সাম্প্রতিক ভাবনা – মায়ানমারের মানুষেরা
ইরতিশাদ আহমদ
অং সান সূ কী গৃহবন্দী আজ ষোল বছর ধরে, সামরিক জান্তার আদেশে । অপরাধ ? জনগণের সমর্থনে নির্বাচনে জয়লাভ । অষ্টাশির ছাত্র আন্দোলনের পর নব্বইয়ের নির্বাচনে সু কী’র দল জেতে শতকরা আশি ভাগেরও বেশী ভোট পেয়ে । কিন্তু নির্বাচনে জেতা আর জনগণের হাতে ক্ষমতা আসা যে এক কথা নয় আবারও তার প্রমাণ মিললো নব্বইয়ের বার্মায় ।
সেই বাষট্টি থেকে বার্মা, আজকের মায়ানমার, সামরিক শাসনের যাঁতাকলে আবদ্ধ । সামরিক শাসন (সরাসরি কিংবা ছদ্মবেশী মিলিটারী নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রক্ষমতা) যে একটা রাষ্টের উন্নতির পথে কতটা মারাত্মক অন্তরায় হতে পারে, তা মায়ানমারের দিকে তাকালেই খুব ভালোভাবে বোঝা যায় । স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে পড়লে একটা দেশের অর্থনীতির কি শোচনীয় দশা হতে পারে মায়ানমার হচ্ছে তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।
প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের দেশ মায়ানমার সমৃদ্ধশালী “আসিয়ান” জোটভুক্ত । এই জোটের দশটি দেশের মধ্যে জিডিপির হিসেবে মায়ানমারের অবস্থান সবার শেষে । অথচ একসময়ে, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে, এই দেশটিকে এশিয়ার অন্যতম সম্পদশালী দেশ হিসেব গণ্য করা হতো । আজ পৃথিবীর দরিদ্রতম বিশটি দেশের মধ্যে মায়ানমার একটি । জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বছরে মাত্র তিন পারসেন্ট । ইনফ্লেশন রেট বছরে একুশ পারসেন্টেরও বেশী । বাৎসরিক মাথাপিছু আয় দু’শো মার্কিন ডলারেরে মতো, পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ডের প্রায় দশভাগের একভাগ । এমন কি বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ও মায়ানমারের প্রায় দ্বিগুণ ।
ঊনিশশো বাষট্টিতে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী এ দেশটির ক্ষমতা দখল করে । তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মায়ানমার আর উন্নতির মুখ দেখে নি । যদিও অষ্টাশির তুলনায় সেনাবাহিণীর আয়তন বেড়েছে দ্বিগুণ; সংখ্যার হিসেবে এখন চার লাখেরও উপরে । মায়ানমারের জনগণের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধে রত এই বাহিনীর পেছনে সরকারী বাজেটের শতকরা চল্লিশ ভাগ খরচ হয় । সামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রায় সব সরকারী সংস্থাগুলির কর্ণধারদের পদগুলি দখল করে আছে । এমন কি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসা-বানিজ্যগুলিও নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই । ব্যবসায়ীদের সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করার কোন উপায়ই নেই । চালের ব্যবসাও মিলিটারী নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের হাতে ।
এই যে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে সামরিক জান্তা মায়ানমারের গণমানুষের ওপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে যেতে পারলো; জাতিসংঘ থেকে শুরু করে দুনিয়ার বাঘা বাঘা পরাশক্তিগুলি যে কিছুই করতে পারলো না, বা করলো না, তাই বা সম্ভব হল কি করে ? এর কারণ বুঝতে হলে উত্তর খুঁজতে হবে এই প্রশ্নের - পরাশক্তিগুলি আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করে, নিপীড়িত অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের না কি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর, যারা তাদের লুটের বখরাদার, ব্যাবসার পার্টনার । উত্তরটা সোজা, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই । লোক দেখানো মৃদু ধমক, এই যেমন মার্কিন সরকারের স্যাংশন, এতে কোন কাজ হওয়ার কথা নয় । যেমন হয়নি গত পনেরো বছর ধরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের পরপর নেয়া ষোলটি রেজুলেশনেও (দেখুন, ডেসমন্ড টুটু এবং অমর্ত্য সেন ২০০৬)। মায়ানমারের সামরিক জান্তা চরম স্পর্ধাভরে জাতিসংঘের কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করে আসছে । পরাশক্তিগুলি দেখেও না দেখার ভান করে আছে ।
