আমার চোখে একাত্তর
(চতুর্থ পর্ব)
পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকাময় রাত্রির ঘটনা, আর একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা পরে আবার আলোচনায় আসবে। এখন ফিরে যাওয়া যাক ঝড়ের পরের আর নির্বাচনের আগের সময়টাতে।
আগেই বলেছি, ঝড়ের পরে পুর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। নের্তৃত্বের পরিপক্ক দিক-নির্দেশনার বদলে মানুষের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদী মনোভাবের প্রভাব রাজনীতিতে বেশি বেশি করে পড়তে শুরু করে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ বদলে ‘পূর্ব বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশ’ শব্দগুলি ব্যবহৃত হতে থাকে পত্র-পত্রিকায় এবং রাজনৈতিক মহলে। বেশ কয়েকটি ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থেকে পাকিস্তান শব্দটা ইতোমধ্যে উঠে গেছে।
ঝড়ের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের প্রসঙ্গ বেশি প্রাধান্য পেতো। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামের একটি পোস্টার মানুষের মনে দারুণ প্রভাব ফেলে। এই পোস্টারে দেশের দুই অংশে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের তুলনামূলক দামের একটা তালিকা দেয়া ছিল। কিন্তু ঝড়ের পরে এই ধরনের সুপরিকল্পিত চিন্তাপ্রসূত প্রচারণা আর দেখা যায় নি। তখন আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত তরুণ নের্তৃত্ব এবং ছাত্রলীগের জঙ্গী অংশটা সামনে আসতে থাকে। এই সময়ে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্যরা ‘মুজিব কোট’ পরে শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের প্রতীকি আনুগত্য প্রকাশ করতো।
‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘আমার দেশ, তোমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’, এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানগুলি এদের মুখে বেশি বেশি শোনা যেতে থাকে। দেশাত্মবোধক বাংলা গানগুলি পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আমাদের আজকের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এই সময়ে গাওয়া হতো প্রায় প্রত্যেকটা রাজনৈতিক কর্মসূচীতে। আমি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলির কথাই বলছি, জামাত-মুসলিম লীগের কথা নয়। আরো গাওয়া হতো, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘ধনে ধান্যে পুস্পে ভরা’, আর ‘ও আমার দেশের মাটি’, এই গানগুলি। দেশপ্রেম আর রাজনৈতিক সচেতনতার একটা জোয়ার বইছিল যেন সেই সময়ের পূর্ব বাংলায়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় সারা দেশ হয়ে উঠেছিল উজ্জীবিত।
এই জাতীয়তাবাদী চেতনার মূলে ছিল ভাষা, চল্লিশের দশকের মতো ধর্ম নয়। তাই প্রথম থেকেই এই চেতনার চরিত্র ছিল সেক্যুলার বা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। তখন মনে হয় সাধারণ মানুষের উপর প্রগতিশীল, সেক্যুলার ধ্যান-ধারনার প্রভাব আজকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ভাবতেও অবাক লাগে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে একাত্তরে আলাদা দেশ পেয়েও এই ক’বছরে আমরা কতটা পিছিয়ে গিয়েছি।
পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের দাবীও সামনে আসতে থাকে। রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্র জনপ্রিয় হতে শুরু করে আটষট্টি-ঊনসত্তরের আন্দোলন থেকে। এই আন্দোলনের সূচনা করেন মৌলানা ভাসানী আর তার অনুসারীরা। কৃষক সমিতির হাট-হরতালের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সারা পাকিস্তানব্যাপী গণজাগরণের। আটষট্টির ডিসেম্বরে আসাদুজ্জামান মনোহরদির হাতিরদিয়ায় হাট-হরতালের সময় পুলিশের আক্রমণে আহত হয়ে ঢাকায় আসেন পত্রিকায় খবর দিতে। সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কোন পত্রিকাই সে খবর ছাপাতে রাজী হয়নি। প্রখ্যাত সাংবাদিক-রাজনীতিক নির্মল সেন তার স্মৃতিচারণায় জানাচ্ছেন, তিনিও আসাদের দেয়া খবর ছাপাতে পারেননি। আক্ষেপ করে লিখেছেন, মাত্র সপ্তাহ তিনেকের মাথায় ঊনসত্তরের বিশে জানুয়ারী আসাদ আবার আসেন – খবর দিতে নয়, খবর হয়ে পত্রিকার পাতায়, বীরের মতো মৃত্যুকে বরণ করে। এইবার আর তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেনি কোন সংবাদপত্র।
