রেজু রাজাকারের দাফন এবং আমাদের অসভ্যতা
ফরিদ আহমেদ 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম ওরফে রেজু রাজাকারের দাফন নিয়ে ফেণী জেলার ফরহাদনগরে তুলকালাম কান্ড ঘটে চলেছে। ফরহাদনগর রেজু রাজাকারের শ্বশুর বাড়ী। আশেপাশের গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়ে তার লাশ তুলে ফেলার জন্য বিক্ষোভ করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্থানীয় লোকজনও সামিল হয়েছে এই বিক্ষোভে। ফেনী জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মোতালেব কুখ্যাত খুনী রাজাকারের লাশ ফেনীর মাটি থেকে তুলে অন্য কোন স্থানে দাফন করার দাবী জানিয়েছেন। তা না হলে তারা প্রয়োজনে বৃহ আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন। 

রেজু রাজাকারের গ্রামের বাড়ী মাগুরা জেলায়। একাত্তর সালে মাগুরা মহকুমার ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিল এই রেজাউল করিম পরে সে আল বদর ও রাজাকারদের কমান্ডার হয় সে সময় এই রেজু রাজাকার ও তার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মাগুরার অসংখ্যা মুক্তিযোদ্ধা। শহীদও হয়েছেন অনেকে এই রাজাকারের হাতে তাদেরই একজন মাগুরায় তকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী লুফুন্নাহার হেলেন তাকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর একটি জিপ গাড়ির পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় ফেলে সারা মাগুরা শহরে টেনেহিঁচড়ে পাশবিকভাবে হত্যা করেছে এই রেজু রাজাকার ও তার বাহিনী 

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন রাত ৯টায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যায় রেজু রাজাকার রেজু রাজাকার একাত্তরের পর কখনো নিজ জেলা মাগুরায় যেতে পারেনি অথবা যায়নি লাশ মাগুরায় দাফন করার জন্য মৃত্যুর খবর গোপন রাখা হয় সোমবার সকালে খবর জানাজানি হলে মাগুরার মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিরোধের মুখে তার পরিবারের সদস্যরা লাশ নিয়ে ফিরে আসেন মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে এই কুখ্যাত খুনি ও যুদ্ধাপরাধী রেজু রাজাকারের লাশ যাতে মাগুরাতে দাফন করা না হয় সেজন্য জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও পৌরসভা চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে দুপুর ২টায় লাশের গাড়ি শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছার আগেই লাশ দাফনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন লাশ পৌঁছার পর তড়িঘড়ি করে জানাজা শেষ করে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয় 

আমরা বাঙালীরা সবসময়ই অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ এবং হুজুগে চলার ব্যাপারে মহা করিকর্মা। আর এই আবেগের কারণেই কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা সবসময়ই আমাদের চোখে পড়ে না। সবকিছুই আমরা করি আবেগ নয়তো সাময়িক হুজুগের বশে। রেজু রাজাকারের অপকর্মের কোন সীমা পরিসীমা নেই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তার প্রতি অসংখ্য লোকের ঘৃণা থাকবে, আক্রোশ থাকবে সেটাও খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তার মৃত্যুর পর তাকে দাফন করা যাবে না এমন অস্বাভাবিক এবং অসভ্য চিন্তা কিভাবে কিছু লোকের মাথায় আসে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারি না আমি। ফেনী এবং মাগুরার লোকেরা হয়তো বলবেন যে, আমরা চাই না আমাদের মাটিতে এই কুখ্যাত রাজাকারের দাফন হোক। অন্য যেখানে খুশি হোক আমাদের তাতে কোন আপত্তি নেই। ফেনী বা মাগুরার মত বাংলাদেশের অন্য জেলার লোকেরাও যদি গো ধরে বসে যে আমাদের মাটিতেও রেজু রাজাকারের দাফন হবে না, তাহলে এই লাশের কি হবে?

জীবিত মানুষ তার অসংখ্য রিপুর তাড়নায় অন্যায় করে, অপকর্ম করে। মৃত্যুর পর তার লাশ কি আর সেই মানুষ থাকে? সেতো পরিনত হয় বোধহীন জড় পদার্থে। তাহলে কেন তার প্রাণহীন দেহকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তার জীবিত সত্তার অপকর্মের? কেন এই অভব্য অত্যাচার প্রাণহীন দেহের উপর? কারই বা কি লাভ এতে? অমানবিক এই আচরন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি খুব বেশি উপকৃত হবে? 