বস্তুত সামরিক বাহিনীর এতদিন ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারার পেছনে এটাই মূল কারণ । ভারত ও গণচীন হচ্ছে মায়ানমারের সামরিক জান্তার প্রধান ব্যাবসায়িক পার্টনার । কথায় বলে খুঁটির জোরে ছাগল নাচে । তো, মায়ানমার সরকারের খুঁটিগুলি কোথায় পোঁতা আছে তা মোটামুটি সবারই জানা হয়ে গেছে সাম্প্রতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কোন দেশের কি ভূমিকা তা দেখে । দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, এবং সিঙ্গাপুরের অগণতান্ত্রিক কিংবা মেকী গনতন্ত্রের ধ্বজাধারী সরকারগুলোও নির্লজ্জ সাফাই গেয়ে যাচ্ছে মায়ানমারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে ।
সূ কী নন, যেনো বিশ্ববিবেক বন্দী হয়ে আছে ইয়াঙ্গুনের সেই ছোট্ট ঘরটিতে ।
কিন্তু আর কতদিন? মায়ানমারের মানুষেরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ফুঁসে উঠেছে চরম ক্ষোভে । বারুদের গন্ধে আবার ভারী হয়ে উঠেছে মায়ানমারের বাতাস । রুখে দাঁড়ানো মানুষের রক্তে আবার লাল হয়েছে ইয়াঙ্গুনের রাজপথ । নির্ভীক ভিক্ষুরাও যোগ দিয়েছে জনগণের সাথে । দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিই হচ্ছে সাম্প্রতিক গণবিদ্রোহের মূল কারণ । গণমানুষের দীর্ঘদিনের লালন করা অসন্তোষের সাথে যুক্ত হয়েছে ভিক্ষুদের সাথে অবমাননাকর আচরণের প্রতিবাদ ।
ইতিহাস জানাচ্ছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে গণমানুষের প্রতিবাদ শুধু আর্তনাদেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, পরিণত হয় প্রতিরোধে । এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে মায়ানমারের মানুষেরাই । মায়ানমারের জনগণই চিনে নেবে কে শত্রু, আর কে মিত্র তাদের প্রতিরোধের এই সংগ্রামে । শাসকগোষ্ঠীর দোসর বিদেশী শক্তির প্রতিনিধিরা যে তাদের মিত্র হতে পারেনা এটা বুঝতে নিশ্চয়ই মায়ানমারের মানুষদের খুব একটা বেশী সময় লাগবেনা । মায়ানমারের জনগণের জন্য মার্কিনীদের মায়াকান্না যে ভন্ডামী ছাড়া আর কিছুই নয় তা বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না । তাদেরই চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধে নিহত হাজার হাজার ইরাকী জনসাধারণের রক্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত রঞ্জিত । নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য দেশে দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের মদদ দেয়াই এদের কাজ । এদের “জোর যার মুল্লুক তার” নীতির জন্যই প্যালেস্টাইনের জনগণ আজো রাষ্ট্রহারা । আবার এরাই তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে গিয়ে গণতন্ত্রের বাণী নসিহত করে বেড়ান । আমাদের বাংলাদেশেও ইদানীং এদের আনাগোনা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে ।
মায়ানমার বাংলাদেশের পাশেই । ক্ষমতার রাজনীতি প্রসঙ্গে বহূল-প্রচলিত একটা কথা - ইতিহাসের শিক্ষা নাকি এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না । ইতিহাসের শিক্ষা না হোক, পার্শ্ববর্তী একটা দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিশ্চয়ই বর্তমান কালের বাংলাদেশের অনেকেরই মনে শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাতে পারে; একটা বিশেষ অরাজনৈতিক শক্তির রাজনৈতিক উচ্চাশা সংক্রান্ত অযৌক্তিক মোহের অবসান ঘটাতে পারে; উদ্ভব ঘটাতে পারে যুক্তিসংগত উপলদ্ধির । মায়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত সে আশাটাই আমি রাখছি । বাংলাদেশের পরিণতি মায়ানমারের মতো হোক – কাম্য নয় কিছুতেই ।
অক্টোবর ৬, ২০০৭
Desmond M. Tutu and Amartya Sen, The Burmese people deserve our support,
Published: December 21, 2006 http://www.iht.com/articles/2006/12/21/opinion/edtutu.php