এই সময়ে ভাসানী তার অভিনব ঘেরাও আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। এই সময়েই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে অধিকার-সচেতনতার উন্মেষ ঘটতে দেখা যায়। থানা ঘেরাও, তহসিলদার ঘেরাও-এর মত দুঃসাহসিক কর্মসূচী নিতে দেখা যায় গ্রামবাংলার কৃষকদের। ট্রেড ইউনিয়নের শ্রমিকদের মত তারাও পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম সংগঠিত হতে শুরু করে। ‘কেউ খাবে, কেউ খাবেনা, তা হবেনা, তা হবেনা’ এই শ্লোগানটি সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বভাবজাত দোদুল্যমানতা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির অপপ্রচার সত্বেও সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এবং সমর্থন বাড়তে থাকে। কম্যুনিস্ট এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি - মস্কোপন্থী-পিকিংপন্থী নির্বিশেষে, পরস্পরের মধ্যে বিরোধিতায় লিপ্ত থাকা সত্বেও - সমাজতন্ত্রের দাবীকে সাধারণ মানুষের মাঝে, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।
বামপন্থীরা রাষ্ট্র-ক্ষমতায় যেতে পারে নি, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধে’ পরিণত করার কৃতিত্ব তাদেরই। সাধারণ মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে সফল না হলেও বামপন্থীদের এই অর্জনকে খাটো করে দেখা যায় না। দুঃখের বিষয়, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে এই অর্জনকে টিকিয়ে রাখা যায়নি।
সেই সময়ে, এমন কি আওয়ামী লীগও নির্বাচনী প্রচারণায় শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা কায়েমের অঙ্গীকার করে। মার্কিনঘেঁষা সোহরাওয়ার্দী-মানিক মিয়া প্রভাবিত আওয়ামী লীগে এই পরিবর্তন ছিল চোখে পড়ার মত। শেখ মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য, যদিও শেখ মুজিব তাঁর নেতার তুলনায় গনমানুষের অনেক কাছাকাছি ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, আওয়ামী লীগেও বামধারার রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করেছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং বামপন্থী নেতারা সামনে আসতে থাকেন তখন থেকেই, শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব সত্বেও। ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, শেখ মুজিব নিজেই হয়তো এই সময়ে বামধারার প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেন।
হয়তো তাই শুধু স্বাধীনতা নয়, মুক্তির কথাও তিনি একই নিশ্বাসে উচ্চারণ করেছিলেন তার ঐতিহাসিক সাতই মার্চের বক্তৃতায়।
এর আগে আওয়ামী লীগ কৃষক-শ্রমিকদের দাবীদাওয়াকে খুব একটা সামনে আনতোনা। ছয় দফায় কৃষক-শ্রমিকদের কোন কথাই নাই। ব্যাপারটা একেবারেই তাৎপর্যহীন নয় যে, সত্তরের আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন ‘শ্রমিক লীগ’ গঠিতই হয়নি। আওয়ামী লীগ ছিল মূলত মধ্যবিত্ত, উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর দল। যদিও ছেষট্টির সাতই জুন ছয় দফার দাবীতে যে হরতাল হয়, তাতে গুলিতে প্রাণ হারান আরো কয়েকজনের সাথে মনু মিয়া নামে একজন শ্রমিক ।
আগে উল্লেখ করেছি, ছাত্রদের এগার দফার কথা। ঊনসত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রদলগুলি একজোট হয়ে এগার দফা প্রণয়ন করেন। ছয় দফার তুলনায় এগার দফা ছিল অনেক বেশি প্রগতিশীল, সমাজতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। এগার দফায় পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবীর চাইতে গণমানুষের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রাধান্য পায় বেশি। এগার দফা ছিল সমাজতন্ত্রের পক্ষে, প্রগতিশীল ছাত্রদের একটা বিরাট বিজয়।
