রাজনীতিকদের ইবাদতনামা এবং 'সংস্কার' প্রসংগ

জাহেদ আহমদ

একঃ
'মান্নান ভূঁইয়া' নামটি উচ্চারনের সাথে সাথে আমাদের সবার সামনে যে পরিচয় ভেসে ওঠে তা হল বিএনপি-র মাননীয় মহাসচিব, বিগত জোট সরকারের অতি গুরূত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী। বেগম জিয়ার অতি ঘনিষ্টদের তিনি ছিলেন একজন। বিএনপি-র দুই দুই বারের সরকার এবং দলের নীতিনির্ধারণী ব্যাপারসমূহে তাঁর ভূমিকা ও উপস্থিতি সর্বদাই ছিল সরব। রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রে আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখেছি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে রাজকীয় ভংগিতে রংগিন চশমা পরিহিত চেয়ারে আসীন স্মিতহাস্যময় (ততকালীন প্রধানমন্ত্রী) বেগম জিয়ার পাশে মান্নান ভূঁইয়া, তারেক রহমান (কার ও মতে ‘দেশের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী’) প্রমুখদের ছবি। মান্নান ভূঁইয়া যে এক সময় বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, তা কারো অজানা না থাকলে ও কালের বাস্তবতায় সেটি অবান্তর হয়ে গেছে। তা ছাড়া এক সময় বিপ্লবী বাম রাজনীতি করতেন কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং সময়ে জাতীয়তাবাদী এমনকি ইসলামের ঝান্ডা হাতে নিয়েছেন, এমন রাজনীতিকের উদাহরণ বাংলাদেশে প্রচুর আছে। তথাপি বেগম জিয়া, যিনি কি-না বর্তমানে অন্তরীণ অবস্থায় ও আধূনিক টেলি কনফারেন্সে রাজনীতি চর্চ্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, সম্প্রতি তাঁর এক সময়ের অতি প্রিয়ভাজন মান্নান ভূঁইয়া সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে এটুকু বলা যায়- বন্দী অবস্থায় ক্ষমতা এবং দাপট হারালে ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বেগম জিয়া চতুরতা ও ধূর্ততায় আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ষ হয়েছেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা আবার আমাকে যেন ভূল না বোঝেন! মান্নান ভূঁইয়ার পক্ষে দালালি করার কোন বাসনা আমার নেই।

দৈনিক যুগান্তর (২ আগষ্ট,২০০৭) পত্রিকার খবর অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলা ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দের সাথে টেলিকনফারেন্সে আলাপকালে বেগম জিয়া বলেন, বিএনপি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। কিন্তু মান্নান ভূঁইয়ার না আছে জাতীয়তাবাদ, না আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। তিনি তো কোন ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। ওই লোক আবার বিএনপি করবেন কিভাবে? তিনি ষড়যন্ত্র করছেন বিএনপি কে ধ্বংস করতে। আমি ঠিক জানি না বেগম জিয়ার ওই কথাগুলিতে ছাত্রদলের নেতাদের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, বেগম জিয়া বাংলাদেশের জনগণকে ছাগল বৈ অন্য কিছু ভাবেন না। তা না হলে তিনি বুঝতে পারতেন, ধর্মকে টেনে এনে বলা তাঁর এই কথাগুলির পেছনে কতখানি অস উদ্দেশ্য জড়িত তা বোঝার জন্য কারো আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই। মান্নান ভূঁইয়া সত্যি সত্যি ধর্মে বিশ্বাস করেন কি-না আমার জানা নেই। তাঁর সাথে আমার কোন পরিচয় ও নেই। কিন্তু বেগম জিয়া মান্নান ভূঁইয়াকে চেনেন বহু বছর থেকে। মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন তাঁর ঘনিষ্টজনদের অন্যতম। খালেদা জিয়ার পরে দলে তিনি ছিলেন পদাধিকার বলে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এহেন ব্যক্তি যদি ধর্মে বিশ্বাস না করে থাকেন, তাহলে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী (বেগম জিয়ার ভাষায়) বিএনপি-র এত বড় দায়িত্ব তাঁকে কে দিল? এটা কি বেগম জিয়ার অগোচরে ঘটেছিল? নাকি, ওটা ও ছিল কোন “বিদেশী ষড়যন্ত্র” (বেগম জিয়ার বক্তব্যে বহুল ব্যবহৃত একটি টার্ম)? তবে আসল সত্য কমবেশি আমরা সকলে জানি। নিজের ছাড়া ও পুত্রদ্বয়ের, দলীয় মন্ত্রীগণ-নেতানেত্রীবৃন্দের সীমাহীন দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতির অনেক অভিযোগে মাত্র কয়েক মাসের আগের আনচ্যালেঞ্জড বেগম জিয়ার আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এক সময় রাজনীতিতে সকল প্রকার মুশকিলে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ কৌশল হিসেবে কাজ করলে ও এখন আর সে সুযোগ নেই। অতএব, শেষ ভরসা হচ্ছে এ দেশের রাজনীতিতে যা সবসময়ই তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছেঃ ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।

