বাংলাদেশ কি এখন ও পুলিশি রাস্ট্র?১
কতিপয় সেনাসদস্য কৃর্তক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্মম প্রহার এবং এর জের হিসেবে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা ইতিমধ্যে অনেকের জানা হয়ে গেছে। আজকের পত্রিকায় (২২ আগষ্ট ২০০৭) এ সম্পর্কে সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ফখরউদ্দিন আহমদ-এর বক্তব্যের বিবরণ ও সম্ভবত অনেকেই ইতিমধ্যে পড়ে থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীর কাছে অনাকাংখিত এই ঘটনার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে ঘটনা পরবর্তী সময়ে প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে স্বতস্ফূর্তভাবে ঘটে যাওয়া প্রতিবাদ ও ভাংচুরের ঘটনার জন্য ‘কিছু অপশক্তি ও সুযোগ সন্ধানী উচ্ছৃখল ব্যক্তি’ (তাঁর ভাষায়)-কে দায়ী করেছেন।“উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার চরম ধৈয্যের পরিচয় দিয়ে সাধারণ জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা এবং বেআইনি তৎপরতা বন্ধ করতে সান্ধ্য আইন জারিসহ কতিপয় ব্যবস্থা নিয়েছে।“ এ ভাষ্য প্রধান উপদেষ্টার। বিনয়ের সাথে বলতে চাই, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য আমার কাছে প্রকৃত ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা বৈ বেশি কিছু মনে হয়নি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার এ ধরণের বক্তব্যে অতীতের জনবিরোধী সরকারগুলোর রাজনৈতিক রেটরিক-এর গন্ধ পাওয়া যায়। কিসের ভিত্তিতে আমি এই কথা গুলি বলছি? অনেকেই হয়তো জানতে চাইবেন। আজকের প্রথম আলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সুপরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপকের দুটো লেখা বেরিয়েছে। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বাক-বিতন্ডা ঘটে (এমনটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘটা নিশ্চয় হারাম কোন ব্যাপার নয়)। কিন্তু এই ঘটনায় ক্যাম্পাসের সেনা ক্যাম্পের একজন জুনিয়র সেনা অফিসার ক্ষমতার দাপট ও বাহাদুরি (সেনা ও পুলিশ সদস্য, এমনকি একজন কন্সটেবল ও বাংলাদেশে সুযোগ পেলে ক্ষমতা জাহির করার কথা ভুলেন না) দেখাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের গায়ে হাত তুলেন। এতে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা (পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এদের প্রায় সকলেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, কোন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার নয়) ও অপমানিত বোধ করে, তাঁরা প্রতিবাদ করে। ফলে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নেমে আসে পুলিশ এবং আর্মির নির্বিচারে পিটুনী ও প্রহার। প্রতিবাদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের, এমন কি ঢাকার বাইরের ছাত্র-ছাত্রীরা দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। অর্থাৎ এটা অত্যন্ত পরিষ্কার, এই ঘটনায় আসলে কারা সত্যিকারের ‘উচ্ছৃংখলা এবং অপতৎপরতা’-র পরিচয় দিয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেয়েছেন।২
গল্প চালু আছে, ব্রিটিশ আমলে আদালতে বিচারকের রায়ে সন্তুষ্ট হয়ে এক গরীব বাংগালী মহিলা বিচারক মহোদয়কে এই বলে আশীর্বাদ করেছিলেন, আল্লাহ আপনাকে যেন একদিন দারোগা বানান। চারপাশে পুলিশ-দারোগাদের প্রতাপ ও দাপট দেখে অভ্যস্ত মহিলার ধারণা ছিল, পুলিশের দারোগার ক্ষমতা একজনের বিচারকের ক্ষমতার চাইতে ও বেশি। এখন ব্রিটিশ আমল নেই, নেই পাকিস্তান আমল ও। জনগণ বাস করছে স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে। অথচ, আজ অবধি এ দেশে শিক্ষিত মানু্ষজন, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পর্যন্ত পুলিশ-আর্মিকে তোয়াজ করে চলতে হয়। বোঝার কোন উপায় নেই, এই দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে আর্মি-পুলিশ বেঁচে আছে। তাঁদের দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা, সম্মান করা; এঁরা যদি তা করতে না পারে, তাহলে গরীব এই দেশের মানুষের টাকায় এঁদের পোষাটা একধরনের অপচয় মাত্র।
৩
সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ আজকাল বেশ ঘন ঘন বলতে ভালবাসেন, ‘সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে জড়ানোর কোন ইচ্ছা নেই।‘ অথচ বিভিন্ন জায়গায় দেয়া তাঁর বক্তব্যের বেশির ভাগই রাজনৈতিক। এই সরকার যে সেনা সমর্থিত, সেটা আমাদের কার ও অজানা নেই। আমরা সাময়িক সময়ের জন্য সেটা মেনে ও নিয়েছিলাম কারণ বাংলাদেশের জনগণ বড় দুই রাজনৈতিক দলের কামড়াকামড়ি-মারামারি-দূর্ণীতিতে সত্যি সত্যি অতীষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, স্বাধীণ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে এখন ও আয়ূব-ইয়াহিয়ার উর্দিপরা মিলিটারির ছাপ রয়ে গেছে। জেনারেল মঈন রাজনীতিতে জড়াতে চান না, হয়তো রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান (আশা করছি, আমার আশংকা মিথ্যা)। কিন্তু এ দেশের জনগণ দারোগাকে আর বিচারক হিসেবে দেখতে চায় না। আর যা কেউ দেখতে চায় না, তাঁকে তা দেখানোর চেষ্টা করলে পরিণতি যে কী হতে পারে- সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদের ঘটনায় সেটির ইংগিত মেলে।
নিউ ইয়র্ক
২২ আগষ্ট, ২০০৭
_____লেখকের পরিচয়ঃ‘মুক্তমনা’ হিউম্যানিস্ট ফোরামের কোমডারেটর এবং সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য। ই-মেইলঃ [email protected]