নোটবুক এবং একজন বিজ্ঞানীর প্রতিকৃতি
(পর্ব-২)
লিওনার্দোর বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার (১)
বিজ্ঞানের আদিমতম চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রীসে। যদিও হেলেনিক ঐতিহ্যের বেশিরভাগই ধারণার সাথে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা যেভাবে চিন্তা করেন তার খুব সামান্যই সম্পর্ক রয়েছে। তা সত্ত্বেও আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞানীদের উপর গ্রীসের প্রভাব অসামান্য। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে জ্ঞানের পূনর্জাগরণ এবং বিজ্ঞানের পূনরাবির্ভাবকে বুঝতে গেলে কয়েকজন গ্রীক দার্শনিক এবং তাদের অবদানকে বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করা প্রয়োজন।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এরিস্টটল। জন্মেছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ৩৮৪ সালে চ্যালসিডাইসের স্ট্যাগিরাতে। তার বাবা ছিলেন মেসিডনের রাজা ফিলিপের রাজবদ্যি। বাবার সূত্রেই এরিস্টটল সেই সময়কার শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক প্লেটোর কাছে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান।
চিত্র ৩: মহাজ্ঞানী এরিস্টটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪ – খ্রীষ্টপূর্ব ৩২২)
এরিস্টটলের রচনাবলী শুধুমাত্র তার সময়েই প্রভাব বিস্তারকারী ছিলনা, বরং নিউটনের আগ পর্যন্ত, পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে সমস্ত বিজ্ঞানের ভিত্তিমূল হিসাবে স্বীকৃত ছিল। দর্শন, যুক্তি, জোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানসহ অসংখ্য বিষয়ে লিখে গেছেন তিনি। যুক্তিবাদী হিসেবে তিনি ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। অন্যদিকে তার সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল প্রাকৃতিক দার্শনিক (বা বিজ্ঞানী) হিসাবে। পদার্থবিজ্ঞানে তার ধারণাসমূহের চেয়ে জীববিজ্ঞানে তার ধারণাসমূহ অধিকতর শক্তিশালী ছিল। প্রাকৃতিক দর্শনে (ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে এর নতুন নামকরণ হয় ’পদার্থবিজ্ঞান’ হিসাবে) তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কাজ হচ্ছে দুটো গ্রন্থ On Generation and Corruption এবং Physical Discourse. এই বই দুটোতে তিনি বস্তু, আকৃতি, চলন, সময় এবং জাগতিক ও অজাগতিক জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এরিস্টটলের বাস্তবতার ধারণার ভিত্তিমূল ছিল এই যে, আমাদের এই পৃথিবী চারটি উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত। যদি এদেরকে স্থিতি অবস্থায় থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয় তবে এরা চারটি স্তরে নিজেদেরকে বিন্যাস করে নেয়। তিনি যুক্তি দেন যে, পানি বাতাসের মধ্য দিয়ে পতিত হয় ( বা বাতাস পানির মধ্য দিয়ে বুদবুদের মাধ্যমে উপরে ভেসে উঠে), মাটি পানি এবং বাতাস দুটোর মধ্য দিয়েই পতিত হয় এবং আগুন সবচেয়ে উঁচু স্তরে অবস্থিত কেননা তা বাতাস ভেদ করে উপরের দিকে উঠে যায়। এই যুক্তি অনুযায়ী, বৃষ্টি নিচের দিকে পড়ে কারণ এটা তার সঠিক অবস্থান বাতাসের নিচে পৌঁছুতে চেষ্টা করে। আগুনের শিখা ঊর্ধ্বমুখী হয় তার অন্য তিন উপাদানের উপরে অবস্থানের কারণেই।
প্রায় দুই সহস্র বছর বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদীতার কেন্দ্রে অবস্থান করা চার উপাদানের ধারণা ছাড়াও এরিস্টটল ‘অনড় সঞ্চালকের’ ধারণাও প্রস্তাব করেন। এই ‘অনড় সঞ্চালক’ হচ্ছে তার কল্পনার সর্বশক্তিমান্ সত্তা যা স্বর্গের সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রকে পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণায়মান রাখে।
