কবি সাহিত্যিকরা সমাজের জন্য যা করেন
জালাল কবির


অনুন্নত বিশ্বের অনেক সাধারণ মানুষ স্বভাবতই প্রশ্ন করেন কবি সাহিত্যিকরা সমাজের জন্য কি করেন ? তাদের এ প্রশ্ন খুবই সরল, কারণ উন্নত বিশ্বের মত তারা এত সমাজ সচেতন নন এবং রাষ্ট্র ও সমাজে কি ঘটে যাচ্ছে এসম্বন্ধেও তাদের ধারণা সীমিত। এতদ্ব্যতীত আমাদের মত অনুন্নত দেশে শিক্ষার হার তুলনা মুলক ভাবে কম। আমাদের ৬৮ হাজার গ্রাম, শহরের দরিদ্র জনসমষ্টি এবং নগর সংলগ্ন আশে পাশের এলাকাগুলোতে যে জন বসতি আছে সেখানে এখনও বই পুস্তক, খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি মিডিয়াগুলোর প্রচার এবং প্রসার খুবই সীমিত। শিক্ষার হার কম থাকায় এবং শুদ্ধ ভাষাজ্ঞানের অভাবে আমাদের এক বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও বুঝতে পারেননি কবি সাহিত্যিকরা সমাজের জন্য কি করেন। এমনকি উন্নত বিশ্বে ও এই প্রশ্ন আছে, তবে তা আমাদের সমাজের মত এত অস্পষ্ট নয়। কারণ উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ জীবন নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত থাকেন যে, তারা অনেকেই কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপারে তেমন খোঁজ খবর রাখতে পারেননি। কিন্তু কবি সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে তাদের প্রচুর ধারণা আছে। স্কুল জীবনের অধ্যয়নে এবং উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে কবি সাহিত্যিকদের কর্ম জীবন সম্বন্ধে তাদের এই জ্ঞান সঞ্চিত হয়।

কবি সাহিত্যিকরা স্বভাবতই আত্মভোলা ও খামখেয়ালী মনোভাবের হয়ে থাকেন। অনেক সময় নিজের পরিবারে কি ঘটে যাচ্ছে তাও তাঁরা খেয়াল করেন না। আবার এমনও দেখা গেছে তাঁরা এসব ব্যাপারে সবকিছুই বুঝেন কিন্তু তা নিয়ে নাক গলাতে চান না, যতক্ষণ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী কিংবা স্পর্শকাতর কিছু না হয়। পারিবারিক ব্যাপারে তাঁদেরকে যথেষ্ট নিরব মনে হলেও সমাজের ব্যাপারে তাঁরা ঠিক যেন এক অতন্দ্র প্রহরী। সমাজের কোথায় কি অন্যায় হচ্ছে ? সমাজের মানুষ কি ভাবে শোষিত হচ্ছে ? মানুষ কেন ন্যায় বিচার পাচ্ছেনা ? সরকার কেন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে ? সবলরা কেন দূর্বলদের উপর অত্যাচার করবে ? মানুষের ধর্মীয় অধিকার, রাষ্ট্রীয় অধিকার ও সামাজিক অধিকার কেন রক্ষিত হচ্ছেনা ? মানুষ দরিদ্রতার সাথে আজীবন সংগ্রাম করে ও কেন সুখী হতে পারছেনা ? কোন অন্যায়ের কারণে নারী ও শিশুরা হচ্ছে অপমানিত ও নির্যাতীত ? ইত্যাদি ব্যাাপারগুলো সর্বদাই কবি সাহিত্যিকদের হৃদয়কে সাংঘাতিক ভাবে নাড়া দেয়। তাঁরা হয়ে পড়েন ব্যথিত । ন্যায় ও বিবেকের মূল্যবোধে হয়ে উঠেন সচেতন। এসব অন্যায়ের প্রতিকার করতেই হবে। তাই তাঁরা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। তাঁদের কলম হয়ে উঠে সত্যের তরবারী। তাঁরা হয়ে উঠেন কলম যোদ্ধা। সামাজিক, পারিবারিক কিংবা রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা কার কাছে প্রতিবাদ করবেন সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। একারণে কবি সাহিত্যিকরা