সঙ্গীত শিল্প নিয়ে আমার একান্ত অভিমত
শত বর্ষের অন্যতম বাংলা আধুনিক গান
এ এইচ জাফর উল্লাহ
গোড়াতেই বলে রাখছি আধুনিক বা 'কন্টেম্পরারী' বাংলা গান নিয়ে যে লিখাটি লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছি সেটি কিন্তু একান্তই আমার কথা। অনেকেই হয়ত আমার মতামতের সাথে একমত হবেন না। গান, সাহিত্য, অঙ্কন, ভাস্কর্য, আর অন্যান্য সুক্ষ-শিল্প বা 'ফাইন্ আর্টস্' এর ক্ষেত্রে কোন দুই ব্যক্তির মত এক যে হতে হবে তেমন তো নয়! সে' জন্য আমার মতামত নিয়ে 'ডিবেট' বা বাক্-যুদ্ধ করার কোন অবকাশ নেই।
২০০৬ সনে জুন মাসে আমার বড় ছেলে রাশাদ স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক বৃত্তি নিয়ে বাংলা শিখতে কোলকাতা গিয়েছিল প্রায় তিন মাসের জন্য। সে কানেক্টিকাটের ইয়েল বিশ্বনিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে 'লিঙ্গুইস্টিক্স' এ ডক্টোরেট শেষ করছে। মধ্য-যুগীয় বাংলার উপর একটা অধ্যায় না কি থাকবে তার গবেষনার রচনায়। তাই কোলকাতায় সময় কাটিয়ে তার অশেষ লাভ হয়েছে। সে মার্কিনমুল্লুকে ফেরৎ আসার সময় আমাকে ই-মেইলে জানায়, "বাবা, কোলকাতা থেকে তোমার জন্য কি কিছু আনতে হবে?" প্রতি উত্তরে আমি লিখলাম, "অবশ্যই! মঙ্গল কাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, কিছু পুঁথি-সাহিত্য যেমন আলাওলের অনুবাদ 'পদ্মাবতী', ভরতচন্দ্র এর অন্নদামঙ্গল কবিতা সমগ্র, মধুসূদন দত্তের ব্রজঙ্গনা কাব্যসহ অন্যান্য কাব্য সংগ্রহ, আর তার সাথে জীবনানন্দ দাসের কবিতাসমগ্র, প্রাচীন বাংলা গান (টপ্পা) আর অজয় চক্রবর্তীর বাংলা গানের সিডি এ'সব নিয়ে আসবে।"
রাশাদ কোলকাতা থেকে ফেরৎ আসার সময় কেবল যে বইপত্র আর গানের সিডি বয়ে নিয়ে এসেছে তা নয়, সাথে আমার জন্য "সুরকার" কোম্পানীর বিশ্ব বিখ্যাত হারমোনিয়াম আর নিজের গলা সাধার জন্য তানপুরা নিয়ে এসেছে। কোলকাতায় থাকাকালীন সে এক ওস্তাদ ধরে তাঁর কাছ থেকে রাগের তালিম নিয়েছে। সে' জন্যই সে তানপুরাটা কষ্ট করে বয়ে নিয়ে এসেছে। এখন আসা যাক এই লিখার প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে। কোলকাতার মুউজিক সার্কেলের মোটামুটি সবাই এই ব্যাপারে একমত যে অজয় চক্রবর্তী রাগ-প্রধান গান, ঠুম্রী, খেয়াল, আর বিশেষ করে নজরুল গীতিতে সবাইকে অতিক্রম করে এখন শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছেন। অজয় বাবুর মেয়ে কৌশিকী চক্রবর্তী এখন উঠতি শিল্পী রাগ-প্রধান গান আর খেয়ালে। অজয় বাবু আধুনিক বাংলা গানও গাচ্ছেন। বাজারে এরই মধ্যে ৬-৭টি সিডি ও বের হয়েছে। আমি ২০০৫ সনে নিউ ইয়র্কের জ্যাক্সন হাইটস্ এর এক সঙ্গীত বিতান থেকে ৪টি সিডি কিনেছিলাম। আর সেই সিডিগুলোতে আবদ্ধ গানগুলো পছন্দসই হয়েছিল। তবে রাশাদ যে আজয় বাবুর ২৬টি সিডি কোলকাতা থেকে নিয়ে এসেছে তার মাঝে গোটা দু'য়েক সিডি ছিল আধুনিক বাংলাগানের। তার মাঝে একটি সিডি যার নাম হচ্ছে "যে সুরে বাজালে" সেটি আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। এই সিডি তে সর্বমোট ৮টি গান জুড়ে দেয়া হয়েছে (প্রায় ৫৪ মিনিট এর সিডি) । সিডিটি প্রকাশনা করেছে 