ট্যাজার গানঃ পুলিশের হাতে নয়া মারণাস্ত্র
ফরিদ আহমেদ 

আজকের মায়ামি হেরাল্ডে চোখ বুলাতেই খবরটা চোখে পড়লো। পুলিশের ছোড়া ট্যাজার (TASER) গানের আঘাতে এক তরুন গত রাতে মারা গেছে। রাত দুইটার দিকে ইউনিভার্সিট অব মায়ামির কাছাকাছি অবস্থিত একটি কনডোমোনিয়ামে হাতাহাতির খবর পেয়ে পুলিশ হাজির হয়। তরুনটিকে উশৃঙ্খলতার কারণে একজন নিরাপত্তাকর্মী তাকে বিল্ডিং থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। মায়ামি-ডেড কাউন্টির ডিটেকটিভ কার্লোস মাউরা জানান যে, ওই তরুন এতই আক্রমণাত্মক ছিল যে তাকে গ্রেফতার করার আগে নিয়ন্ত্রন করতে যেয়ে পুলিশকে বাধ্য হয়ে ট্যাজার গান ব্যবহার করতে হয়। ট্যাজার গানের আঘাতে তরুনটি নিথর হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত কোরাল গ্যাবলসের ডক্টরস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে কর্তব্যরত চিকিসকরা তাকে মৃত ঘোষনা করে।  

ট্যাজারের আঘাতে অজ্ঞাতনামা এই তরুনের মৃত্যুর সাথে সাথে ট্যাজার গান নিয়ে চলমান বিতর্ক আরো একধাপ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসেও গেইন্সভিলে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডায় সিনেটর জন কেরীর অনুষ্ঠানে এক উত্তেজিত ছাত্রকে সামাল দিতে যেয়ে ট্যাজার গান ব্যাবহার করেছিল পুলিশ। ইউটিউবের এই লিংকে ক্লিক করে সেই ঘটনা দেখে নিতে পারেন আপনারা।  

http://www.youtube.com/watch?v=6bVa6jn4rpE 

এর পর নভেম্বরে জ্যাকসনভিলে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে পুলিশের ট্যাজারর গানের আঘাতে মারা গেছে দুই ব্যক্তি। ট্যাজার গানের আঘাতে মৃত্যু শুধুমাত্র ফ্লোরিডাতেই সীমাবদ্ধ নয়। অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী ২০০১ সালের জুন মাস থেকে এপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ট্যাজার গানের আঘাতে মৃতের সংখ্যা ২৮০ ছাড়িয়ে গেছে। ক্যানাডাতেও এ পর্যন্ত পুলিশের ট্যাজার গানের আঘাতে মারা গেছে জনা বিশেক লোক। 

ট্যাজার হচ্ছে ইলেক্ট্রো শক অস্ত্র। দূর থেকে সাবজেক্টকে শারীরিকভাবে বিকল করে দেওয়ার জন্য এটি গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা ও ক্যানাডার বিভিন্ন পুলিশবাহিনী ব্যাবহার করে আসছে। ট্যাজারের আসল নাম হচ্ছে “Thomas A. Swift’s Electric Rifle”. আরিজনার বিজ্ঞানী জ্যাক কভার (Jack Cover) ১৯৬৯ সালে এটার ডিজাইন করেন এবং সাইন্স ফিকশন চরিত্র টিন এজার উদ্ভাবক এবং এডভেঞ্চারার টম সুইফট এর নামে এর নামকরণ করেন। পুলিশ মূলতঃ M-26 এবং X-26 মডেল ব্যবহার করে থাকে। ট্যাজার কম কারেন্টের (.02 apm) ৫০০০০ ভোল্ট ঢুকিয়ে দেয় মানব শরীরের কোন বিশেষ অংশে। ফলে শরীরের বিদ্যু শক্তি বলয়ে বিঘ্ন তৈরি করে মাংসপেশীকে অসাড় করে দেয়। পালানোর চেষ্টাকারী, পুলিশের সাথে লড়াইকারী বা সম্ভাব্য বিপজ্জ্বনক আসামীদের কব্জ্বা করার জন্য পুলিশ কম মারাত্মক বা নিরীহ অস্ত্র হিসাবে এটা ব্যবহার করা শুরু করেছে।  

চিত্রঃ ট্যাজার গান X-26 এবং M-26 

তবে যতই কম মারাত্মক বা নিরীহ মনে করা হোক না কেন ট্যাজারের আঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন কিন্তু বেড়েই চলেছে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের (ACLU) ম্যানেজিং এটর্নি পিটার এলিয়াসবার্গ (Peter Eliasberg) এর মতে, ট্যাজারকে বিনা যন্ত্রণায় লোকজনকে নিয়ন্ত্রনে আনার কোন গোবেচারা টাইপের বিষয় ভাবাটা বড় ধরণের ভুল। ট্যাজার অবিশ্বাস্য রকমের সহিংস হতে পারে এবং এর ফলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ক্যাস্ট্রো ভ্যালির এডেন মেডিক্যাল সেন্টারের কার্ডিওপালমোনারি সার্ভিসের ডিরেক্টর রবিন গর্ডন বলেন যে, যাদের হার্টে সমস্যা আছে বা অষুধের কারণে যাদের হার্টবিট অনিয়মিত তাদের ক্ষেত্রে ট্যাজার গানের ইলেক্ট্রিক শক সমস্যা তৈরি করতে পারে। পুলিশ যদি ভেবে থাকে যে ট্যাজারের ব্যবহার পুরোপুরি নিরাপদ, তবে তাদের ধারণা যে সঠিক নয় সেটা বলে দেওয়া যায় নিশ্চিত করেই।  

