স্বপ্ন আঁকি চারটা দেয়াল জুড়ে
ঠিক কবে থেকে রাজনৈতিক জ্ঞান শুরু হয়েছে মনে নেই আমার। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের শুরুতে হবে হয়তো। শুধু এটুকু মনে আছে সেই সময় থেকেই দেখছি উলটো স্রোতে এক অন্তহীন কালো অন্ধকারের দিকে দিগ্ভ্রান্ত জাহাজের মত ভেসে যাচ্ছে প্রিয়তম স্বদেশ আমার। ধোপার গাধার মত বিদঘুটে বিরক্তিকর চেহারার এক বেহায়া স্বৈরশাসকের নিরন্তর নির্লজ্জ ভাণভণিতা থেকে এর সূত্রপাত। তারপর থেকে চোখের সামনেই দেখেছি কীভাবে বাংলাদেশ নামের এক দেশ প্রতিক্রিয়াশীলতার আখড়াভূমিতে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন। আমাদের আগের প্রজন্ম যারা তাদের তরুণ বা যুবক বয়স পার করেছেন ষাট বা সত্তরের দশকের শুরুতে তাদের কাছে সেই সময়ের যে গল্প শুনি সেগুলোকে অলীক কোন রূপকথা বলে ভ্রম হয়। আসলেই কী ওই রকম আলো ঝলমল কোন স্বর্ণময় সময় আমাদের ছিল? আসলেই কি স্বপ্নের পথে পথে হেঁটেছেন তারা? তাহলে আজ কেন এত নিকষ কালো অন্ধকার? কেন তবে অকারণে ভূতলের দিকে অন্তহীন অধঃপতিত গমন? নাকি চলে যাওয়া দিন ভাল, সেই রকম অর্থহীন নস্টালজিয়ায় ভুগে থাকেন আমাদের আগের প্রজন্মের লোকজনেরা। আর সেই নস্টালজিয়ার উপজাত হিসাবে মিথ্যা মায়াবী সময় উপহার দেন আমাদেরকে আফসোস করার জন্য।
ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে এমন দেশের সংখ্যা পৃথিবীতে খুবই বিরল। এ পর্যন্ত হাতে গোনা সামান্য কয়েকটা সৌভাগ্যবান দেশ মাত্র এধরনের সাফল্য দেখিয়েছে। সেই অসাধারণ সৌভাগ্যবান কয়েকটা দেশের মধ্যে আমরাও একটা। এ কথা ভাবতেই বুকের মধ্যে এক ধরনের অহংকারবোধ জেগে উঠে। মুক্তিসংগ্রাম এমনই এক সংগ্রাম যেখানে দেশপ্রেমকে কেচে নিংড়ে বের করে আনা হয় পরানের গহীন গহন থেকে। দেশপ্রেমিক আর বিশ্বাসঘাতকের চেহারা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায় দিনের আলোর মত। আমাদের দেশেও হয়েছিল তা। মন্দ কপাল আমাদের। দেশ স্বাধীনের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই ভেদাভেদ বিলীন হয়ে গিয়েছিল অতি দ্রুত। শুধু বিলীন হয়েছে বললে আসলে কম বলা হয়। দেশপ্রেমিক আর অদেশপ্রেমিকের অবস্থানটাই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে অল্পদিনের মধ্যেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে চরমভাবে পরাজিত প্রতিপক্ষ যে এরকম বীর বিক্রমে ফিরে আসতে পারে সেটা বাংলাদেশে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এক সময় যারা প্রাণভয়ে ইঁদুরের মত গর্তে লুকিয়েছিল, আজ তাদের হাঁকডাক শোরগোলে সেই সময়কার বিজয়ীদেরই ত্রিশঙ্কু দশা। যারা আতুর ঘরেই গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে, তারাই এখন ঘুরে বেড়ায় পতাকা লাগানো গাড়িতে করে। তাদের রক্তবীজেরা আজ কত সহজেই লাঞ্ছিত করে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। দুর্ভাগ্য আমাদের। সেই সব পুরনো রাজাকারদের আস্ফালন এবং নব্য রাজাকারদের বিজয়োল্লাস এখন প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে আমাদেরকে।
