ব্যাজসর্বস্বদের খপ্পরে               

 ইরতিশাদ আহমদ

মনে পড়ছে তিরাশির কথা। আমি তখন প্রকৌশল বশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফেব্রুয়ারী মাস। সামরিক বাহিনী আর পুলিশ মিলে অতর্কিতে হামলা চালালো ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও বাদ গেল না তা থেকে। পিটিয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলো থেকে বের করে দেওয়া হলো। কোন রকমের পূর্ব ঘোষনা ছিল না বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের বা হল ছাড়ার। ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকে পুলিশ ধাওয়া করেছিল এমনকি শিক্ষকদেরকেও।  মনে পড়ে একজন পুলিশ অফিসার আমাদের পরিচয় পাওয়ার পর  লজ্জ্বা পেয়ে বলেছিল, আপনারা ব্যাজ পরতে পারেন না? সমাজে সবার অবস্থান যে ব্যাজ দিয়ে নির্ধারিত হয় না এই ব্যাজসর্বস্ব নির্বোধদের তা কে বোঝাবে? 

ঊনিশশো তিরাশি থেকে দুহাজার সাত। দীর্ঘ চব্বিশ বছর। তিরাশিতেই আমি দেশ ছেড়েছিলাম ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। আত্মীয়-পরিজন বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছি বলেতো বটেই, মনটা খারাপ ছিল দেশটা ব্যাজসর্বস্বদের খপ্পর থেকে, স্বৈরাচারের দুঃশাসন থেকে বেরুতে পারছিল না বলে আরও বেশী। 

খুশী হয়েছিলাম নব্বইয়ে, যখন শুনলাম স্বৈরাচারী সরকারের নাটকীয় পতন কাহিনী। ততদিনে আমি পাকাপোক্ত প্রবাসী। দেশের জন্য প্রতিনিয়ত মনটা আকুল থাকলেও, বিদেশে বসে দেশের ঘটনাবলীর সাথে কি আর সেভাবে সম্পৃক্ত হওয়া  যায়? তাই মনটা খুশীতে নেচে উঠলেও স্বৈরশাসকের পতনের সময়কার ঘটনাগুলো নিজ চোখে দেখতে পারছিলাম না বলে আফসোসের সীমা ছিল না। মনে মনে বাহবা দিয়েছিলাম বাংলাদেশের মানুষদের স্বৈরাচারকে রুখে দেয়ার জন্য। শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছিলাম তাদের উদ্দেশ্যে যারা রক্ত আর জীবন দিয়ে জনগণের এই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। পরবর্তীতে স্বৈরশাসকের কারাদন্ড, নির্বাচন, পার্লামেন্টারী ধাঁচের গণতন্ত্র আমাকে কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছিল। মনে হয়েছিল আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, অন্ততঃ যাওয়াতো শুরু করেছি। 

কিন্তু আজ আবার চব্বিশ বছর পর একি দেখছি? কি হচ্ছে আমার স্বদেশভূমিতে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর শুনলাম পুলিশের হাতে প্রহৃত হয়েছেন। তারও কি ব্যাজ দরকার ছিল? ব্যাজধারীদের দৌরাত্ম আবার ফিরে এসেছে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আমরা আবার পেছন দিকে যাত্রা শুরু করেছি। 

গত পনের বছরের (একানব্বই থেকে দুহাজার ছয়) গণতন্ত্র চর্চার নমুনা দেখে মুষড়ে পরেছিলাম আমিও। গণতন্ত্রের বদলে সন্ত্রাসতন্ত্র আর লুটপাটতন্ত্র কায়েমের প্রতিযোগিতাতেই যেন নেমে পড়েছিল দেশের দুটি প্রধান দল। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া নির্বাচনের রাজনীতি যে দুঃশাসনই প্রতিষ্ঠা করে তার প্রমান আমরা দেখলাম বাংলাদেশে পনের বছরের বেসামরিক শাসনামলে। দুটো দলের মধ্যে আদর্শের কোন দ্বন্দ্ব ছিল না, ছিল স্বার্থের দ্বন্দ্ব। স্বার্থের খাতিরে দুটো দলই মৌলবাদ-জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছিল। একটা একটু কম, অন্যটা একটু বেশী। সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তির কাছে কে কতটা নতজানু হতে পারবে তার নির্লজ্জ্ব প্রতিযোগিতায় নেমেছিল এই দুটি দল। পাট শিল্পকে কে কার আগে ধ্বংস করতে পারবে এ নিয়ে যেন এরা বাজী ধরেছিল নিজেদের মধ্যে। অথচ জনগণের কাছে কোন বিকল্প ছিল না; হয় ফুটন্ত কড়াই নয়তো জ্বলন্ত উনুন, একটাই বেছে নিতে হচ্ছিল। তবুও আশা ছিল সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক মানবিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এর মধ্য থেকেই। এভাবেই হোঁচট খেতে খেতেই তো এগিয়ে যাবো আমরা।

 

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমরা ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত উনুন হয়ে এসে পড়েছি এক নরককুন্ডে। আবারো সেই ব্যাজসর্বস্বদের করায়ত্বে সব কিছু। প্রায় দেড় যুগ পরে আমাদের আবার বুঝি শুরু হলো পেছন পানে যাত্রা। তবে বাংলাদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে জানে। তাই আমি আশাবাদী। যাত্রা পেছন  পানে শুরু হলেও দৃষ্টিটা তাদের সামনের দিকেই থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের জন্য বসে থাকেনি। ফুঁসে ঊঠেছে অসম সাহসিকতার সাথে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এমনভাবে ফুঁসে ঊঠতে দেখেছিলাম বাংলাদেশের মানুষকে ঊনসত্তুরে, দেখেছিলাম একাত্তরে। এমন ফুঁসে উঠা দেখেছি নিকট অতীতে কানসাট-শনির আখড়ায়, ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জি বিরোধী আন্দোলনে-যেখানে নেতৃত্বে ছিল সাধারণ জনগণ আর রাজনৈতিক দলগুলো ছিল অনুসারীদের ভিড়ে। 

ইন্টারনেটের কল্যানে পত্রপত্রিকাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের তেজোদীপ্ত মুখচ্ছবি দেখে আমি আবারো আশান্বিত হয়েছি। আমি দেখেছি ওদের চোখে মুখে আগুন জ্বলছে- এ আগুন আমার চেনা, আমি জানি এর ক্ষমতা কত সুদূরপ্রসারী। আমি জানি এ আগুন সহজে নেভানো যায় না। এরা সেই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের ছেলে মেয়েরা-এরা চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ নয়। এরা যখন রাস্তায় নামে তখন জান কবুল করেই নামে। এরা মাথা নোয়াতে জানে না। এরা সেই আটচল্লিশের না বলা ছাত্র-ছাত্রীরা, সেই বায়ান্নর রক্ত দেয়া বরকত-সালামেরা, সেই আটষট্টি-ঊনসত্তুরের আসাদ-মতিউরেরা, সেই একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আর সেই নব্বইয়ের রাজপথ কাঁপানো জনগণের ব্যাজহীন সৈনিকেরা, যারা এক ব্যাজওয়ালা স্বৈরশাসককে টেনে হিচঁড়ে গদী থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। 

নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু হয়েছে। শুনেছি ছাত্র-ছাত্রীদের নির্মমভাবে পেটানো হচ্ছে- শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দেশে একটা মানবিক, সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আবারো এক চড়া মূল্য দিতে হবে আমাদের।

২৪ শে আগস্ট                                                                                         মায়ামী, ফ্লোরিডা