জেনারেলের হার্ভার্ড ভ্রমণ
ফরিদ আহমেদ
বাংলাদেশের সব থেকে ক্ষমতাবান ব্যক্তি জেনারেল মঈন এখন যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। গত কয়েকদিনের পত্র পত্রিকা থেকে দেখতে পাচ্ছি যে আগামি ২১ শে অক্টোবর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গভার্নমেন্ট আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তৃতা দেবেন। আইভি লীগের সদস্য হার্ভার্ড বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগে সংশ্লিষ্টদেরকে আলাদাভাবেই দেখতে অভ্যস্ত সবাই। এখানে আমন্ত্রন পাওয়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সম্মান এবং মর্যাদার বিষয়। কোন হেজি পেজির পক্ষে সম্ভব নয় এই বিরল আমন্ত্রন পাওয়া। আমাদের জেনারেল সাহেব যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং বিদ্যান মানুষ সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। না হলে কি আর তার কাছে এই আমন্ত্রন আসে। যুক্তরাষ্ট্র আসার পথে লন্ডনের বাংলা টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারেও জেনারেল মঈন উল্লেখ করেছেন যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সেখানে একটি লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানিয়েছে। আর সেজন্যই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। তিনি সাথে সাথে একথাও বলেছেন যে বাংলাদেশের সেনা প্রধানকে আমন্ত্রন জানিয়ে হার্ভার্ড যে সম্মান দিয়েছে তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। উৎসাহী পাঠকেরা নিচের লিংকটা দেখতে পারেন।
http://www.youtube.com/watch?v=_LKytUKO-oE
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় যে সম্মান বাংলাদেশের সেনা প্রধানকে দিয়েছেন তাতে বাংলাদেশী হিসাবে গর্ব আর অহংকারে বুকের ছাতি বেলুনের মত ফুলে সাত আসমানে গিয়ে ঠেকেছে আমাদের। আমরা সবাই যে আনন্দে আত্মহারা তাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু গোল বেধেছে আসলে অন্যখানে। কেনেডি স্কুল অব গভার্নমেন্ট এর ইভেন্টসূচীতে জেনারেল মঈনের প্রোগ্রামের ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও কিছু উল্লেখ করা নেই। আমাদের গর্বের বেলুনে হার্ভার্ড যে এভাবে সুই ঢুকিয়ে ফুঁটো করে দেবে তা কে জানতো। নিশ্চয় এটা দেশের বিরুদ্ধে সুগভীর কোন ষড়যন্ত্রের অংশ। ষড়যন্ত্রকারীরা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে সেই দূর বাংলাদেশ থেকে এই বোস্টনেও এসে হাজির হয়েছে তাতে কোন দ্বিমত নেই। আবার ভিন্ন ধরনের প্যাচও দেখা যাচ্ছে আরেকটা। কিভাবে কিভাবে যেন ২১ তারিখ রবিবার হয়ে গেছে। অবাক কান্ড! শনি-রবিবারে এই দেশে সাধারনত কোন অফিসিয়াল সেমিনার হওয়াটা বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার স্যাপার। আমেরিকানরা উইকএন্ড আসলেই কাজের জায়গা থেকে হাওয়া হয়ে যায় ফুরুৎ করে। টিকিটিও আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। কে কোথায় যাবে তার হুলুস্থুলুস পড়ে যায় সেই সময়। বনে বাদাড়ে যেয়ে ফুর্তিফার্তা করে কাটিয়ে দেয় সপ্তাহের এই দু’টো দিন তারা। ‘কাজ কাজের দিনে আর আনন্দ ফুর্তি হচ্ছে ছুটির দিনে’ এই হচ্ছে আমেরিকানদের সরল নীতি। কেনেডি স্কুল অব গভার্নমেন্ট এর ইভেন্ট সূচীও সেই ইঙ্গিতই দেয়। হারিকেন জ্বালিয়ে আতি পাতি করে খুঁজেও শনি রবিবারে কোন ইভেন্টই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে। ইভেন্ট সূচীতে ১৯ তারিখ শুক্রবারের অনুষ্ঠান সুচী দেওয়া আছে। তারপর শনি রবি বাদ দিয়ে ২২ তারিখ সোমবার থেকে পরের সপ্তাহের সব অনুষ্ঠানের বিবরণ দেওয়া আছে। জেনারেল মঈনের রবিবারের অনুষ্ঠান হার্ভার্ডের কোন পন্ডিতরা করছে কে জানে। তেলেসমাতি কায়কারবার দেখছি।
হার্ভার্ড অবশ্য জেনারেল মঈনের জন্য অপরিচিত কিছু নয়। তার ছাত্রজীবনের একটা অংশ কেটেছে এখানে। বাংলাদেশ আর্মির ওয়েবসাইটে তার যে রিজ্যুমি রাখা আছে সেখানে দেখা যাচ্ছে যে বেশ গর্বের সাথেই ঘোষনা করা আছে যে তিনি হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট। কোন বিষয়ে বা কোন সালে গ্রাজুয়েশন করেছেন সেটার অবশ্য উল্লেখ নেই সেখানে। নিচের লিংক দেখুন।
http://www.bangladesharmy.org/newahq/index5.php?category=25
