আমার চোখে একাত্তর
(প্রথম পর্ব)
একাত্তরে আমার বয়স ছিল সতের। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজে এইচ, এস, সি-র ছাত্র। ঊনসত্তরে এস, এস, সি পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে ঢুকেছি। অস্থির সময়ের দাবী আর বেপরোয়া তারুণ্যের আবেগ-উচ্ছাস যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ওই বয়স যেন ওইরকম সময়ের প্রতীক্ষাতেই থাকে। আমার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া তাই নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আমি ছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন, মেনন গ্রুপের কর্মী। দল আমাকে রিক্রুট করেনি, আমিই তাদের খুঁজে নিয়েছিলাম। এস, এস, সি পরীক্ষার প্রস্তুতিকালীন সময়েই (জানুয়ারী-মার্চ, ১৯৬৯) দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। ঊনসত্তরের বিশে জানুয়ারী আসাদ পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন। দাবানলের আগুনে যেন সারা দেশ জ্বলে উঠলো। গভীর আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে প্রতিদিন পত্রিকা পড়তাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণী প্রকাশিত হচ্ছিল দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘আজাদ’ সেইসময়ে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছিলো আসাদের ডায়েরী। এই ডায়েরী আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং শিবপুরের কৃষক সমিতির একজন সংগঠক ছিলেন।
আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া রাজনীতি আমাকে টানতে পারেনি। আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম বামপন্থীদের আন্তর্জাতিক সমাজবাদী রাজনীতির প্রতি। জাতীয়তাবাদ সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা দিতে পারেনা, এই বোধটা কেমন করে জানিনা সেই বয়সেই আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই ‘জয় বাংলা’ নয়, ‘জয় সর্বহারা’ই ছিল আমার পছন্দের শ্লোগান।
আসাদের পরে জানুয়ারীতেই কিশোর স্কুল ছাত্র মতিয়ুর, এবং ফেব্রুয়ারীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহূরুল হক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ জোহা নিহত হন পুলিশের হাতে। সারাদেশ জনরোষে ফেটে পড়ে। শেখ মুজিবসহ অসংখ্য রাজবন্দী বিনাশর্তে মুক্তি পান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। আইয়ুব খান প্রথমে ঘোষনা দেন তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেননা । দুদিন পরেই বললেন, তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত বললেন, তিনি পদত্যাগ করছেন। দোর্দন্ড প্রতাপশালী স্বৈরাচারী একনায়কও যে জনরোষের কাছে অসহায় হয়ে অপমানজনকভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন ঊনসত্তরে আইয়ুব খান ছিলেন তারই দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে দেশে দেশে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই, আমাদের দেশেও পরবর্তীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। দু’একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেখা গেছে ক্ষমতা থেকে শেষপর্যন্ত এরা অপমানিত হয়েই বিদায় নেন, সময় থাকতে সসম্মানে বিদায় নিতে এদেরকে খুব একটা দেখা যায়না।
অবশেষে ঊনসত্তরের পঁচিশে মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দেন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে। ক্ষমতা ছাড়ার আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। শেখ মুজিব মৌলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে এই বৈঠকে যোগ দেন। এ নিয়ে ভাসানী-মুজিবের কথোপকথন ছিল বেশ মজার। মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ভাসানীর সাথে দেখা করতে গেলে ভাসানী তাকে গোলটেবিল বৈঠকে না যেতে অনুরোধ করেন এই বলে, “মুজিবর তুমি পিন্ডি যাইয়োনা, আইয়ুব এখন মরা লাশ।“ শেখ মুজিব নাকি বলেছিলেন, “তা হুজুর, মরা লাশের জানাযা পড়তে দোষ কি?” আন্দোলনের ওই পর্যায়ে মুজিব কেন যে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতে চাচ্ছিলেন, তা অনেকের পক্ষেই বোঝা মুস্কিল ছিল। মুক্তির পরে শেখ মুজিবকে যেদিন (ঊনসত্তরের তেইশে ফেব্রুয়ারী) ছাত্ররা সম্বর্ধনা দেয় এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে, সেদিনও জনসভাতে দাবী উঠেছিল, “গোলটেবিল না রাজপথ; রাজপথ, রাজপথ”। কিন্তু শেখ মুজিব সেই দাবীকে উপেক্ষা করে সেই সভাতেই ঘোষণা দেন যে, তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবেন।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার আগে শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই উদ্যোগের প্রধান রূপকার ছিলেন ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। শেখ মুজিব নাকি এই প্রস্তাবে রাজী ছিলেন, কিন্তু বাধ সেধেছিলেন বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিব। তিনি যে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর স্বামীর যোগদানের ঘোর বিরোধী, তা সুস্পষ্ট ভাষায় আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ কোন সিদ্ধান্ত বা ঐক্যমত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয় এবং আইয়ুব খানের পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আইয়ুব-মোনেমের পতনের পর গণমানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে সংগ্রামী চেতনার জাগরণ ঘটেছিল তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল কিনা বাঙ্গালী রাজনীতিকরা, সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। এখন পিছন পানে তাকিয়ে আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি ঊনসত্তরের গণজাগরণকে তার যৌক্তিক পরিণতি অর্থাৎ মানুষের সার্বিক মুক্তির আন্দোলনে পরিণত করার মত নের্তৃত্ব এবং সংগঠন সেদিন পুর্ব বাংলায় ছিল না। জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া রাজনীতিকরা নিয়মতান্ত্রিক, নির্বাচনমুখী রাজনীতিতেই আস্থা রেখে নিজেদের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে নেন। অন্যদিকে বামপন্থীদের মধ্যে যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ডাক দিচ্ছিলেন, তারা শুধু ডাকই দিয়ে যাচ্ছিলেন। জনগণকে সংগঠিত করার কোন বাস্তবোচিত কর্মসূচী তাদের ছিল না। সাধারণ জনগণ এদেরকে ঠিক চিনতোনা, মনে করতো এরা বৃটিশ আমলের সন্ত্রাসী গ্রুপের মতোই। সাধারণ মানুষ যে কম্যুনিস্ট রাজনীতি প্রত্যাখান করেছিল তা নয়, এরাই মানুষের মাঝে নিজেদের স্থান করে নিতে পারেনি। অথচ, মাওসেতুং-এর কথানুযায়ী জলের মধ্যে মাছের মতো জনগণের মাঝে কম্যুনিস্টদের মিশে থাকার কথা।
এখনও মনে আছে, এইরকম সময়ে, খুব সম্ভবতঃ সত্তরের শেষদিকে মানুষের ভীড়ে একবার আমরা লাল কালিতে ছাপানো কিছু লিফলেট ছুঁড়ে দিয়েছিলাম; এই লিফলেটে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলা হয়েছিল। কিছু হতচকিত মানুষকে বলতে শুনলাম, “কোথা থেকে এলো?” আবার কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেলো, “এইতো এসে গেছে, লালেরা এসে গেছে।“ আমার মনে হয় এইধরনের প্রতিক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে যে, কম্যুনিস্টরা তখনও সাধারণ মানুষের কাছে ছিল রহস্যাবৃত, যদিও অবাঞ্ছিত নয়। এটাও ঠিক যে, কম্যুনিস্টদের পক্ষে তখন প্রকাশ্যে রাজনীতি করাটা দুরূহ ছিল; কারণ পাকিস্তানী আমলে কম্যুনিস্ট সংগঠন করা ছিল আইনতঃ নিষিদ্ধ ।
নতুন করে সামরিক আইন জারীর পরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে কিছুদিনের জন্য হলেও। কিন্তু সে যেন ছিল ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা। সেই অবস্থাতেই আমরা কলেজে ঢুকি। কলেজে ঢুকেই মনে হলো একটা নতুন জগতে প্রবেশ করলাম। তখন রাজনীতির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়েও মেতে থাকত ছাত্র-ছাত্রীরা। ক্লাসে ক্লাসে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গঠন করার একটা হুজুগ ছিল। এই গোষ্ঠীগুলোর একটা প্রধান কাজ ছিল ম্যাগাজিন বা স্মরণিকা বের করা। বলতে দ্বিধা নেই পড়াশোনার চাইতে আমাদের এইসব কাজকর্মেই উৎসাহ ছিল বেশী।
তখন চট্টগ্রাম কলেজে মূলতঃ চারটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন সক্রিয় ছিল। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ (পিকিংপন্থী মেনন গ্রুপ আর মস্কোপন্থী মতিয়া গ্রুপ), এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ। কি কারনে জানিনা, ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপের মধ্যেই পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া ছাত্রদের প্রাধান্য ছিল, ছাত্রীদের কাছেও এই দুই গ্রুপ ছিল অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এদের মধ্যে আবার মতিয়া গ্রুপে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাধিক্য ছিল চোখে পড়ার মত। এরই বা কি কারণ ছিল আমার জানা নেই। সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চায়ও ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ করে মতিয়া গ্রুপ ছিল এগিয়ে। অনেকে এই গ্রুপটাকে ঠাট্টা করে ‘হারমোনিয়াম পার্টি’ বলতো। তবে ব্যাপক ছাত্র সমর্থনের বিচারে ছাত্রলীগ ছিল সব চাইতে বেশী জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। ছাত্রসংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগই জিততো। সংখ্যায় অল্প হলেও ইসলামী ছাত্র সংঘে কিছু নিবেদিতপ্রাণ ইসলামী ভাবাদর্শের প্রতি অনুগত কিন্তু স্বভাবতই ধর্মান্ধ নেতাকর্মী ছিল। এরাই যে কিভাবে পরে একাত্তরে আলবদর-রাজাকার হয়ে মানুষহত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল, ভাবলে অবাক লাগে, কষ্ট হয়। ছাত্র সংঘের মধ্যে ছাত্রীকর্মী ছিলনা বললেই চলে।
এইসময়ে আমরা, ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের এইচ,এস,সি-র ছাত্রছাত্রীরা সত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারীকে সামনে রেখে ‘এক ঝলক আলো’ নামে একটা স্মরণিকা বের করেছিলাম। আমাদের মতিয়া গ্রুপের বন্ধুরা বের করেছিল ‘অতন্দ্র’ নামে স্মরণিকা। বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ দুটো ম্যাগাজিনেই তাঁর কবিতা দিয়েছিলেন। কেন জানিনা, আজ এতদিন পরেও মনে রয়ে গেছে আমাদেরকে দেওয়া তার ‘লাল ট্রেন’ কবিতাটির শেষ ছত্রটি – “লাল ট্রেন ভাত হয় পাতে, কাঁথা হয় রাতে”। হয়তো তার কবিতার লাল ট্রেনটি ছিল রূপকার্থে একটি বিপ্লবী সমাজব্যবস্থা, যার মধ্যে আছে সাধারণ মানুষের সাধারণ সমস্যার সমাধান। অতন্দ্র-এ ছাপানো তাঁর কবিতাটির নাম ছিল ‘অলৌকিক ইস্টিমার’। পরে এই নামেই স্যারের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
(চলবে)
৪ জুলাই, ২০০৮
ড. ইরতিশাদ আহমদ ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এবং চ্যায়ারপার্সন। তিনি জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর সম্পাদক। ইমেইল : [email protected]