দুইঃ
সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিআইপি জেলের দৈনন্দিন দিনগুলির বর্ণনা। দিনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ তাঁর কাটে ক্বোরাণ তেলাওয়াত করে এবং তসবিহ জপে। ভাবছি, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের নীচের লাইনগুলি কতখানি প্রযোজ্য-
বিপদে মোরে রক্ষা কর
এ নহে মোর প্রার্থনা।
বিপদে যেন না করি ভয়।‘
হাসিনার কিসের এত ভয়? তাঁর ইবাদতনামার বিবরণ পড়লে রবীন্দ্রনাথ হাসিনাকে কি সার্টিফিকেট ইস্যু করতেন? স
, নির্লোভ নাকি শংকিত বা অন্যকিছু? বেগম জিয়া ও নাকি ইদানিং আগের মত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন না। প্রত্যুষে ওঠে ক্বোরাণ তেলাওয়াতে বসে যান, তসবিহ জপ করেন; নিয়মিত নামাজ ও পড়েন। কারো ইবাদত-প্রার্থনা নিয়ে আমার মশকরা করার ইচ্ছা নেই, শুধু একটি প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আল্লাহর কাছে দেশবাসীর জন্য মোনাজাত করার কথা তাঁর একটিবার ও মনে হয়নি কেন?

তিনঃ
রাজনৈতিক অংগনে ইদানীং একটা রিউমার শোনা যায় যে, বর্তমান সরকার গোপনে গোপনে জামাতের প্রতি সহানুভূতিশীল। খবরটির সত্যমিথ্যা আমার জানা নেই। তবে একটা জিনিস বোধহয় সত্যি সরকার স্বীকার করুক বা না করুক- সরকারের কিছু কিছু ভূমিকা কিংবা নিষ্ক্রিয়তার ফায়দা ওঠাচ্ছে জামাত এবং ভবিষ্যতে আরো ওঠাবে বলে মনে হয়। বর্তমান সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা এবং জাতীয় দুর্ণীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মতিন জামাতের দুর্ণীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে যা বলেছেন তা জামাতকে এক ধরণের ছাড় দেয়ার মতই মনে হতে পারে। “এমনও তো হতে পারে
জামাতের বিরুদ্ধে কোন………দুর্ণীতির অভিযোগ নেই।“ মাননীয় উপদেষ্টার এই মন্তব্যবের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, সরকারের ওরকম একটা উঁচু পদে থেকে ও তিনি কি দিন-রাত কেবল নাকে তেল দিয়ে ঘুমান? তা না হলে তিনি জানতেন যে, সরকারের দুর্ণীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক প্রকাশিত ১০০ দুর্ণীতিবাজদের তালিকার ৪ জন হচ্ছেন জামাতের সাংসদ। এদের বিরুদ্ধে দুর্ণীতি, চাঁদাবাজি ও ত্রাণের টিন আত্নসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পলাতক আছেন জামাতের আর ও ৪ জন সাংসদ অর্থা জামাতের মোট ১৬ জন সাংসদের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে রয়েছ মামলা ও দুর্ণীতির অভিযোগ। এ ছাড়া জোট সরকারের মন্ত্রী ও জামাতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদী এবং কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার নামে ঝুলছে খুনের মামলা। মাওলানা সাঈদীর অত্যন্ত ঘনিষ্টজন পিরোজপুর জেলা জামাতের সেক্রেটারি মাওলানা শফিকুর রহমান বর্তমানে জেলে রয়েছেন দুর্ণীতির অভিযোগে। অনুরুপ অভিযোগ রয়েছে সিলেটের মাওলানা ফরিদউদ্দিনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ও জামাতের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা- নায়েবে আমীর মকবুল আহমেদ, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও এটিএম আজহারুল ইসলাম-এর বিরুদ্ধে চলছে মামলা (সূত্রঃ সাপ্তাহিক ২০০০, ৩ আগষ্ট ২০০৭)।

