মাদার ইন্ডিয়ার পাঁচালি প্যাচাল
সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পথের পাঁচালিতে রাজনীতি নিয়ে কোন বক্তব্য না থাকা সত্ত্বেও ছবিটি রাজনৈতিক বিতর্কের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি কখনোই। চলচ্চিত্রটির জন্ম লগ্নেই পশ্চিম বঙ্গ সরকার এর সমাপনী দৃশ্যে পরিবর্তন আনার জন্য গায়ের জোরে ঘোরতর জোরাজুরি শুরু করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে ১৯৫৬ সালে পথের পাঁচালি অবিকৃত অবস্থায় কান চলচ্চিত্র উৎসবে যেতে সমর্থ হয়। সেখান থেকে পথের পাঁচালির বিস্ময়কর জয়যাত্রার পরবর্তী ইতিহাস আমরা সবাই কমবেশি জানি। এর মাধ্যমেই চলচ্চিত্র বিশ্ব পেয়েছিল চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ছবি এবং সেই সাথে একজন মহান চলচ্চিত্র নির্মাতাকে, যার জাদু কাঠির ছোঁয়ায় বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র তার নাবালকত্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হয়ে উঠেছিল সবল সাবালক। এর প্রায় পঁচিশ বছর পর ভারতের সংসদে পথের পাঁচালির বিরুদ্ধে একই ধরণের আপত্তি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এর সূত্রপাত ঘটান বলিউডের এক সময়কার আকর্ষনীয় সুন্দরী নায়িকা নার্গিস দত্ত। তিনি তখন ভারতের জাতীয় সংসদের একজন সম্মানীয় সাংসদ। নার্গিস ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতের এ যাবতকালের অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি মাদার ইন্ডিয়ার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সংসদের বিতর্কে নার্গিস বিদেশে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য সত্যজিৎ রায়কে দায়ী করেন। এক পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারেও তিনি সত্যজিৎ এর প্রতি এই হাস্যকর অভিযোগ ছুড়ে দেন। Andrew Robinson এর লেখা সত্যজিৎ রায়ের জীবনী গ্রন্থ The Inner Eye তে সেই সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করা আছে। অজ্ঞাত সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সাথে নার্গিসের রসালো কথোপকথন এরকমঃ
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ সত্যজিৎ রায় অপু ট্রিলজিতে এমন কি দেখিয়েছেন যে আপনি প্রতিবাদ করেছেন?
নার্গিসঃ তিনি পশ্চিম বঙ্গের ভয়াবহ রকমের দরিদ্র একটা এলাকার চিত্রায়ন দেখিয়েছেন যা ভারতের দারিদ্রকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না। আপনিই বরং আমাকে কিছু বলুন। কোন রাজ্য থেকে এসেছেন আপনি?
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ উত্তর প্রদেশ।
নার্গিসঃ তাহলে আপনিই বলুন, আপনারা কি আপনাদের আশি বছরের থুত্থুরে বুড়ি দিদিমাকে একা একা শ্মশানে ফেলে রেখে মারা যেতে দেবেন?
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ না, তা দেব না।
নার্গিসঃ কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের লোকেরা তা করে। আর সেটাই তিনি তার চলচ্চিত্রে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। এটা ভারতের আসল চিত্র না।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ পশ্চিম বঙ্গের লোকেরা ওটা করে থাকে?
নার্গিসঃ আমি জানি না। কিন্তু আমি যখন বিদেশে যাই তখন বিদেশীরা আমাকে খুবই বিব্রতকর ধরণের প্রশ্ন করে যেমন, ‘তোমাদের ভারতে কি স্কুল আছে? ওখানে কি গাড়ি টাড়ি চলে?’ লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায় আমার। রাগের চোটে মাঝে মাঝে মনে হয় যে আমি তাদের পালটা বলি, ‘আমরা গাছের ডালে বাস করি’। পথের পাঁচালির মত চলচ্চিত্র বিদেশে এত জনপ্রিয় কেন বলুন তো?