হার্ভার্ড গ্রাজুয়েটরাও যে আজকাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাজ করছে জানাই ছিল না আমার। ওয়াও! কিন্তু এইখানেও দেখি আরেক সমস্যা। শেখ হাসিনা তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় তার ব্লগস্পটে দাবি করছে যে, জেনারেল মঈন কোনক্রমেই হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট নন। তিনি হার্ভার্ডের এক্সিকিউটিভ এডুকেশন প্রোগ্রামে কোন এক সময়ে এটেন্ড করেছিলেন মাত্র। কোন ধরনের ডিগ্রিই নাকি তিনি করেননি সেখান থেকে। যে কোন প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভরাই খুব সহজেই এটেন্ড করতে পারেন এই প্রোগ্রাম গুলোতে। জয়ের ভাষ্য অনুযায়ী এই ধরনের এক্সিকিউটিভ প্রোগ্রামের ভর্তির আবেদন ভর্তি কমিটির মাধ্যমে হয় না এবং এ সকল প্রোগ্রামে কোন পরীক্ষা বা গ্রেড সিস্টেমও নেই। কাজেই ডিগ্রীর কোন প্রশ্নই আসে না। জয়ের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে বলতেই হবে যে জেনারেলের রিজ্যুমিতে মারাত্মক ভুল আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মত এরকম একটা সুদক্ষ বাহিনী, যাদের ধারনা বাংলাদেশে তারা সবকিছুতেই সেরা, তাদের ওয়েবসাইটে তাদেরই ক্ষমতাবান প্রধান সম্পর্কে এরকম ভুল তথ্য থাকবে সেটা মেনে নিতেও কষ্ট হয়। জেনারেল সাহেবেরই বা এতো বড় মারাত্মক ক্রুটি চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে কে জানে। তবে ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে মাতৃশোকে কাতর প্রতিহিংসাপরায়ন হাসিনা পুত্র মহান এই মানুষটি সম্পর্কে খামোখাই আকথা-কুকথা বলে বেড়াচ্ছে।
আকথা-কুকথা যে শুধু জয় একাই বলছে তা কিন্তু নয়। এই যে ট্রাষ্ট ব্যাংক নিয়েও বদমতলবী লোকজনেরা নানান আজেবাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে আজকাল। প্রথম দর্শনেই ট্রাষ্ট ব্যাংক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে কাঁপিয়ে দিয়েছ একেবারে।। প্রথম দিনের বেচা কেনাতেই রেকর্ড গড়ে ফেলেছে এই ব্যাংক। সাতশ” পঞ্চাশ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে এর এক একটি স্টক। হাওয়া কোন দিকে যাচ্ছে বাঙালী তা খুব ভালই বোঝে। ট্রাষ্ট ব্যাংকের এই রমরমা অবস্থা দেখে অবশ্য মনমরা হয়ে গেছে কিছু লোকের। কিছুক্ষন ঝিম মেরে থেকে তারা সাথে সাথেই আবিষ্কার করে ফেলেছে যে, এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আমাদের সেনাপ্রধান সাহেব আর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হচ্ছেন তার আপন ভাই। তারা দাবী করছে যে আপন দুই ভাইয়ের নাকি একই বোর্ড অব ডাইরেক্টরসে থাকাটা নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশনের পরিপন্থি। স্বজনপ্রীতি যাতে না হয় তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি এই আইন করে রেখেছে। তারা তাদের দাবীর স্বপক্ষে রেগুলেশন থেকে নিচের আইন তুলে ধরেছে তারা।
1. Constitution of the Board of Directors:-
a) The board of directors of the bank-companies shall be constituted of maximum 13 (thirteen) directors. However, the directors of the banks, where the number of directors is more than this number, shall be allowed to complete their present tenure of office.
b) This restriction shall apply to appointment/reappointment of the directors against retirement or filling casual vacancy subject to section 15 Ka Ka of the Bank Companies Act, 1991. -Not more than one member of a family will become director of a bank. For this purpose family members shall include spouse, parents, children, brothers and sisters of the director and other persons dependent on him/her.
শুধু এটাই নয়, এইসব কুমতলবী লোকজন কিভাবে যেন আরো জেনে গেছে যে, তারা দু’জনেই ট্রাষ্ট ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লোনও নিয়েছেন। সেখানেও তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন এনে বলছে যে ডিরেক্টরদের নিজেদের ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা নিচের এই ফালতু আইন তুলে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন থেকে।
1. Any loan facility or guarantee or security provided to a Director of a bank or to his relatives must be sanctioned by the Board of Directors of the bank and approved in the general meeting and has to be specifically mentioned in the Balance sheet of the bank. However the total amount of the loan facilities extendable to a Director or to his relatives should not exceed 50% of the paid-up value of the shares of that bank held in Director’s own name.