এ তো গেল জামাতের তালিকাবদ্ধ দুর্ণীতির কথা। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে দুর্ণীতি জন্মলগ্ন থেকে জামাত এদেশের মানুষের সাথে করে আসছে, সেটি হচ্ছে আমার মতে, নৈতিক দুর্ণীতি। বাংলাদেশের কোটি কোটি সহজ সরল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে তারা ব্যবহার করে আসছে কেবল নিজেদের রাজনৈতিক ও ক্ষমতার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করতে। এ কাজে এই দলটির কোন জুড়ি নেই। বিগত দিনগুলিতে নির্বাচনী প্রচারণায় জামাতের এরকম দেয়াল লিখন ও আমরা দেখেছি যে, “ভোট দিলে পাল্লায়, খুশী হবে আল্লায়” অর্থা মানুষকে বোঝানো হয়েছে, জামাত স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক  মনোনীত একটি রাজনৈতিক দল।ডঃ ফখরউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী সমর্থিত বর্তমান সরকারের সবগুলি কাজ সাধুবাদের যোগ্য না হলে ও এঁরা অন্তত বেশ কিছু দুঃসাহসিক এবং পজিটিভ নজির রেখেছে। বাংলাদেশে চোর-ডাকাতের অভাব কোন কালে না থাকলে ও এবারই বোধহয় প্রথমবারের মত আমরা দেখলাম, বাংলাদেশে মাননীয় উপাধিধারি মন্ত্রী-এমপি–রা কত ভয়ংকর আকারের লম্পট হতে পারে। এরা সরকারী জমি, বাড়ি-গাড়ি, রাস্তা- এমনকি এতিম-গরীবের ত্রাণের টিন পর্যন্ত লুট করতে পারে। আমরা আর ও দেখলাম, কি ভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে এক সময়ের ‘স ও স্পষ্টবাদী’ বলে বহুল আলোচিত প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রাহমান ও শেষ পর্যন্ত ‘উসবিহীন’ (?) টাকা বৈধ করতে কয়েক কোটি টাকা জরিমানা দিলেন।

আজকাল রাজনৈতিক দলসমূহের সংস্কার নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের (অপ)ব্যবহার রোধ করার কথা খুব একটা শোনা যায় না অথচ রাজনীতিতে দুর্ণীতি এবং সুবিধাবাদি ধারা বন্ধ করতে হলে এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা অত্যন্ত জরুরী। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চালু থাকার ফলেই এরশাদের মত চরিত্রহীন লম্পট এবং বিশ্ববেহায়া মাথায় টুপি পরে পাক্বা মুসলিম লেবাসে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে পেরেছে, সাঈদীর মত অর্ধ-শিক্ষিত গলাবাজ মোল্লা দেশের বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সংসদে দাঁড়িয়ে বিষেদ্বাগার  করেছে এবং আমিনীর মত গন্ডমূর্খ মোল্লা ও এমপি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, সেই রাজাকাররা এ দেশে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় আসীন হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত ঢাকা শহরের রাস্তায় নিজামী, মুজাহিদী লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। আমরা এই দেশকে ভালবাসার দাবী করি অথচ এ দেশের মাটি ও মানুষের পরীক্ষীত দুশমনদের অস রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের পথটি সদা খোলা রাখি, এ কেমন কথা! ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে আওয়ামি লীগ, বিএনপি, জামাত-সহ সুবিধাবাদী অনেক রাজনৈতিক দলসমূহের মতলববাজি রাজনীতির পরিধি সীমিত হয়ে আসবে। বাংলাদেশকে একটি উন্নত, আধুনিক এবং প্রগতিশীল রাস্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ধর্মের সকল প্রকার রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ তাই সময়ের দাবী।

নিউ ইয়র্ক
20 আগষ্ট, ২০০৭
                                                                       _____

লেখকের পরিচয়ঃ ‘মুক্তমনা’ হিউম্যানিস্ট ফোরামের কোমডারেটর এবং সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য। ই-মেইলঃ  [email protected]