নৈবেদ্য
মেইন সুইচ বন্ধ করে এমপ্লয়ি রুম থেকে বের হয়েই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বিপদের গন্ধ পেল মিশেল। কোথাও কিছু একটা গোলমাল আছে। অজানা কিছুর আশংকায় গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে তার।
আলো নেভানোর আগে দোকানের সব কিছু খুব ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছে সে। অস্বাভাবিক কোন কিছুই চোখে পড়েনি তখন। জুয়েলারির দোকান। বন্ধ করার সময় সব কিছু ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করাটা তাই খুবই জরুরী। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কি যেন একটা সমস্যা আছে। ঠিকমত ধরতে পারছে না অবশ্য।
চাঁদের আলোয় দোকানের মধ্যে ভুতুড়ে সব ছায়া তৈরি হয়েছে। সুনসান নীরবতা চারদিকে। মার্বেল টাইলসে হাই হিলের খট খট শব্দটা বড্ড বেশি কানে বাজলো মিশেলের। শব্দ কমাতে হবে। হাটার গতি কমিয়ে দিল মিশেল। আর তখনই টের পেল যে দোকানে সে একা না। অনাহুত কেউ আছে দোকানের মধ্যে। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে তার। মাতালের সিঁড়ি ভাঙ্গার মত পা টেনে টেনে হাঁটছে কেউ একজন।
তীব্র ভয়ে দোকানের মাঝখানে একেবারে জমে গেল মিশেল। বুকের খাঁচার সাথে বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিন্ড। আলো আধাঁরির মাঝে দোকানের দূরপ্রান্তে কালো একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল মিশেল। বুনো জানোয়ারের হিংস্রতা আর বর্বরতা নিয়ে ডিসপ্লে ক্যাবিনেটগুলো হাতাচ্ছে সে। কিছু একটা খুঁজছে পাগলের মত। অপ্রয়োজনীয় গহনা এবং খালি বাক্সগুলো ভয়ংকর ক্ষিপ্ততায় ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে মেঝেতে।
ভাগ্য ভাল মিশেলকে দেখে নাই উন্মত্ত লোকটা। পালাতে হবে। যেভাবেই হোক পালাতে হবে এখান থেকে। প্রচন্ড আতংকে দিশেহারা মিশেল ছুট দেয় গ্লাস প্যানেলের ডাবল ডোরের দিকে। দরজার হাতল ধরে খুলতে যেয়ে ঘাড়ের পিছনে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে থমকে যায় সে। ধীরে ধিরে ঘুরে দাঁড়ায় ভীত আতংকিত মিশেল। একেবারে কাধে হাত দেওয়ার দূরত্বে দাঁডিয়ে আছে লোকটা। একহারা লম্বা একটা লোক। চাঁদের মোলায়েম আলো এসে পড়েছে আগন্তুকের মুখে। সুদর্শন বাদামী চেহারা। একমাথা এলোমেলো চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কপালের উপর। ঠোঁটের কোনে ঝুলে আছে ছেলেমানুষি দুষ্টু হাসি। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মজার একটা কিছু বলবে।
***************
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো তন্বীর মুখ। মায়ামি বীচে এরকম বিলাসবহুল রেষ্টুরেন্টে আগে কখনো যায়নি সে। এর আগেও বেশ কয়েকবার তারা মায়ামি বীচে এসেছে। নীল সমুদ্র আর রূপালী সৈকত দেখার লোভে। রেষ্টুরেন্টে বসে খেয়েছেও মাঝে মাঝে। কিন্তু সেগুলো ছিল সাধারণ মানের রেষ্টুরেন্ট। আজকের এটাকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না সেগুলোর সাথে। অসম্ভব সুন্দর সব ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি ঝুলছে ভিক্টোরিয়ান সিলিং থেকে। দামি দামি অসংখ্য চিত্রকর্ম লাগানো রয়েছে ওক কাঠের দেয়াল জুড়ে। মোমের আলোয় স্বপ্নরাজ্যের মায়াবি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সুবেশিত ওয়েটাররা ক্রিষ্টালের পাত্রে করে শ্যাম্পেন সার্ভ করছে ডাইনারদের। ভিতরে বসে থাকা মেয়েগুলো যেন একজন আরেকজনের সাথে সাজগোজের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অসম্ভব দামি জাকজমকপূর্ণ রঙিন ককটেল পোষাক সবার গায়ে। নিজের সাদামাটা পোষাকের কথা ভেবে লজ্জায় পড়ে গেলো তন্বী। আড়চোখে আকাশের দিকে তাকালো। সে বেচারাও মনে হচ্ছে কিছুটা ভড়কে গেছে এত জাকজমক দেখে। এমনিতেই ভীষণ মুখচোরা আর লাজুক ধরনের লোক আকাশ।
বো টাই পরা পরিপাটি পোষাকের একজন ওয়েটার তন্বী আর আকাশকে জানালার পাশে একটা টেবিলে নিয়ে গেল। দিনের বেলা সেখান থেকে বাইরে তাকালেই আটলান্টিকের নীল জল চোখে পড়ার কথা। কালচে আঁধারে এখন শুধু বালিয়াড়িতে ঢেউ ভাঙ্গার সাদা সাদা ফেনা চোখে পড়ছে। সেই সাথে ভেসে আসছে সাগরের গুরুগম্ভীর গর্জন। টেবিলে সবকিছু এত সুন্দর আর পরিপাটি করে সাজানো যে কোন কিছু ধরতেই ভয় করতে লাগলো তন্বীর।