সত্তরের পূর্ব বাংলা ছিল নির্বাচনের অপেক্ষায় উম্মাতাল। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম ‘এক ব্যাক্তি এক ভোটে’র নীতিতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেই প্রথম এবং সেই শেষ - অখন্ড পাকিস্তানের ইতিহাসে সেই একবারই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে যাই ঘটুক, সত্তরে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীতে সারা পাকিস্তানের জনগণ ছিল ঐক্যবদ্ধ। গনতন্ত্রের দাবীতেই আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।
সত্তরের রাজনীতির এই প্রেক্ষাপটেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা পরিণত হয় আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধে’র মূলমন্ত্রে। পরবর্তীতে বাহাত্তরে যা স্থান পায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে চার মূলনীতি হিসাবে - এবং আরো পরে কতিপয় অতি উৎসাহী এবং সুযোগসন্ধানী চাটুকারদের দ্বারা তথাকথিত ‘মুজিববাদে’র চার স্তম্ভ রূপে।
ঝড়ের পর থেকে স্বাধীনতার দাবীতে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী সোচ্চার হলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু চেয়েছিল শেখ মুজিবের দিকেই। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাতে ম্যান্ডেট তুলে দেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তেমন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ ছিল না। সাধারণ মানুষ দেশ স্বাধীন করার জন্য ব্যালটকেই অস্ত্র হিসাবে নিয়েছিল, এবং সেই অস্ত্র একযোগে প্রয়োগ করেছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কাছে ডানপন্থী দলগুলোর বাঘা বাঘা নেতারা শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। মুসলিম লীগের সবুর খান এবং ফকা চৌধুরী, জামাতের গোলাম আজম, নেজামে ইসলামীর ফরিদ আহমদের মতো ডাকসাইটে নেতারাও এমন ভাবে বিস্তর ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হবেন, ভাবাও যায়নি। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ একশত বাষট্টিটির মধ্যে মাত্র দুটি আসন হারায়। পিডিপি-র নুরুল আমিন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় ওই দুটি আসনে নির্বাচিত হন।
শুধু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলিই নয়, মোজাফফর ন্যাপের (মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত) প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগের কাছে হেরে যান। মোজাফফর ন্যাপকে তখন আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ বলা হতো। আগেই বলেছি, ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয় এই দলটি নির্বাচন করলেও ফলাফল অন্যরকম হতো না। অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকারকে (যেমন এম, আর, আখতার মুকুল) বলতে শুনি, ভাসানী নাকি শেখ মুজিবকে ‘ওয়াকওভার’ দেয়ার জন্য নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমার তা মনে হয় না। তখন ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং এই কম্যুনিস্টরা তখন নীতিগত ভাবেই নির্বাচনের রাজনীতি পরিহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবী আদায় করা সম্ভব, এই বিশ্বাস শেখ মুজিবের থাকলেও মৌলানা ভাসানীর ছিল বলে মনে হয় না।
যাই হোক, ফলাফল এই দাঁড়ালো যে, আওয়ামী লীগ তখন সত্যিকার অর্থেই পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল একমাত্র রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল আর শেখ মুজিব লাভ করেছিলেন জনগণের অবিসম্বাদিত নেতা হওয়ার বিরল সম্মান এবং একইসাথে বিরাট দায়িত্ব। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একটা আসনও পায়নি, পাওয়ার তেমন একটা প্রচেষ্টাও ছিল না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে একাশিটি (একশত আটত্রিশটির মধ্যে) আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসন পায়নি। এ থেকেই বোঝা যায়, কার্যত পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনীতি তখন দুই ধারায় চলছিল এবং এর পরিণতি একটা অনিবার্য সংঘাতের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল।
(চলবে)
সেপ্টেম্বর ১২, ২০০৮
ড. ইরতিশাদ আহমদ ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারপার্সন। তিনি জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর সম্পাদক। ইমেইল : [email protected]