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ আপনিই বলুন।
নার্গিসঃ কারণ ওখানকার লোকেরা হতদরিদ্র শীর্ণ দশার করুণ ভারতকে দেখতে চায়। আমাদের দেশ সম্পর্কে ওই ধরনের প্রতিচ্ছবি তারা মনে মনে পোষণ করে এবং যে চলচ্চিত্র তাদের সেই ধারণার সাথে মিলে যায় সেটাকেই তারা বিশ্বাসযোগ্য বলে মেনে নেয়।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মত এরকম বিখ্যাত পরিচালক তা করতে যাবেন কেন?
নার্গিসঃ কেন আবার? পুরস্কার জেতার জন্য। উনার ছবিতো মোটেও চলে না। শুধুমাত্র পুরস্কার জেতে এই যা।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ আপনি উনার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করেন?
নার্গিসঃ আমি চাই যে তিনি যদি বিদেশে ভারতের দারিদ্রকে দেখাতে চান তবে তাকে অবশ্য ‘আধুনিক ভারত’কেও দেখাতে হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ কিন্তু পথের পাঁচালির বিষয়বস্তু এবং কাহিনী বিন্যাস যদি একটি দরিদ্র গ্রামকে কেন্দ্র করে হয় তবে তিনি কিভাবে জোর করে তার মধ্যে ‘আধুনিক ভারত’কে ঢুকাবেন।
নার্গিসঃ তিনি ‘আধুনিক ভারত’ নিয়ে আলাদা ছবি করতে পারেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ ‘আধুনিক ভারত’ কি?
নার্গিসঃ বাঁধ .........।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীঃ আপনি কি একটাও ছবির উদাহরণ দিতে পারেন যেটাতে আধুনিক ভারত দেখানো হয়েছে?
নার্গিসঃ ওয়েল ............ আমি এই মুহুর্তে হুট করে কোন উদাহরণ দিতে পারবো না।
সত্যজিৎ রায় অবশ্য বিগত যৌবনা সুন্দরীর এই ছাগলামির কোন উত্তর কখনোই দেননি । দেয়ার কথাও নয়। তবে অনেকেই সত্যজিৎ এর পক্ষ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই সময়। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্ষুরের মত ধারালো জিভের অধিকারী মেধাবী অভিনেতা উৎপল দত্ত। তিনি বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন যে, ‘অন্যদিকে নজর না দিয়ে এই চিড়িয়ার বরং তার মাদার ইন্ডিয়া রোল নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকা উচিত’। স্বনামধন্য পরিচালক এবং লেখকদের সংগঠন ‘ফোরাম ফর বেটার সিনেমা’ নার্গিসকে জবাব দিয়েছিল এভাবেঃ
‘আপনি বাঁধ, বিজ্ঞানী, ইস্পাত কারখানা এবং কৃষির সংস্কারের আধুনিক ভারতের কথা বলছেন। আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে বোম্বের তথাকথিত বানিজ্যিক ছবিতে এই আধুনিক ভারতকে চিত্রিত করা হয়? বাস্তবিকপক্ষে, বানিজ্যিক হিন্দি চলচ্চিত্রের জগত চোর- চোট্টা, চোরাকারবারী, ডাকাত, যৌনলিপ্সু, খুনী, ক্যাবারে ড্যান্সার, বিকৃত যৌনাচারী, বদমায়েশ, অপরাধী এবং ধর্ষক চরিত্র দিয়ে পরিপূর্ণ। এগুলো আর যাই হোক না কেন আধুনিক ভারতের প্রতিনিধিত্ব যে নয় তা মানতেই হবে’।
আমাদের বোধহয় এক্ষেত্রে কোন মন্তব্য না করলেও চলবে। বাইরের দুনিয়ায় কে ভারতের আসল ইমেজ তুলে ধরেছে আর কে ধরেনি, কালের যাত্রায় সময়ই তার সঠিক রায় দিয়ে দিয়েছে যথা সময়ে।
বিশ্ব বরেণ্য বিশাল মাপের এই বাঙালির জন্ম মাসে তার প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ প্রণতি।
মায়ামি, ফ্লোরিডা। [email protected]
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।