গত ছত্রিশ সাইত্রিশ বছরে কি আর কোন কুখ্যাত রাজাকার মারা যায়নি। কোথাও তো শুনি নাই যে কোন রাজাকারের দাফন করতে বাধা দিয়েছে স্থানীয় লোকজন বা মুক্তিযোদ্ধারা। হঠা করে এই নতুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবিষ্কার হলো কিভাবে? ধরা যাক, কোন এক অলৌকিক উপায়ে (অলৌকিক বললাম এই কারণে যে এটা কখনোই হবে না বাংলাদেশে) নিজামী বা মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলানো হলো। তখন কি তাদের কবর দিতে অস্বীকৃতি জানাবো আমরা। আমাদের দেশের মাটি কি এতোই স্পর্শকাতর যে সামান্য কজন রাজাকার আলবদরের দাফনেই অপবিত্র হয়ে যাবে তা? ফেনী বা মাগুরায় কি রেজু রাজাকারের চেয়ে বড় কোন অপরাধীর দাফন হয়নি এর আগে? মৃত্যুর পরে এই সামাজিক এবং ধর্মীয় অত্যাচারটুকু না করে আমরা কি পারি না জীবিত অবস্থাতেই চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধীদেরকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে? রেজু রাজাকার জীবিত থাকার সময় ফেনীবাসীরা কিন্তু এই প্রতিরোধটুকু দেখাননি। বরং তাকে জামাই হিসাবেই বরণ করে নিয়েছেন তারা। এমন নয় যে রেজু রাজাকার স্বাধীনতার আগেই বিয়ে শাদী করে ফেলেছিল কাজেই তারা জানতো না যে সে একদিন কুখ্যাত খুনী রাজাকার হবে। স্বাধীনতার অনেক পরে ১৯৮৪ সালে ফরহাদনগরে মেয়েকে বিয়ে করেছে সে। এখন যারা তার লাশ দাফনের প্রতিরোধে যোগ দিয়েছে জামাই হিসাবে রেজু রাজাকার তাদের অনেকের বাড়ীতে দাওয়াত টাওয়াতও খেয়েছে নিশ্চয়ই। তাহলে কি জীবিত রেজু রাজাকারের চেয়ে তার নিষ্প্রাণ মরদেহই বেশী ঘৃণার বস্তু? 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা এর বিরোধিতা করে নির্বিচারে লুটপাট, হত্যা, ধর্ষন, নির্যাতন করেছে তাদের কোন বিচার এই বাংলাদেশে হয়নি। এখনো আমাদের নিত্য আন্দোলন করতে হচ্ছে, রাজাকারদের প্রতি সহানুভূতিশীল সরকারের কাছে দাবী জানাতে হচ্ছে তাদের বিচারের। তবে যে জিনিষটা খেয়াল রাখা দরকার তা হচ্ছে যে, এই বিচারের দাবী কিন্তু কোনক্রমেই প্রতিশোধ বা জিঘাংসামূলক নয়। রাজাকার আলবদররা আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করেছে কাজেই তাদের উপরও সমান অত্যাচার করতে হবে বিষয়টি কিন্তু সে রকম নয়। যে কোন সভ্য সমাজ তার অনাগত নাগরিকদের একটি অপরাধহীন সমাজ প্রদানের উদ্দেশ্যে অপরাধের বিচার করে থাকে। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কোন স্থান নেই সেখানে। আর এজন্যই সভ্য সমাজে অপরাধীর চেয়ে অপরাধকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় অনেক অনেক বেশি পরিমাণে। রাজাকার আলবদরদের প্রতি আমাদের চরম ঘৃণা আছে, থাকুক। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ যেন এমন না হয় যাতে করে আমরাও তাদের মত অসভ্য বর্বর হয়ে যাই। পিশাচের সাথে লড়াইয়ে পিশাচ হয়ে জেতার কোন অর্থ নেই। আমার কাছে মানুষ হয়ে হেরে যাওয়াটাও অনেক বেশি গৌরবের।  

আমার এই লেখাটি উলটা স্রোতে নৌকা বাওয়ার মতই হচ্ছে হয়তো। রাজাকার বা নব্য রাজাকার বলে যথেষ্ঠ পরিমাণে গালিগালাজও যে বর্ষিত হবে আমার উপর সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমার। মহা সেই বিপদটুকু মাথার উপর নিয়েই এই লেখাটি লিখলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতণায় সত্যিকারের বিশাসী মাত্র একজন মানুষও যদি আমার সাথে সহমত পোষন করেন তাতেই সান্ত্বনা পাবো এই ভেবে যে, উজান স্রোতে অন্তত একলা নই আমি।

মায়ামী, ফ্লোরিডা।                                                                   [email protected] 

===============================================

মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।