সমাজের মধ্যেই তৈরী করেন সেই আদালত, সেই প্ল্যাটফর্ম। তাঁরা মানুষকে এ ব্যাপারে সজাগ ও আত্ম-অধিকার সম্বন্ধে জ্ঞান দানের জন্য নানাবিধ পন্থা অবলম্ভন করেন। তাঁরা সমাজের মানুষকে তা জানান দেবার জন্য দেয়াল লিখন থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় লিখা লিখি শুরু করেন। মিটিং মিছিল সেমিনার ও নাটক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কেউ কেউ রাজনীতির সাথে। এসমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ করার জন্য তাঁরা মানুষকে একতাবদ্ধ করে সম্মিলিত একটি শক্তিকে কাজে লাগাতে চান। জনমত তৈরী করা এবং জনমতকে ন্যায়ের পক্ষে সমবেত করানোর জন্য তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য সচেতন করা এবং জনমত সৃষ্টি করা কাজটি কিন্তু সহজ নয়। এটা অতীব দূরহ কাজ। শুধূ কলম নিয়ে লিখতে বসলে চলেনা। তার জন্য চাই সুন্দর ও বিশ্লেষণ মুলক ভাষা। যাতে পাঠকরা ভূল না বুঝেন। এজন্য অনেক সতর্কতা অবলম্ভন করতে হয়। বিষয়গুলোকে নিখুঁত এবং ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপনা করতে হয়। সুন্দর ও ভাষা জ্ঞানে তা সুসজ্জিত করে ভূলত্র“টিগুলো দেখতে হয়। অধিকাংশ লেখক ভাষার প্রয়োগ ও বিশ্লেষণের দূর্বলতার কারণে বিষয়টির অন্তর্নিহিত ভাবকে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করতে পারেননা। এই কাজটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। একারণে আমরা দেখতে পাই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র দু’একজন লেখক এই অঘোষিত দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছেন। অন্যতায় প্রত্যেকেই কবি সাহিত্যিক হয়ে যেতেন। কবি সাহিত্যিকদের এই যে বোধ বা সচেতনতা, তা হচ্ছে প্রকৃতিজাত বা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত। কেউ ইচ্ছা করলে লেখক বা সাহিত্যিক হতে পারবেননা, আল্লাহ বা মহাপ্রভূ প্রকৃতিগত ভাবে যাকে যত বেশী গভীর বোধশক্তি ও জ্ঞানদানের ক্ষমতা দেবেন তিনি ততবেশী শক্তিমান লেখক হবেন। একজন লেখকের জীবনের উপর সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ যত বেশী প্রভাব বিস্তার করবে সেই লেখকের লেখা ও তত বেশী গভীর কিংবা ব্যাপক হতে বাধ্য। কবি সাহিত্যিকরা স্বভাবতই নম্র এবং বিনয়ী চরিত্রের অধিকারী । অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, কোন কোন কবি সাহিত্যিকরা তীব্র মেজাজী ও অহঙ্কারী। এর কারণ খুব সম্ভবত এটাই যে তারা হয়তো বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিবেশ ও দূর্গতিময় পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করে বেড়ে উঠেছিলেন। প্রত্যেক লেখকদের লেখা ও রচনা ভঙ্গীর মধ্যে একেকটা নিজস্ব ধারা বা ষ্টাইল থাকে। যাদের মন জ্ঞান আহরণের জন্য সর্বদাই পিপাসু হয়ে থাকে এবং অধ্যয়ন করার মানসিক শক্তি প্রবল, তাঁরাও হতে পারেন শক্তিশালী লেখক। কবি সাহিত্যিকদের এই যে কর্মকান্ড এবং লেখালেখির আচরণ তা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বললে বলা যায় তা অনেকটা ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ। এই