অন্যদিকে ট্যাজারের উদ্ভাবক ট্যাজার ইন্ট্রন্যাশনালের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিভ টাটলের দাবী হচ্ছে যে, কোন মেডিকেল পরীক্ষাতেই এটা প্রমাণিত হয়নি যে কোন মৃত্যুর জন্য ট্যাজারই একমাত্র দায়ী। গত আঠারো মাসে ট্যাজার ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে পাঁচটি মৃত্যু বা আঘাতের মামলা খারিজ হয়ে গেছে। টাটল ট্যাজারের এই নেতিবাচক ইমেজ তৈরির জন্য বাংলাদেশের বিগত বিএনপি সরকারের মত মিডিয়াকে দায়ি করেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, ট্যাজার কি করতে পারে বা কি করতে পারে না সে সম্পর্কে লোকজনের পুরোপুরি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তবে এর জন্য জনগণ পুরোপুরি দায়ী নয়, কেননা বিদ্যু খুবই জটিল বিষয়। লোকজনের বিদ্যু সম্পর্কে সহজাত ভীতি রয়েছে। কাজেই যখনই তারা শোনে যে ট্যাজার ৫০০০০ ভোল্টের শক দেয় তখনই তারা আতংকিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা জানে না যে ভোল্ট হচ্ছে অর্থহীন বিষয়।‘ 

জাতিসঙ্ঘের একটি কমিটি ট্যাজারের ব্যবহারকে একধরনের অত্যাচার হিসাবে অভিহিত করেছে এবং বলেছে যে এটা জাতিসঙ্ঘের কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কমিটি তার স্টেটমেন্ট এ বলেছে যে, ট্যাজার X26 এর ব্যবহার নিদারুন ব্যথা তৈরি করে যা একধরণের নির্যাতন এবং কিছু নির্ভরযোগ্য পরীক্ষায় দেখা গেছে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর কারণে মৃত্যুও হতে পারে। ক্যানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ ভ্যাংক্যুভার এয়ারপোর্টে আরসিএমপির ট্যাজার গানে আঘাতে একজন যাত্রীর মৃত্যুর পর ট্যাজারের বিষয়ে দ্বিতীয় চিন্তা শুরু করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে এটা নিষিদ্ধ করার জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রবল দাবী উঠেছে।  

জ্যাকসনভিলে পুলিশের ট্যাজার গানের আঘাতে ক্রিস্টিয়ান আলেন নামের এক লোক মারা যাওয়ার পরে এক ব্যক্তি তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এভাবে, 

কর্তৃপক্ষ দাবী করেছে যে আলেন পুলিশকে ধাক্কা মেরেছে। কাজেই পুলিশ তাকে খুন করেছে। ট্যাজার হচ্ছে হত্যাকারী। পুলিশ তাদের দায়িত্ব ঠিকমত করতে চায় না বলেই তারা ট্যাজারকে সমর্থন করে। যারা তাদেরকে বিরক্ত করে তাদেরকে নির্যাতন করার জন্য ট্যাজার খুবই সুবিধাজনক। কে বাঁচলো না কে মরলো তাতে তারা থোড়াই কেয়ার করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, যে লোকগুলো ছোটবেলায় জীবজন্তুকে অত্যাচার ও হত্যা করে আনন্দ পেতো তাদেরকেই পুলিশ বাহিনীতে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে আমাদেরকে নির্যাতন আর খুন করার জন্য।    

বাংলাদেশ থেকে যখন আমি নর্থ আমেরিকায় প্রথম আসি তখন যে পার্থক্যটি সবচেয়ে বেশী চোখে পড়েছিল তা হচ্ছে পুলিশের ভূমিকা। বাংলাদেশে থাকতে পুলিশকে যে তীব্র ঘৃণা আর চরম অবজ্ঞা ছাড়া অন্য কিছু যে করা যায় সে বিষয়ে কখনই মাথায় আসেনি। পুলিশের মূলমন্ত্র পুলিশ জনগনের বন্ধু এই কথা দেশের সাধারণ মানুষতো দূরের কথা স্বয়ং পুলিশ বাবাজ়ীরাও মনে হয় বিশ্বাস করে না একবিন্দু। কিভাবে লোকজনকে বাঁশ দেওয়া যায় সেই চিন্তাতেই ব্যস্ত আমাদের ঠোলাবাহিনী। বাঘে ছুলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা এই প্রবাদ বাক্যকে আক্ষরিক অর্থে সত্যি বলে মেনে নিয়ে ঠোলাদের কাছ থেকে শত হাত দূরে সরে থেকেছি আমি সবসময়। কিন্তু এখানে আসার পর আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম যে, পুলিশও মানুষের সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে। পুলিশ এখানে মানুষের চোখে গভীর শ্রদ্ধার আসনে আসীন একজন মানুষ। দেশে যে রকম পুলিশ দেখলেই বুক কেঁপে উঠতো অজানা আশংকায়, এদেশে সেখানে পুলিশ দেখলে উলটো মনের মধ্যে সাহস সঞ্চার হয়। কোন বিপদে আপদে মানুষ গভীর বিশ্বাসে সবচেয়ে আগে ছুটে যায় পুলিশের কাছে। আমিও খুব যত্নে বুকের মধ্যে সেই বিশ্বাসটুকু লালন করে যাচ্ছিলাম এতদিন। 

আমার সেই বিশ্বাসের জায়গাটুকু কি একটু হলেও টলে যাচ্ছে না? 

 

মায়ামী, ফ্লোরিডা।

[email protected] 

===============================================

মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।