এরিস্টটলের যুক্তি তার নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতি নৈয়ায়িক যুক্তির (Syllogistic logic) উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতো। এই ধারণা অনুযায়ী পূর্ববর্তী দুটি অবস্থার যৌক্তিক পরিণতি থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেতে পারে। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে এরকম। সব রাজনীতিবিদরাই প্রাণী, সকল প্রাণীই পৃথিবীতে বসবাস করে, কাজেই সব রাজনীতিবিদরাই পৃথিবীতে বসবাস করে। নৈয়ায়িক পদ্ধতি অত্যন্ত শক্তিশালী ধারাণাগত টুল। অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্তও গনিতবিদদের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে এর ব্যবহার খুবই সীমিত পরিসরে। বিজ্ঞানে এর ব্যবহারে অনেক সময় উদ্ভট যুক্তি এসে যেতে পারে। যেমন, সব রোবটের দুইটি করে পা। মানুষেরও দুই পা। কাজেই সব রোবটই মানুষ। নৈয়ায়িক পদ্ধতি পরীক্ষণের উপর খুব বেশী নির্ভর করে না। বরং শুধুমাত্র দুটি বিবরণ এবং বাহ্য পর্যবেক্ষণ বা অবরোহী (Deductive) যুক্তির সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। ফলে, বাস্তবতার থেকে বহু দূরের কোন ভ্রান্ত উপসংহারে পৌঁছুতে পারে (এরিস্টটল নিজেও এর শিকার হয়েছেন)।
পরীক্ষণ পদ্ধতি এড়ানোর ক্ষেত্রে এরিস্টটলই একমাত্র গ্রীক না। তার শিক্ষক প্লেটোও পরীক্ষণকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। পরীক্ষণের পরিবর্তে প্লেটো বিশুদ্ধ গনিতের প্রতি অসম্ভব জোর দিয়েছিলেন। তিনি তার একাডেমির দরজায় লিখে রেখেছিলেন, “যে জ্যামিতি জানে না, তার এখানে প্রবেশাধিকার নেই”।
চিত্র ৪: আরেক মহাজ্ঞানী প্লেটো (খ্রীষ্টপূর্ব ৪২৩ – খ্রীষ্টপূর্ব ৩৪৭)
লিওনার্দোও প্লেটোর এই উক্তিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার নোটবুকে লিখেছিলেন, “যে লোক গণিত জানে না সে যেন আমার নোটবই না পড়ে”। তিনি এই ধারণার বিকাশ ঘটিয়ে ছিলেন যে, মানব সম্প্রদায় প্রকৃতির গবেষণা এবং বিশ্বজগতকে জানার গভীর অনুরক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারে।
জীবদ্দশায় প্লেটো এবং এরিস্টটলের উচ্চতর মর্যাদা এবং সেই ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মসমূহ গ্রহণ করার কারণে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রজার বেকন পরীক্ষণ ধারণার গুরুত্ব সম্পর্কে লেখালেখি করার আগ পর্যন্ত, পরীক্ষণ পদ্ধতি খুব একটা পাত্তা কারো কাছ থেকেই পায়নি। এমনকি তখনও, এখন যাকে আমরা বলি ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’, তার চর্চা স্বল্প কিছু সংখ্যক অগ্রগন্য বৈজ্ঞানিকের মধ্যেই সীমিত ছিল। এই অবস্থা লিওনার্দোর মৃত্যুর একশো বছর পর সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্যালিলিওর সময়কাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যুক্তি এবং পরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে একটি ধারণাকে গ্রহণ করা হয়, তারপর সেই ধারণা থেকে আরোহী পদ্ধতিতে (Inductive method) যুক্তির মাধ্যমে অনুমিতি (Hypothesis) গড়ে তোলা হয়। অনুমিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই পরীক্ষণের মাধ্যমে এর যথার্থতা যাচাইয়ের আগেই বিজ্ঞানীরা এর বাস্তবতা গণিত ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করে থাকেন। পরীক্ষণপ্রাপ্ত ফলাফল বা পর্যবেক্ষণ যদি প্রাথমিক অনুমিতির সাথে না মেলে তাহলে বিজ্ঞানীরা আবার অনুমিতিতে ফিরে যান এবং এর পরিবর্তন সাধন করে নতুন পরীক্ষণ পরিচালনা করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না যুক্তি এবং পর্যবেক্ষণের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হয় বা মূল অনুমিতি বাতিল বলে ঘোষিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া বার বার চলতে থাকে। যদি যুক্তি এবং পরীক্ষণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে অনুমিতি তত্ত্বে পরিণত হয়। একমাত্র তখনই এই তত্ত্ব অধিকতর সাধারণীকরণ কোন বিষয় বা সমস্যাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিন্ত বিজ্ঞান নিজেও এই তত্ত্বকেই বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানো একমাত্র সম্ভাব্য তত্ত্ব হিসাবে দেখে না। যদি পরবর্তীতে নতুন কোন তত্ত্ব আসে যা কোন পরিস্থিতিকে বা সমস্যাকে আরো পূর্নাঙ্গভাবে বা আরো ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে তবে এই নতুন তত্ত্ব পুরনো তত্ত্বকে অপসারিত করবে।