স্বেচ্ছাসেবকের কাজটি করার জন্য তাঁদেরকে কেউ তাগিদ দেয়না, তাঁরা নিজের মন থেকেই এই তাগিদ পেয়ে থাকেন। এ কারণে কবি সাহিত্যিকরা কলমের সাহায্যে ভাষার প্রলেপে মানুষের জীবনের ছবি আঁকেন, মানুষের মনের বিশ্লেষণ করেন। তার চরিত্রটি কোন ধরনের, তার মানসিকজাত আচার আচরণটি কেমন সবই তারা বিশ্লেষণ করতে পারেন নিখুঁত ভাবে। তাঁদের মনের চোখটি ঠিক যেন একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র। সমাজের ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনাদি যা সহজে দেখতে পাওয়া যায়না, আবার অনেক বিষয়াদি আছে যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়েনা অথচ তা ধীরে ধীরে সমাজ ও মানুষের সর্বনাশ ঘটাতে পারে এমন বিষয় সমুহের ব্যাপারে কবি সাহিত্যিকরা সমাজের মানুষকে আগাম সতর্কবাণী দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ করেন। মানুষের যে বহুমুখী বিচিত্র চরিত্র, এই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেন কবি সাহিত্যিকরা নিজ নিজ ভাষার প্রয়োগে। শুধূ মানুষের গল্প নয়, কোন অন্যায় কিংবা ভূলের কারণে কেন একটি সমাজের অগ্রগতি হচ্ছেনা ? মানুষ কেন দরিদ্র থাকছে ? কোথায় সেই সমস্ত ফাঁক ও ভূলভ্রান্তি ? তা ও কবি সাহিত্যিকরা খুঁজে বের করেন এবং যথা সম্ভব তার দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কবি সাহিত্যিকরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আসার জন্য শুধূ আহ্বান নয় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও করে থাকেন। এই সব ক্রিয়া কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় কবি-সাহিত্যিকরা মানুষের মঙলের জন্য যে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এতে তাঁদের আমলনামায় (ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে) অবিরত পূণ্য লেখা হচ্ছে। কবি সাহিত্যিকরা সব কিছুকেই সুন্দর ও সাজানো গুছানো দেখতে পছন্দ করেন। এটা তাদের মনের সৌন্দর্য্য, মনের কামনা। এই যে মহান সৃষ্টি কর্তা সমস্ত মহাবিশ্ব এবং আমাদের এই পৃথিবী সৃষ্টি করে অপরুপ রুপে সাজিয়েছেন। আমরা মানুষজাতি তার উপকারিতা জানি এবং এসব ভোগ ও করে যাচ্ছি নির্দ্বিধায়। তাই এসব সুন্দরের জয়গানে কবিরা মূখরিত হয়ে উঠেন। তাঁরা প্রত্যক্ষ এবং পরক্ষ ভাবে মহান সৃষ্টিতকর্তার গুণগান ও করেন। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, øেহ মমতা যে কত সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী তা কেবল কবি সাহিত্যিকরাই মানুষের কাছে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেন। মানুষ তা পাঠ করতে ভালবাসে। মাতৃত্ব এবং নারীর ভালবাসা পুরুষজাতির কাছে যে কত মহামূল্যবান যার কোন তুলনা নেই তা কবি সাহিত্যিকরা নিখূঁত ভাবে ব্যক্ত করেন তাঁদের কবিতায়, গানে ও গল্পে। সমস্ত পৃথিবী র প্রত্যেকটি সমাজে মিশে আছে কবি ও লেখকদের গান, সুর আর তালের প্রভাব। ধনী-গরীব সাদা-কালো ধার্মিক-অধার্মিক নির্বিশেষে সকল জাতি, গান সুর ছন্দ ও আপন আপন সংস্কৃতিকে ভালবাসে। যা কবি সাহিত্যিকরা সৃষ্টি করেন নিজ মেধা ও প্রতিভা