তেনাদের। সেই সাহসে বলিয়ান হয়েই তেনাদের কেউ কেউ এখন দাবী করছেন যে একাত্তর সালে কোন যুদ্ধপরাধীই ছিল না। যুদ্ধাপরাধী থাকবেই বা কিভাবে? সাধারনত যে কোন যুদ্ধেরই পরাজিত অংশের মধ্য থেকেই যুদ্ধাপরাধী বেছে নেওয়া হয়। একাত্তর সালের যুদ্ধের বিজয়ী পক্ষ যে পালটে গেছে এটা এখনো কিছু লোকের মাথায় ঢোকেনি ঠিকমত। তাইতো তারা এখনো এই সব ঈমানদার ভাইদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিবেচনা করছে। দিনকাল যে পালটে গেছে তা তো আর তারা জানে না। রিমান্ডে নিয়ে একটু দলাই মলাই করে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রফেসর আনোয়ারের মত বাপ বাপ করে মাফ চেয়ে কুল পাবে না বেটারা।
কনফিউশনের সব উপাদানই বাংলাদেশে ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। দেখুন আমাদের ইতিহাস বই। সূর্যসেন, প্রীতিলতার নাম গন্ধও খুঁজে পাবেন না সেখানে। মালাউনরা হবে আমাদের জাতীয় বীর। তওবা, তওবা, নাউজুবিল্লাহ। তাই বলে কি আমাদের কোন জাতীয় বীর নেই। নিশ্চয়ই আছে। আমাদের জাতীয় বীর হচ্ছেন ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামের এক ভিনদেশি তস্কর। ঘোড়ায় চড়ে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে মানুষের মুন্ডু কেটে কেটে হিন্দু রাজা লক্ষ্মন সেনকে চোরের মত খিড়কি দিয়ে পালাতে বাধ্য করেছিল সে। এই রকম গ্লামারাস বীর থাকতে আর কাউকে লাগে নাকি। এতো গেলো অনেক আগের ইতিহাস। সাম্প্রতিক ইতিহাসও দেখুন। শেখ মুজিব কে? ভারতের দালাল। দেশটাকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। কি সর্বনাশের কথা। শহীদ জিয়া কে? স্বাধীনতার ঘোষক, দেশের রক্ষাকর্তা, বাংলাদেশী জাতির জনক। চট্টগ্রামে তেলের ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিলেন। আহা! কি সৌন্দর্য।
ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে পুরোদস্তুর মুসলমান বনে যাই আমরা প্রায়শই। পাকি ভাইদের জন্য জানপ্রাণ ফাটিয়ে ফেলি তখন। পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে উথাল পাথাল নাচানাচি শুরু করে দেই। কেউ প্রশ্ন তুললে বলে দেই মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, তাইতো আমাদের এই হইচই। তবে কানে কানে বলে রাখি, অন্য কোন মুসলিম দেশ হলে অবশ্য এতো মাতামাতি করি না আমরা। পাকিস্তান হলেই শুধু স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেই আমরা। এই যেমন কোন পাকি ভাইকে দেখলেই বিগলিত হয়ে যাই আমরা। কোলাকুলি করার জন্য আনচান করে উঠে বুকটা। উর্দুতে কথা বলার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করতে থাকে আমাদের।
যারা আজকে মুজাহিদ বা শাহ হান্নানের কথা শুনে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন তাদের জন্য বলছি, এই ধরনের কথা শুধুমাত্র এই দু’জনই বলেন না। এই পরবাসে একসময় অনেক পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি আমি। সেখানে দেখেছি অনেক লোকই নিজামী মুজাহিদ গংদের চেয়েও মারাত্মক সব কথাবার্তা বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। সেই সব অনুষ্ঠানে খুব কম লোককেই আমি দেখেছি সেগুলোর প্রতিবাদ করতে। বরং বেশিরভাগ লোককেই মাথা দুলিয়ে তাদের কথাকে সমর্থন করতেই দেখেছি। এই সব লোকেরাই যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অত্যন্ত অসম্মানজনক কথা বলতে পারে তাহলে নিজামী মুজাহিদের মত কুখ্যাত আলবদর আল শামসরা যে এগুলো বলবে এটাইতো স্বাভাবিক।
সত্যি কথা বলতে কি জাতি হিসাবে আমাদের কোন মর্যাদাবোধই নেই। ছিলও না বোধহয় কোনকালে। বাঙালি হিসাবে আমরা কখনোই নিজেদেরকে গর্বিত ভাবি না। আদৌ বাঙালি ভাবি কিনা সেটা নিয়েই আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। নিজেদের নিয়ে সবসময় অদ্ভুত এক হীনমন্যতায় ভুগি আমরা । আত্ম-পরিচয়ের গভীর সঙ্কটে ভুগছি আমরা অনেক অনেক যুগ ধরে। কোনটা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর কোনটা উড়ে এসে জুড়ে বসা তার পার্থক্য করতেও অক্ষম আমরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উড়ে এসে জুড়ে বসাটাকেই নিজের বলে ভেবে নেই আমরা। অন্যেরাতো আমাদের সম্পর্কে অপমানসূচক কথাবার্তা বলেই, আমরা নিজেরাও কম বলি না নিজেদের সম্পর্কে। যতদিন পর্যন্ত না আমাদের আত্ম-পরিচয়ের এই সংকট কাটবে ততদিন পর্যন্ত নিজামী-মুজাহিদদের মত খুনী, ধর্ষক, যুদ্ধাপরাধীরা যা ইচ্ছা তাই বলে যাবে এই দেশে, যা খুশি তাই করে যাবে এই মাটিতে। আঙুল চোষা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না আমাদের।
মায়ামি, ফ্লোরিডা
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।