এরকমতো হওয়ার কথা ছিল না। একাত্তরে একটা প্রজন্মের অসংখ্য তরুণ তাদের জীবন বাজি রেখেছিল নিজেদের একটি দেশের জন্য। যে বয়সে প্রেমিকার হাতে হাত রেখে গল্প করার কথা, চোখে চোখ রেখে কবিতা আওড়ানোর কথা, সেই বয়সে তারা দেশের জন্য হাতে তুলে নিয়েছিল মারাত্মক মারণাস্ত্র। গভীর প্রত্যয় নিয়ে অসীম সাহসে তেজী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শত্রুর চোখে। একটা প্রজন্মের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ফসল যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ কি আমাদের এই বর্তমান সাম্প্রদায়িকতায় দুষ্ট, প্রতিক্রিয়াশীলতার উর্বর ক্ষেত্রভূমি? যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধ করেছিল, সেই বাংলাদেশ কি এখন আর অবশিষ্ট আছে? অন্যদের কি মনে হয় জানি না। তবে আমারতো মনে হয় সেটা আর সেই বাংলাদেশ নেই। রাষ্ট্র মানে যদি হয় শুধু ভৌগোলিক সীমানা, পতাকা আর একটি নাম তাহলে হয়তো আছে। আর তা যদি হয় একটি নির্দিষ্ট আদর্শের নাম, একটি নির্দিষ্ট চরিত্রের নাম, হাজারো ইচ্ছাকে মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়িয়ে দেওয়ার খোলা আকাশ, তাহলে বলবো সেই বাংলাদেশ আমরা হারিয়ে ফেলেছি বহু আগেই। জন্মের অনতিবিলম্বেই অকাল মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে সেই অভাগা বাংলাদেশকে। এখন যেটা আছে সেটা পড়ে থাকা কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু নয়। এখনো যে সব মুক্তিযোদ্ধারা জীবিত আছেন তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, এই বাংলাদেশ তার চেয়েছিলেন। এই বাংলাদেশের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়েছিলেন তারা একদিন। এই বাংলাদেশের জন্ম দিতে গিয়ে অকালে পরপারের পথে যাত্রা করেছে তাদের অনেক তরুণ বন্ধু। জানি পারবেন না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশু বাংলাদেশ যে চারটি মৌলিক ভিত্তির উপর গড়ে তুলেছিল তার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে তার তিনটিই এখন বিতারিত বাংলাদেশ থেকে। যে রাষ্ট্রের চারটি মূল ভিত্তির তিনটিই পাল্টে যায় তার জন্মের মাত্র দশ বছরের মধ্যে সেই রাষ্ট্রকে মৃত রাষ্ট্র ভাবা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সত্যি সতিই কষ্টকর।
অথচ কি অমিত সম্ভাবনা নিয়েই না শুরু হয়েছিল এর জন্ম প্রক্রিয়া। ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, উদার এবং জনকল্যানমুখী রাষ্ট্র গড়ে উঠার সমস্ত অনুকূল উপাদান চারিদিকে ছড়ানো ছিল রাশি রাশি। অনাগত সেই রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টারাও ছিলেন একেকজন মহান মানুষ। তারা তাদের বুকের সমস্ত ভালবাসা দিয়ে একটি আধুনিক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক এবং কল্যানকামী রাষ্ট্রের সমস্ত উপাদান সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন সেই শিশু রাষ্ট্রের ধমনীতে। সেই স্বপ্নদ্রষ্টারা অসাধারণ যে কাজ করেছিলেন তার তুলনা পৃথিবীতে মাত্র একটি দেশে খুঁজে পাওয়া যায়। সে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত মহান ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন তারাও ঠিক একই কাজ করেছিলেন। যদিও আজকের যুক্তরাষ্ট্র অনেকখানিই সরে গেছে তাদের গড়ে দেওয়া সেই আদর্শ থেকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় আমাদের সরে যাওয়াটা দারুণভাবে লক্ষ্যণীয়। আমরা শুধু মূল আদর্শ থেকে সরে যেয়েই ক্ষান্ত হইনি। একেবারে উলটো দিকে গিয়ে যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছি আগেরকার মূলনীতির সাথে। এই উলটো রথের যাত্রাই যদি হবে তাহলে তাহলে খামোখা কি দরকার ছিল এত রক্তক্ষয় করে দেশ স্বাধীন করার? পাকিস্তানের ভাবাদর্শই যদি এত কাম্য, এত পছন্দের, তাহলে এত ঢং ঢাং করে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল?