'সাগরিকা' (এস-১০০-০৫-১)। সেগুলোর মাঝে পাঁচ নম্বর গানটি "হরিণারে, তব নিলয় না জানি" হালকা বা লঘু রাগে গজল ঢংগে সুললিত কন্ঠে গেয়েছেন প্রায় সাত মিনিট সময় নিয়ে। গানটি শুনে আমার মনে হয়েছে যে রচনাটি আশাবরী ঠাটের কোনে এক মিশ্র রাগে গানটি গাওয়া হয়েছে তবে এই ব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত নই। এই সিডি এলবামের সর্বশেষ গান খানা যার কথা হচ্ছে "ঝন ঝনন বাজে, চরাচরে এসে সুর বিরাজে" সেই গানটি হালকা মেজাজে দরবারী কানাড়া রাগে নিবদ্ধ। যারা রাগ-প্রধান গান পছন্দ করেন তারা নিশ্চয় জানেন যে এই গভীর রাত্রির রাগ কত আকর্ষনীয়। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী থেকে নিয়ে নিয়ে আরো অনেক নামি উস্তাদরা এই রাগে ঠুমরী-খেয়াল গান নিবদ্ধ করেছেন। উস্তাদ বেলায়েৎ খান (পূর্ব-বঙ্গে বিভাগোত্তর আমলে জন্ম ময়মনসিঙ্গহে) সেতারে এই রাগ একটানা ৪৮ মিনিট বাজিয়ে
১৯৬০ দশকে যে বাহ্বা কুড়িয়েছিলেন তার জুড়ি পাওয়া ভার। সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর অজয় চক্রবর্তী এই রাগে যে গানটি নিবদ্ধ করেছেন সেটি যারা নির্মল আনন্দের জন্য রাগ-প্রধান গান শুনেন তারা পছন্দ করবেন।
এই অতিব্যস্ত কম্পুটারের যুগে ক'জনই বা রাগ-প্রধান বাংলাগান শুনেন? তাই দরবারী কানাড়া রাগে আবদ্ধ "ঝন ঝনন বাজে, চরাচরে এসে সুর বিরাজে" এই গানের সুর ললিত্যের কথা আর নাই বা লিখলাম তবে অজয় বাবুর গাওয়া "হরিণারে, তব নিলয় না জানি" গানটির কথা পুনরায় উল্লেখ না করে আর পারছি কই? অত্যন্ত দরদ দিয়ে ভরাট গলায় গানটি গেয়েছেন শিল্পী। সুরের ঝর্না যেন বেয়ে পড়ছিল সেই প্রথম থেকে শেষ অবধি। যারা এই গানটি শুনতে চান তাদের জন্য এম্পি থ্রি তে গানটি রাখা হলো ওয়েবে ।
Download "Harinarey.mp3"
মুক্তমনা ফোরামে রাজনৈতিক বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় আর তার সাথে হয় বাংলাদেশের ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। যেটির অভাব আমি প্রতিনিয়ত দেখি সেটি হচ্ছে সুকুমার বৃত্তি আর 'ফাইন আর্টস' বা ললিত কলা নিয়ে কারু মাথা ব্যথার কারণ নেই। মানুষের মনের খোরাখেরও দরকার আছে বলে আমি মনে করি। তাই সময়ে অসময়ে আমরা কবিতার বই পড়ি, গান শুনি, মিউসিয়ামে গিয়ে নামী অঙ্কন শিল্পীদের আঁকা ক্যানভাসে ওয়েল পেইন্টং দেখি, মিশরের স্থাপত্য শিল্প দেখি চিত্তের তাড়নায়। আমাদের এই সাইবার ফোরাম মুক্তমনাকে আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার এক জলের আধাঁর বা 'ওয়াটার হোল' এর মত পরিণত করতে হবে। কেবল তা'হলে এই ফোরাম সবার হৃদয়গ্রাহী হবে।
ভবিষৎ এ কবিতা, সাহিত্য, অঙ্কন শিল্প, গান, নাটক, নৃত্য, এ'সব ললিত কলা নিয়ে আরো লিখা হবে তারই প্রত্যাশায় রইলাম। অজয় বাবুর সুললিত কন্ঠে "হরিণারে, তব নিলয় না জানি" গানটি এম্পি থ্রিতে শুনার পর কেউ যদি এটি নিয়ে মন্তব্য করেন তা হলে আমি বাধিত হব। সবাই নিরাপদে ও আনন্দমুখরিত পরিবেশে থাকুন সেটি কামনা করে এই লিখার ইতি টানছি।
--------------------
জাফর উল্লাহ আটলান্টা শহরের এক অস্থায়ী জায়গা থেকে এই লিখাটি লিখে পাঠিয়েছেন।