ট্রাষ্ট ব্যাংকের সাত লাখ শেয়ারের মধ্যে জেনারেল মঈনের শেয়ারের সংখ্যা মাত্র দশ। আর তার ভাইয়ের কোন শেয়ারই নেই। প্রতিটা শেয়ারের দাম মাত্র ১০০ টাকা। এই হিসাবে জেনারেল মঈনের শেয়ারের মূল্য মাত্র ১০০০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন অনুযায়ী বোর্ড ডিরেক্টরদের অনুমোদন সাপেক্ষে তিনি মাত্র ৫০০ টাকা ঋন পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক এই এই রেগুলেশন জারি করেছে বোর্ড অব ডিরেকটরদের ক্ষমতা অপব্যাবহার বন্ধ করা বা অন্য কথায় দুর্নীতি বন্ধের জন্য। (সূত্রঃ Coming to America- Junta Banking Edition by Mash)
আইন দেখানো এই সব আইন প্রেমিক লোকেরা অবশ্য ভুলে গেছে যে এই দেশে মার্শাল ল বলে এমন এক যুতসই আইন আছে যার কাছে অন্য সব আইনই একেবারে ভোতা।
এখানেই কাহিনীর কিন্তু শেষ নয়। জেনারেল সাহেব কিভাবে এক কোটি টাকা নিয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যেই ছেষট্টি লাখ টাকা শোধ করে দিল তা নিয়েও এই সব ছিদ্রান্বেষী লোকজনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। আরে ব্যাটারা, বাংলাদেশে ব্যাংক লোন নিয়ে লোন ফেরত দিয়েছে এমন লোক আছে নাকি একটাও। দেশের সব হোমরা চোমরা লোকেরাইতো ঋণখেলাপী। অন্যদের মত জেনারেল সাহেব টাকাটা মেরে দিলেও পারতেন। কেই বা কি করতে পারতো। তা না তিনি সততা দেখিয়ে টাকাটা তাড়াতাড়ি ফেরত দেওয়াতেই মনে হয় বিরাট অন্যায় করে ফেলেছেন। এরকম একটা মহৎ কাজ নিয়েও কত না সমালোচনা। ভাল কাজের কোন মূল্য নেই বাঙালীর কাছে। জিলাপীর প্যাচের মত প্যাচ এদের পেটে পেটে। মানুষের শুধু খুঁত ধরতেই ওস্তাদ এরা।
যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছেন তাকেই কিনা দুর্নীতিবাজ বলা। কত বড় দুঃসাহস! কে দুর্নীতিবাজ আর কে দুর্নীতিবাজ না সেটা বলার অধিকার আছে বাংলাদেশে একমাত্র তার। এই তো সেদিন লন্ডনে তিনি বললেন যে, যাদেরকে দুর্নীতির অভিযোগে ধরা হয়েছে তারা সবাই দুর্নীতিবাজ। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে কেউ প্রমান করুক যে দুর্নীতিবাজ ছাড়া আর কাউকে ধরা হয়েছে কিনা। আগে জানতাম যে, কোর্টে প্রমাণ হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী বলা যায় না। তবে চার তারার জেনারেল বলে কথা। তিনি হচ্ছেন ঈশ্বরসম। কোর্টে দুর্নীতি প্রমাণ হবে কি হবে না তার কেয়ার তিনি করেন নি। তিনি যাকে দুর্নীতিবাজ বলবেন সেই দুর্নীতিবাজ। তার মতে যৌথ বাহিনীর হাতে চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির অভিযোগে ধরা পড়লেই সে হবে দুর্নীতিবাজ।
শুধু দুর্নীতিবাজদের নিয়েই নয়, ওয়ান ইলেভেনের সুমহান প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করেছেন তিনি সেখানে। চোখে পানি এসে যাওয়ার মত এক করুন কাহিনী গভীর আবেগে বিবৃত করেছেন তিনি এর প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে। গত বছরের অক্টোবর মাসে মানুষকে পায়ের নিচে চেপে যেভাবে পশুর মত হত্যা করা হয়েছে তা টিভিতে দেখে তিনি এমনি বিচলিত হয়েছিলেন যে, তখনই তিনি ঐশী ক্ষমতায় বুঝতে পেরেছিলেন যে এই দেশকে তিনি ছাড়া উদ্ধার করার আর কেউই নেই।
আমাদের শুধু আফসোস, যৌথ বাহিনীর হাতে চলেশ রিচিলের নৃশংস মৃত্যু বা ঠান্ডা মাথায় ক্রস ফায়ারে বিনা বিচারে অসংখ্য মানুষ মারায় তিনি বিচলিত হন না একবিন্দুও। বড় বড় মানুষদের অবশ্য সব বিষয়ে বিচলিত না হলেও চলে।
১৯ অক্টোবর, ২০০৭
===============================================
মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।