‘এত্তো সুন্দর!’ চারিদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে তন্বী। ‘আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক অনেক বেশি সুন্দর। এখানে আসার কোন দরকার ছিল না। মিছেমিছি তোমার অনেকগুলো টাকা খরচ হবে’। অনুযোগ করে তন্বী।
‘অবশ্যই দরকার ছিল। তোমার জন্মদিন আর আমি কিছু করবো না তা কি করে হয়। আরো ভাল কোথাও যাওয়া দরকার ছিল’। প্রতিবাদ করে আকাশ। ‘তুমি যে আমার কি তা তুমিও নিজেও জানো না। আমি তোমার জন্য সব করতে পারি, সোনা’। আদর মাখা স্বরে বলে সে।
ভালবাসার মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায় তন্বী। সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে বসে আছে সে। গড়পড়তা বাঙালিদের চেয়ে অনেক লম্বা আকাশ। মেদবিহীন একহারা শরীর। এলোমেলো চুলগুলো অবাধ্যের মত ছড়িয়ে আছে কপাল জুড়ে। কপালের উপর আকাশের ওই অবাধ্য চুলগুলোকে দেখলেই তন্বীর হাত দুটো নিশপিশ করতে থাকে সেগুলোর মধ্যে হাত বোলানোর জন্য। মনে হয় ওর মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে ধরে বসে থাকে অনন্তকাল। শুধু এটুকুই নয়। মনে মনে আরো অনেক কিছুই করে সে আকাশের সাথে। এখন সেগুলো মনে পড়তেই ডালিমের মত রক্তিম হয়ে যায় তন্বীর দুই গাল। ঝিম ঝিম করে উঠে মাথাটা। কানের মধ্যে দিয়ে গরম ভাপ বেরোতে থাকে তার। ওর লাল হয়ে যাওয়া গালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশ। ঠোঁটের কোনে ছেলেমানুষি দুষ্টু একটা হাসি খেলা করছে। আকাশের ঠোটে এই হাসিটা সবসময়ই লেগে থাকে। দেখলেই বুকের মধ্যে রিনরিন করে কাঁপন জাগে তন্বীর। ছেলেদের হাসি যে এত সুন্দর হতে পারে তা আকাশকে না দেখলে জানতেই পারতো না সে। অদ্ভুত সুন্দর এই হাসিটার জন্য মরে যেতেও আপত্তি নেই তার।
‘চোখ সরাও। একেবারে জ্যান্ত গিলে ফেলবে মনে হচ্ছে আমাকে। লোকজন কি ভাববে’। চোখ বড় করে কপট রাগে ধমক দেয় তন্বী।
‘তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি’। তন্বীর ধমক খেয়েই যেন মনে পড়ে যায় আকাশের। পকেট থেকে আংটির একটা সুদৃশ্য ধাতব বাক্স বের করে সে। সিল্কের ফিতা দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো বাক্সটা। তন্বীর হাতে বাক্সটা তুলে দেয় সে।
‘এটাতো মনে হচ্ছে অনেক দামি আংটি। এত টাকা কোথায় পেলে তুমি? এরকম পাগলামি কেন কর, জান?’ আদুল গলায় বলে তন্বী।
বাক্সটা হাতে নিয়ে গভীর আনন্দে তার মুখটা ঝলমল করছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা উপভোগ করছে আকাশ। বাক্সের ফিতা খুলতে থাকে উচ্ছ্বসিত তন্বী। তন্বীকে ছাপিয়ে গত রাতের ভয়ংকর স্মৃতিটা এখন ভেসে আসছে আকাশের চোখের সামনে।......ভয়ে আতংকে হিম হয়ে গেছে জুয়েলারি দোকানের মেয়েটা। তন্বীর হাসি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। ......ছুরিটা শক্ত করে ধরে আছে আকাশ। প্রস্তুত। বাক্সটা এখন খুলে ফেলেছে তন্বী। .........গ্লাসডোর খোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভীত মেয়েটা। আংটিটার অসাধারণ সৌন্দর্য দেখে বাকহারা হয়ে গেছে তন্বী। ... ...... দুই হাতে রক্তাক্ত পেট চেপে ধরে ঠান্ডা মার্বেলের মেঝেতে অসহায়ভাবে শুয়ে ছটফট করছে হিসপানিক মেয়েটা।
‘উমম! দারুণ! দারুণ সুন্দর আংটিটা! আমার খুউউব পছন্দ হয়েছে’। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে তন্বী। আকাশের দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বলে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, আকাশ’। বলেই লজ্জায় পাকা টমাটোর মত লাল হয়ে যায় সে।
তন্বীর উচ্ছ্বাসভরা কন্ঠ শুনে বাস্তবে ফিরে আসে আকাশ। পরম মমতায় তন্বীর হাতে হাত রাখে সে। ঠোঁটের কোনের ছেলেমানুষি হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত হয়। তন্বীর কাজল কালো চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বলে, ‘আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি, রাজকন্যা’।
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।