থেকে। এতে মানুষ এক অনির্বচনীয় তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ করে। যা ভাষায় বুঝানো যায়না কিন্তু অনুভব করা যায়। প্রকৃত ও মানবতাবাদী কবি সাহিত্যিকরা জাত ধর্ম ও বর্ণের উর্ধে উঠে সবাইকে ভালবাসতে চান, এই হিসেবে তাঁরা বিশ্বপ্রেমিক ও বটে। তাঁদের একহাতে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে উন্মুক্ত তরবারি অপর হাতে থাকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সুবাস ছড়ানো ফুল । কবি নজরুলের ভাষায় “ মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তুর্য ” । কবি সাহিত্যিকরা স্বভাবতই অতি আবেগপ্রবণ ও রোমান্টিক মনের অধিকারী হয়ে থাকেন। এটা তাঁদের স্বেচ্ছাকৃত কোন ব্যাপার নয়, এটা প্রকৃতিজাত। তাঁরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে হন আকৃষ্ট আর নারীর সৌন্দর্যে হন বিমুগ্ধ ও বিমোহিত। সেখানে তাঁরা আবিস্কার করেন নারীর সুন্দরের অপরুপ সব শাখা প্রশাখা। যা সমুদ্রের মত গভীর, আকাশের মত নীল, বনানীর মত চিরসবুজ আর অস্তগামী সুর্যের মত সোনালী আভায় দীপ্তিমান। যেন এই রুপ মাধুর্যের শেষ নেই। হৃদয়ের সমস্ত সম্পদ তাঁরা ঢেলে দিতে চান নারীর জন্যে। নারীর মন ও সৌন্দর্যের মাধুর্য তাদের কাছে সর্বদাই চির রহস্যময়। তাঁরা মানুষের চরিত্র, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং নারীর লাবণ্যময় রুপকে তুলনা করেন নানা বৈচিত্রময় আভরণে। প্রয়োজনে নানাবিধ উদাহরণ প্রয়োগ করেন। কাল্পনিক রুপ ও চরিত্র সৃষ্টি করে সেটাকে পাঠকের কাছে করে তুলেন অতি আকর্ষণীয় ও আনন্দময়। তাঁদের ভাষার গতি এবং শ্র“তিমধূর শব্দের সঠিক প্রয়োগ পাঠককে নিয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে। পাঠক তখন হারিয়ে যান আরেক ভুবনে। তার কাছে মনে হবে লেখকই যেন তার মনের কথাগুলো এক সুনিপূণ ভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন কাগজের পাতায় পাতায়। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক , মানুষ সুখী হোক, মানুষের মুখে হাসি ফুটুক এটাই কবি সাহিত্যিক এবং সত্যবাদী সাংবাদিকদের আজীবন কামনা। অবাস্তব, মিথ্যা ও সকল প্রকার অপকৌশলকে কবি সাহিত্যিকরা মন থেকে ঘৃণা করেন। তাঁদের কারো কারো লিখা যখন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী হয় কিংবা অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয় তখন তাঁরা সমাজে নানা ভাবে হয়রানির শিকার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে তাঁদেরকে জনগণের শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে যখন তাঁরা কলম ধরেন তখনই এসব বিপদ তাদের মাথার উপর হাজির হয়। তাঁদের নামে ভুরি ভুরি মিথ্যে মামলা হয়। দৈহিক ভাবে তাঁরা হন নির্যাতীত। এমতাবস্তায় কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হন। এসবের প্রচুর প্রমাণাদি আছে পৃথিবীর সব সমাজে। কবি সাহিত্যিকরা তবুও থেমে নেই। যতদিন সমাজ পরিবার ও রাষ্ট্র আছে তাঁরা ও ততদিন থাকবেন মানুষের কল্যাণে। যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে ।
১৬ই আষাঢ়/ ৩৬ মুক্তিসন/ ১৪১৪ বাংলা