পরম মমতায় হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে একদিন যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যে ভূমিষ্ঠ করিয়েছিলেন নবজাতক বাংলাদেশকে, তাদের প্রত্যেকেই জীবন দিয়ে এর ঋণ শোধ করতে হয়েছে পাই পাই করে। না কোন বাইরের শত্রু এসে হত্যা করেনি তাদের। আমাদের জাত ভাইরাই প্রবল আক্রোশে তাদেরকে সবংশে নির্বংশ করে ছেড়েছে। পৃথিবীতে এও এক বিরল ঘটনা। সদ্য স্বাধীন কোন দেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী প্রধান সব নেতাকে হত্যার রেকর্ড তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোথাও পাবে না কেউ। আর কি আশ্চর্যজনক ঘটনা! রাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তি দিয়ে রক্ষা করেছে সেই হত্যাকারীদের। পুরস্কৃত করেছে তাদেরকে বৈষয়িক সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে। অনুগত প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে মিথ্যাচার করে করে রাষ্ট্রীয় বীর বানিয়েছে তাদেরকে। আমাদের মেরুদণ্ডহীন মোসাহেব আদালতও রাষ্ট্রের এই কুকর্মের সাথে বড় কুৎসিতভাবে তাল মিলিয়ে গেছে আগাগোড়া ।
এখন পর্যন্ত যা বলেছি তাতে কেউ যদি ভেবে বসেন যে, আমি একজন চরম নৈরাশ্যবাদী তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না কিছুতে। তবে এইটুকু বলে রাখি আমি মোটেও নৈরাশ্যবাদী লোক নই। অন্তরের খুব গভীরে অতি যত্নে আশার বাতি জ্বালিয়ে রেখেছি ঠিকই টিপটিপ করে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়েছে অনেক দিন ধরেই। তার বদলে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি এখন। যতক্ষণ জেগে থাকি নিরন্তর স্বপ্নের জাল বুনে যাই নিজস্ব ভূবনে। আমাদের প্রাচীণ পূর্বপুরুষেরা তাদের স্বপ্নকে এঁকে যেতেন গুহার দেয়ালে দেয়ালে। তাদের সেই সব স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা। আর এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল মানব সভ্যতা। যার স্বপ্ন নেই, তার কোন অতীত নেই, নেই কোন বর্তমান এবং ভবিষ্যত। তার কোন বাস্তবতাও নেই। স্বপ্ন থেকেই সূত্রপাত হয় বাস্তবের। মনে মনে আশা রাখি, একদিন আমার সন্তান জানবে আমার স্বপ্নের কথা। তার কাছ থেকে জানবে তার সন্তানেরা। আমার মত আরো হাজারো লোক হয়তো আমার মতোই গভীর বিশ্বাসে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সন্তানদের মধ্যে। এভাবেই আমাদের সম্মিলিত স্বপ্ন একদিন ছড়িয়ে পড়বে উত্তরপুরুষের কাছে। তারা জানবে তাদেরই কোন অদেখা পূর্ব পুরুষেরা স্বপ্ন দেখেছিল একটি স্বপ্নময় দেশের। রক্ত আর প্রাণ ক্ষয় করে তারা বাস্তবে জন্মও দিয়েছিল সেই দেশের। কিন্তু নিজেদের কিছু ব্যর্থতায় এবং পরাজিত প্রতিপক্ষের ধূর্ততায় অচিরেই হারিয়ে ফেলেছিল সেই স্বপ্নের দেশকে।
আমাদের বাবা চাচারা তাদের বহু ত্যাগ তিতিক্ষায় জন্ম দিয়েছিলেন যে দেশের, আমরা আমাদের জীবদ্দশায় তাকে উদ্ধার করতে পারি নাই নেকড়েদের ভয়াল হাত থেকে। আমাদেরই কোন এক অনাগত প্রজন্ম একদিন হয়তো ঠিকই উদ্ধার করে ছাড়বে হারানো সেই দেশকে।
সেই আশাতেই কালস্রোতে আশার তরী ভাসাই আগামির টানে। সেই আশাতেই ক্রমাগত স্বপ্ন এঁকে যাই চারটা দেয়াল জুড়ে।
মায়ামি, ফ্লোরিডা [email protected]
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।