পা পিছলে আলুর দম
-হামানদিস্তা
জন্ম-জন্মান্তরের ‘ভেতো বাঙ্গালী’ অপবাদ ঘুচাইতে হইবে। জেনারেল সাহেব এইবার বাঙ্গালীদের আলু খাওয়াইবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যদের দৈনিক একশত পঁচিশ গ্রাম আলু খাওয়া বাধ্যতামুলক করিয়াছেন। ইহাতে তাহাদের বুদ্ধিসুদ্ধি হাঁটুরও নীচে নামিয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে। আলু মাটির নীচে হয়, মাটির নীচের জিনিষ বেশী খাইলে বুদ্ধিও নাকি নীচের দিকে নামিয়া যায়।
কিন্তু দেশের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করা বুদ্ধির ঢেঁকি সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য। বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুটা লোপ পাইলেও দেশের কল্যানের খাতিরে আলু খাওয়া চালু করিতেই হইবে। ভাত খাওয়া বাদ দিতে হইবে। ব্লাডি সিভিলিয়ানদেরও আলু ধরিতে হইবে। ভাত খাইয়া খাইয়া তাহারা অলস হইয়া পড়িয়াছে। কে না জানে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বাঙ্গালীর অলস মস্তিষ্কই দায়ী। এক-এগারোর আগেই দেশে সাড়ে-এগারোটার ঘন্টাধ্বনি বাজিয়া গিয়াছিল, দেশপ্রেমিক জলপাই বাহিনীর (এখন হইতে আলু বাহিনীও বলা যাইতে পারে) সমর্থনে আই, এম, এফ (ইয়াজুদ্দিন, মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিন) সরকার ক্ষমতা লওয়ায় দেশ বারোটা বাজার হাত হইতে রক্ষা পায়।
এক-এগারোর আগে দুই বেগমের ঝগড়া-ঝাঁটি তুঙ্গে উঠিয়াছিল। ঐ সময়ে খাবার-দাবারের দাম একটু বেশী থাকিলেও ভাতের খুব একটা অভাব ছিল না। তাই মানুষ নির্বাচন লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিল। খায় ভাত আর চায় পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র!
রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াজুদ্দিন সেনাপ্রধান মঈনুদ্দিনের ধমক খাইয়া ফখরুদ্দিনকে বানাইলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিন প্রধানের হস্তক্ষেপে ঘড়ির কাঁটা থমকিয়া দাড়াইল। বারোটা আর বাজিল না, দেশবাসী বাঁচিয়া গেল। কিন্তু প্রথম চোটেই যত তোড়-জোর গরীব বস্তিবাসী আর খুচরা ব্যবসায়ীদের উপর দিয়া যাইতে দেখিয়া নিন্দুকেরা বলিল গতিক সুবিধার নহে। আই, এম, এফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারী ফান্ড) যেমন সাহায্যের দেখা নাই, শর্ত দেয়ার ওস্তাদ, এই সরকারও দেখি নামেও যেমন কামেও তেমন, ভাত দেবার বেলায় নাই, কিল মারার গোঁসাই।
কিন্তু দেশকে বারোটা বাজার হাত হইতে রক্ষা করিতে হইলে, সিভিলিয়ানদের একটু টাইট দিতেই হইবে। এইজন্যই ব্যারিস্টার ম,হো, চৌধুরী মহা হৈচৈ করিয়া দুই বেগমকে মাইনাস করার প্রক্রিয়া শুরু করিয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, দুই বেগম মাইনাস তো হইলেনইনা, মনে হইতেছে মাইনাসে মাইনাসে আরো বেশী প্লাস হইয়া জাঁকাইয়া বসিয়াছেন। পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিনই দেখা যায় তাহাদেরই খবর। মাঝখান দিয়া ব্যারিস্টার ম,হো, চৌধুরীসহ পাঁচজন উপদেষ্টা মাইনাস হইয়া গেলেন। তাতে কি, আরও পাঁচজন প্লাস হইয়া আসিলেন।