সেই সময় এরিস্টটল এবং প্লেটোরও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু তারা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এই দুই দিকপালের বিশাল ছায়ার নিচে। এরিস্টটলের ৭৫ বছর আগে জন্ম নেওয়া ডেমোক্রিটাসই (Democritus) আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন।
চিত্র ৫: ডেমোক্রিটাস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬০ – খ্রীষ্টপূর্ব ৩৭০)
বর্তমানে তাকে পরমাণু তত্ত্বের জনক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এরিস্টটল ডেমোক্রিটাসের সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন শুধুমাত্র এই কারণে যে বিশ্ব সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ডেমোক্রিটাসের সাথে বিরোধপূর্ণ ছিল এবং তিনি নিজে তার নিজস্ব অন্ধবিশ্বাসের বাইরে বেরোতে পারেননি। ফলে সপ্তদশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ পিয়েরে গ্যাসেন্ডি (Pierre Gassendi) এবং রেনে ডেকার্টে (Rene Descartes) ডেমোক্রিটাসের কাজ পুনর্জীবিত করার আগ পর্যন্ত তা মোটামুটি বিস্মৃতির অতলেই তলিয়ে ছিল।
গ্রীকদের চিন্তাভাবনার বেশীরভাগই সংরক্ষিত ছিল আলেকজান্দ্রিয়া শহরের লাইব্রেরীতে। এরিস্টটলের মৃত্যুর সময়কালীন সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া পরিনত হয় সারাবিশ্বের জ্ঞানের তীর্থভূমিতে। আলেকজান্ডারের প্রাচ্যের রাজ্যসমূহ দখলের সাথে সাথে এই জ্ঞান পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে গ্রীক দর্শন, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য রোমান সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির ভিত্তি হিসাবে পরিগনিত হয়ে উঠে। কিছু কিছু রোমান দার্শনিক এরিস্টটলের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠেন। যেমন, লুক্রিটিয়াস (Lucretius) তার এক কবিতায় ডেমোক্রিটাসকে সমর্থন করেন। কিন্তু যেহেতু এরিস্টটল গ্রীক বিজ্ঞানের উপর একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, ফলে তার অন্ধবিশ্বাস মোটামুটি প্রায় ধর্মের কাছাকাছি রূপ নিয়ে ফেলেছিল। তার শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পড়ানো হয়েছে প্রশ্নাতীতভাবে। আর এটাই বিজ্ঞানকে কয়েকশ’ বছর ধরে কানাগলির ঘুপচিতে আটকে রাখে। প্রায় হাজার খানেক বছর ইউরোপকে অন্ধকারযুগে আটকে রেখেছিল কিছু মানুষের এই গোঁড়ামীই।
আলেকজান্দ্রিয়ার এই লাইব্রেরী দুই দুই বার ধ্বংস করে দেয়া হয়। প্রথমবার করেছিল ক্রিশ্চান বিশপ থিওফিলাস ৩৯০ সালের দিকে। সপ্তদশ শতাব্দীতে একে দ্বিতীয়বারের মত ধ্বংস করে দেয় মুসলমানেরা। তবে ভাগ্য ভাল, দ্বিতীয়বারের ধ্বংস করার সময় জ্ঞানের অনেকখানিই আরবরা সংরক্ষণ করেছিল।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পরই প্লেটোর ধারণাসমূহ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনা বড় ধরনের দুঃসময়ে পতিত হয়। প্লেটোর দর্শনের কারণে এরিস্টটলের অনেক ধারণাও মার খেয়ে যায় সেই সময়।
নয়া এই আন্দোলনের অনুসারীরা বিশুদ্ধ চেতনা এবং বিশুদ্ধ গণিত, বস্তুতান্ত্রিক অবস্থানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন। এদেরকে বলা হতো স্টোয়িক। আদর্শগত দিক থেকে এরা ছিলেন এরিস্টটলের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং বস্তুগত জগতকে জানার ব্যাপারে পুরোপুরি অনিচ্ছুক। তাদের কাছে এরিস্টটল ছিলেন বস্তুগত বিষয়ের প্রতি দারুণভাবে আগ্রহী ব্যক্তি এবং তার ধারণাসমূহ ছিল অতিমাত্রায় যান্ত্রিক। ধর্মীয় বিষয়ে তাদের আচ্ছন্নতার জন্য প্লেটোর প্রকৃতির মাধ্যমে সত্য আবিষ্কারের ধারণা (যা কারো কারো কাছে ঐন্দ্রজাল বলেই মনে হতো) তাদের কাছে অধিকমাত্রায় গ্রহনযোগ্য ছিল।
প্লেটো ছিলেন মানবকেন্দ্রিক (Anthropocentric) ধারণার অনুসারী । তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিশ্ব চরাচর পরম কোন সত্ত্বা সৃষ্টি করেছেন এবং তা তিনি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডে মানুষের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন।
(চলবে)
মায়ামি, ফ্লোরিডা। [email protected]
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।