কিন্তু অবস্থাটা কেমন যেন বেগতিক হইয়া যাইতেছে। বাজারে চাল পাওয়া যাইতেছেনা, ব্লাডি সিভিলিয়ানরাও ফিসফাস, ফোঁসফাঁস শুরু করিয়াছে। খাদ্য উপদেষ্টা তাহাদেরকে ডায়েট করার উপদেশ দিয়াছেন। সেই উপদেশ পাইয়া খুশী হওয়াতো দুরের কথা, গাধা সিভিলিয়ানগুলি যেন আরও ক্ষেপিয়া গেল। বিনাপয়সায় এত সুন্দর ডায়েট প্রোগ্রাম কে কবে কাহাকে দিয়াছে? আরে বাবা, উপদেশ না হয় সুবিধার হয় নাই, ঠাট্টা-মস্করা হিসাবেতো খারাপ কিছু ছিলনা। দুঃখের বিষয়, দেশের মানুষের হাস্যরসজ্ঞানও কমিয়া গিয়াছে। বাজারে চালের দাম কমাইতে না পারিলেও আই, এম, এফ, সরকার লোক হাসাইতে পারেন, ইহাই উপদেষ্টা মহোদয় প্রমান করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু কোনটাই হইলোনা। মনে হইতেছে, সরকারকে এখন বাছিয়া বাছিয়া দেশের সেরা কমেডিয়ানদের মধ্য হইতে উপদেষ্টা নিয়োগ করিতে হইবে।
তবে কবে কমেডিয়ান নিয়োগ হইবে, সেইজন্য বেশিদিন বসিয়া থাকা যায়না। তাই জেনারেল সাহেব নিজেই মাঠে নামিয়াছেন। তিনিও কিঞ্চিত লোক হাসাইতে পারেন বৈকি। ইতিপূর্বে কাদম্বিনীর কথা, ঘোড়া উড়াইবার গল্প বলিয়া বেশ সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন।
এইবার বলিলেন, আল্লা আমাদের পরীক্ষা করিতেছেন। অবশ্য বেশির ভাগ মানুষ ধরিতে পারেনাই ইহাতে হাসির কি আছে! তাই কেহ কেহ হাসিল, বেশির ভাগই কাঁদিল। পরীক্ষায় ফেল মারিলে আমাদের কি অবস্থা হইবে ভাবিয়া আকুল হইল। জেনারেল সাহেব দেশবাসীকে আস্বস্ত করিলেন, আমরা 'সিডরের’ পরীক্ষায় জিপিএ পাঁচ পাইয়া পাশ করিয়াছি, অতএব চিন্তার কোন কারন নাই।
এখন আল্লাতালা চালের দাম বাড়াইয়া দিয়া, দেশ হইতে চাল উধাও করিয়া দিয়া আমাদের আবার পরীক্ষা করিতেছেন। জেনারেল সাহেব মুচকি হাসিয়া বলিলেন, ইনশাল্লা এইবারও আমরা সফলতার সহিত উত্তীর্ণ হইব। মনে মনে বলিলেন, এই গাধাগুলি কোনদিনও হাসি-ঠাট্টা বুঝিবেনা।
জেনারেল সাহেবের যে ফেরেশতাদের সহিত দহরম-মহরম আছে তাহা আর জানে কয়জনে? এইতো কিছুদিন আগে মক্কা-আজমীরও ঘুরিয়া আসিয়াছেন আমাদের সেনাপতি সাহেব। তিনি আগেভাগেই আল্লাতালার বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাদের ঘুষ দিয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করাইয়াছেন। তাই আর চিন্তা নাই। জেনারেল সাহেব দেশবাসীকে সেই অনুযায়ী সাজেশান দিয়াছেন, আল্লাতালার এই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করিতে হইলে, বেশী বেশী আলু খান। তিনি শুধু বলিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, সংবাদপত্রের সম্পাদকদের ডাকিয়া লইয়া বেশুমার আলু খাওয়াইয়াছেন। বলিয়াছেন তিনি দেশে আলু বিপ্লব শুরু করিতে চাহেন এবং এইজন্যই দেশের সদাশয় সরকার তাহার চাকুরীর মেয়াদ আরো এক বছর বাড়াইয়া দিয়াছে। অনিচ্ছাসত্বেও দেশের স্বার্থে তাহাকে আলু বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব আরো এক বছর অতিরিক্ত পালন করিতে হইবে। ইহাতে নীরব দুর্ভিক্ষ সরব হইবার সুযোগ পাইবেনা, হিডেন হাঙ্গার হিডেনই থাকিয়া যাইবে। সেনাবাহিনীর সাথে সাথে দেশবাসীর বুদ্ধিও কিছুটা নিম্নগামী হইবে বটে তবে তা দেশের স্বার্থেই।
তাই বর্ষবরণ উৎসব শেষ না হইতেই জেনারেল সাহেবের উৎসাহে মহাসোমারহে আলু উৎসবের আয়োজন করা হইয়াছিল সেনা-নিয়ন্ত্রিত রেডিসন হোটেলে। সেখানে সেনাবাহিনীর বাহাদুর বাবুর্চিরা আলুর রকমারি পদ রন্ধন করিয়া পরিবেশন করিয়াছেন। আলুর দম, আলুভর্তা, আলুভাজি কিছুই বাদ ছিল না।
আলু পশ্চিমা ধাঁচের খাবার, তাহাতে কি! নিজস্ব ধারায় মরিচ-মশলা না হয় একটু বেশীই দিতে হইবে।
ঊনিশে এপ্রিল, ২০০৮