আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কাংক্ষিত পরিবর্তনে শিক্ষার আমূল সংস্কার অপরিহার্য
মোঃ জানে আলম
স্বাধীনতার দীর্ঘ তিন যুগ পরও মর্মন্তুদ সত্য হল আমরা এখনো একটি পশ্চাৎপদ জাতি। যদিও রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিভাষায় আমাদের বলা হয় একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আমাদের এ পশ্চাৎপদতার মূল কারণ সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য। আমাদের এ দারিদ্য্র কেবল বিত্তের নয়, চিত্তেরও। বরং বলা চলে এ দারিদ্র্য যতটুকু বিত্তের, ততোধিক চিত্তের। একদা কবি নজরুল অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑআমরা বাঙালিরা কেবল ধনে নয়, মনেও কাঙ্গাল। নজরুলের এ উক্তি বহু বছর পূর্বের হলেও এখনো সমভাবে সত্য কী ধনে, কী মনে, আমাদের এ কাঙ্গালিত্ব ঘুচেনি। বস্তুতঃ চিত্ত ও বিত্তের এ কাঙ্গালিত্বের কারণে আমরা একটি পশ্চাৎপদ জাতি। আমাদের বিত্তের এ পশ্চাৎপদতার কারণ আর্থ-সামাজিক; আমাদের চিত্তের পশ্চাৎপদতার কারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক। আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণ আমাদের বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা, পরিণামে আমাদের বিত্তহীনতা। স্বাধীনতার সূদীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পরেও কী শিল্পে, কী কৃষিতে, আমরা উৎপাদন ব্যবস্থার কাক্সিক্ষত বিকাশ ঘটাতে পারিনি। গড়ে তুলতে পারিনি কোন বিকাশমান উৎপাদন ও সুষম বণ্ঠন ব্যবস্থা। অথচ দীর্ঘ স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন চুড়ান্ত পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা জাতিগতভাবে যে চেতনা ও মূল্যবোধ অর্জন করেছিলাম, একটি সদ্যস্বাধীন জাতির এগিয়ে যাওয়া এবং একটি আধুনিক রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ গঠনের জন্য তা ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের খোলস ভেঙ্গে নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্র, শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ ও একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ, এসবই ছিল একটি ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের মূল্যবোধের বিবর্তন আমাদের অভাবনীয় অর্জন; ইউরোপীয় জাতিগুলো যা রেনেসাঁর মাধ্যমে অর্জন করেছিল। সে অর্থে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশককে বাঙালি জাতির রেনেসাঁর দশক বলা অত্যুক্তি হবে না। সঙ্গত কারণেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও এসকল আদর্শ মূল রাষ্ট্রীয় নীতিমালা হিসাবে গৃহীত হয়। কিন্তু কেন সে আধুনিক চেতনা ও মূল্যবোধের দীপ্ত মশাল হাতে নিয়েও আমরা এগুতে পারলাম না, পৌঁছতে পারলাম না আমাদের কাঙ্খিত মকসুদ-মঞ্জিলে? আমাদের এ ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতার ফলে আজ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে কেবল আমাদের লক্ষ্য নিয়ে নয়, আমাদের আত্ম-পরিচয় নিয়েও। সেদিনের স্বাধীনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের মুখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য শোনার দুর্ভাগ্য আমাদের হচ্ছে। বিগত ওয়ান ইলেভেন ( ১১ই জানুয়ারী ২০০৭ইং) এর পরিবর্তনের পর আমাদের অসুস্থ রাজনীতি ও ততোধিক অসুস্থ রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর এক বীভৎস, কুৎসিত চেহারা আজ আমাদের সামনে উম্মোচিত হয়েছে। একটি অতি নির্মম ও রূঢ় সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, স্বাধীনতার পর হতে যারা বিভিন্ন সময়কালব্যাপী আমাদের দেশ শাসন করেছে, কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ছাড়া তারা বস্তুতঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার কোন সচেতন ও সুপরিকল্পিত প্রয়াস গ্রহণ করেন নি। বরং বিপরীতভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপণার মাধ্যমে তারা নিজের ও নিজের পরমাত্মীয়দের বিত্ত-বৈভব গড়ার কাজে মহাব্যস্ত ছিলেন। পরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আমাদের আমজনগণ এসকল ওয়াদাখেলাপকারী রাজনৈতিক দলকেই বারংবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে এবং সে সকল দলের খলনায়কেরাই এখনো রাজনৈতিক গগণে নক্ষত্র হিসাবে বিরাজ করছে। তাই একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সুশীল সমাজের যে সকল অনিবার্য অনুষঙ্গ Ñ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বচ্ছ ও শক্তিশালী পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাকার উদ্যোগগুলো গ্রহণ করতে হচ্ছে স্বাধীনতার তিন যুগ পর, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ সকল মৌলিক সংস্কার কার্যক্রম জাতির মনে প্রচণ্ড আশাবাদের জন্ম দিয়েছে বটে, কিন্তু আমাদের ঐ সকল তথাকথিত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো চিন্তা-চেতনায় বা তাদের নেতা-নেত্রীদের রাজনৈতিক আচরণে কোন মৌলিক পরিবর্তনের কোন লক্ষণ অদ্যাবধি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সমাজ বিনির্মাণের লক্ষে এ সকল প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন গড়ে তোলা অতীব জরুরী ও অপরিহার্য হলেও এসকল প্রশাসনিক কাঠামো সমাজের কেবল উপরিকাঠামোই বিনির্মাণ করে। শেষবিচারে সমাজের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের কোন মৌলিক কর্মসূচী ব্যতিরেকে এ সকল পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং পরিণামে আমজনগণের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারবেনা ।
অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে বিদ্যমান উৎপাদন ও বণ্ঠন ব্যবস্থায়ও। সে লক্ষ্যেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ক্ষুদ্র-বৃহৎ শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ, ভূমি মালিকানা ও পুঁজিবিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ সহ অধনবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্ত ঊনিশ শ’ পঁচাত্তুর সালের ১৫ ই আগস্টে সংগঠিত এক রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন চক্র আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ধন্বত্বরি মহৌষধ হিসাবে মুক্তবাজার অর্থনীতির শ্লোাগানকে সামনে নিয়ে আসে। অতঃপর পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলের মধ্যে জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানা আবার ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর, ব্যাংক থেকে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের অঢেল ঋণ প্রদান, ভুমি মালিকানার শিলিং পূণঃনির্ধারণ ইত্যাকার পদক্ষেপের মাধ্যমে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু নির্মম সত্য হল, এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশে কাঙ্খিত শিল্প বিকাশ ঘটেনি। কৃষিতেও এখনো সামন্তবাদী ও আধা-সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বিদ্যমান। উৎপাদনই যেখানে অপর্যাপ্ত, সেখানে উৎপাদিত সম্পদের অসম বন্ঠন ব্যবস্থাতো রয়েছেই। অপরিবর্তিত রয়ে গেল ঔপনিবেশিক আমলের সে আর্থ-সামাজিক কাঠামো। ফলতঃ দারিদ্র্য আমাদের জনগোষ্ঠীর স্থায়ী ললাট লিপি হয়ে রইল। কিন্তু একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা কোন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে যার মেয়াদকালও আবার অত্যন্ত সীমিত অবকাঠামোগত পরিবর্তনের কোন মৌলিক কর্মসূচী হাতে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে সমাজের উপরিকাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজকে মৌলিক পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করার যে সকল কর্মসূচী এ সরকার গ্রহণ করেছে, তাকে টেকসই করতে হলে অত্যন্ত জরুরী হল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রুগ্ণ রাজনীতির ফসল সকল প্রকার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধেও জ্বেহাদ ঘোষণা করা। ন্যূনপক্ষে এ কাজটি শুরু করে যেতে পারেন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তা না হলে ইতোমধ্যে গৃহীত সকল সংস্কার উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। কারণ আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, আমাদের চিত্তের যে দারিদ্র্য তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ হল আমাদের মূল্যবোধ ও চিন্তা-চেতনার অস্বচ্ছতা ও পশ্চাৎপদতা। আমাদের অশিক্ষা-কুশিক্ষা। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পরেও আমরা এখনো আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকট আমরা বাঙালি না বাঙলাদেশী সে বিতর্কের ইতি টানতে পারিনি। আমরা এখনো জাতিগতভাবে নির্ধারণ করতে পারিনি কী হবে আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ, নাকি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। আমরা এখনো নির্ধারণ করতে পারিনি আমাদের লোকজ সংস্কৃতি তথা আমাদের (পশ্চাৎপদ) ঐতিহ্যের সাথে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির (আধুনিক বিশ্ব সংস্কৃতি) দ্বন্ধ সমন্বয়ের মাত্রাবোধ। ফলতঃ জাতি হিসাবে আজ আমাদের সামনে সুনির্দিষ্ট কোন দর্শনের আলোকবর্তিকা দেদীপ্যমান নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যে সমুদয় আদর্শ ও মূল্যবোধ, তার সকল দেউটি একে একে নিভে গেছ্ েইতোমধ্যেই। ্ঐতিহ্যগতভাবে যতটুকু সুস্থ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা ছিলাম তাও আজ রোগাক্রান্ত। নির্মম ফলশ্র“তিতে ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাস, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি আজ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। একটি স্রোতহীন নদীতে যেমল শত শৈবাল জন্ম নেয়, ঠিক তেমনি গতিহীন স্থবির একটি সমাজে জন্ম নেয় নানা অপসংস্কৃতি। সেকারণে রাজনৈতিক অনাচার, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তপনার অচলায়তনে আবদ্ধ গতিহীন আমাদের সমাজেও পশ্চাৎপদ চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধের সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের চুড়ান্ত বিকৃতি--জঙ্গীবাদ । (অবশ্য এর একটি বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত ও আছে) এ আমাদের সমাজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক রুগ্ণতা। বলাবাহুল্য, আমাদের সাংস্কৃতিক রুগ্ণতার এ উপসর্গগুলো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে আমাদের রাজনীতিকে । দ্বিরুক্তি হলেও বলতে হয়, আমরা আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ বলে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবেও পশ্চাৎপদ। আবার আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে, নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে হিমাচলসম প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে আমাদের জাতি পশ্চাৎপদতার এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংকটের সমাধান করতে হবে যুগপৎভাবে। আর্থ-সামাজিক সংকট সমাধানের প্রধান উপায় কিন্তু রাজনৈতিক, পক্ষান্তরে সামাজিক-সা্স্কংৃতিক সংকট সমাধনের উপায় হল সাংস্কৃতিক। তাই আজ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল আমাদের এ সংকট থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবেনা, যদি আমরা উপযোগী সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারি। আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অব্স্থার পরিবর্তনের জন্য চাই একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কিন্তু নিদারুন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বিদ্যমান এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা রাজনৈতিক পরিবর্তন তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের জন্য যত উদগ্রীব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রশ্নে ততোধিক নির্বিকার ও নিষ্পৃহ। তাতে নির্মম ফলাফল দাঁড়াতে পারে উপরি কাঠামোগত যে সকল পরিবর্তন ইতোমধ্যে আনা হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে তা আর টেকসই হবেনা। কারণ একমাত্র সচেতন একটি জনগোষ্ঠী এ সকল পরিবর্তনের অতন্দ্রপ্রহরী হিসাবে কাজ করতে পারবে। আর সেরূপ সচেতন জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পারে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
আমাদের দ্বিধাহীনভাবে উপলব্ধি করতে হবে, কেবল মাত্র একজন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষেই সম্ভব দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাকার মূল্যবোধ গুলো আত্মস্থ করা। যুক্তিবাদী মানুষ সৃষ্টি করতে হলে বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। প্রশ্ন হল মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার কার্যক্রমটা কী হতে পারে এবং তা করবে কারা? প্রথমতঃ প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুণগতমান পরিবর্তন অপরিহার্য, যা সম্ভব সরকারীভাবে। কিন্ত কোন প্রগতিশীল ও গণমুখী সরকার ব্যতীত এটা আমরা প্রত্যাশা করতে পারিনা। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা কারিকুলামে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভোটের রাজনৈতিক কৌশল, তাদের অজ্ঞতা ও চিন্তার পশ্চাদপদতার কারণে এ জাতীয় উদ্যোগ যেমন অতীতে নেননি, ভবিষ্যতেও তারা তা নেবে তা আশা করার কোন যুক্তি নেই। বেসরকারী ভাবে আমাদের সচেতন ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন বেসরকারী ক্লাব, সংগঠন, সমিতি, পাঠচক্র গড়ে তুলে আমজনগণকে বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারেন বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে। এ প্রচার-প্রচারণা চালানো যায় সঙ্গীতের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে জনপ্রিয় লোক সঙ্গীত-কবিগান, পথনাটক-প্রহসন এর মাধ্যমে, আলোচনা-সেমিনার, মতবিনিময় , গ্রামের উঠতি তরুণ-তরুণীদের নিয়ে বিষয় ভিত্তিক পাঠচক্র আয়োজন করে। সে সকল পাঠচক্রে মানুষদের বিশেষভাবে গ্রামের মানুষদের সচেতন করা যেতে পারে কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধু-সন্ত, ভিক্ষু-মোহন্ত, তান্ত্রিক-হুজুর-সাঁইবাবাদের তাবিজ-মাদুলী পানি পড়া-ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার অসারতা তুলে ধরে। তাদের তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার বুজরুকি ফাঁস করে দিয়ে। আলোচনা--মতবিনিময় পাঠচক্রের মাধ্যমে আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার মূল কারণ জনগণের সামনে তুলে ধরা, যাতে তারা বুঝতে পারে অদৃষ্ট বা নিয়তি নয়, বিদ্যমান শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা ও শাসকগোষ্ঠীর নিরন্তর শোষণ ও ব্যর্থতাই আমাদের দারিদ্রের মূল কারণ। এ পশ্চাৎপদতা থেকে কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে মুক্তি পাওয়া যাবে না, মুক্তি পেতে হলে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে। আমজনগণের চিন্তা-চেতনায় এ বোধ র্সৃষ্টি করার যে উদ্যোগ তাই হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পশ্চাৎপদতার শিকড় ধরে টান মারার এ আন্দোলন বর্তমান ব্যবস্থার বেনিফিসিয়ারী রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিপক্ষের যা হউক না কেনপক্ষ থেকে আশা করা যায়না। সচেতন নাগরিক সমাজ, বিশেষভাবে সাংস্কৃতিক কর্মীদের পক্ষ থেকে এ আন্দোলন শুরু করা যায়। একাত্তুরের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এখন আমাদের দরকার একদল সাংস্কৃতিক যোদ্ধার। স্বাধীনতার দীর্ঘ ছত্রিশ বছর পর যে ভাবে আজ একাত্তুরের য্দ্ধুাপর্যাধীদের বিচারের দাবী সামনে এসেছে আমাদের কাঙ্খিত পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে এ একটা শুভ ঈঙ্গিত । আজ স্বাধীনতার বিকৃত ইতিহাসকে সঠিক প্রেক্ষিতে মূল্যায়নের চেষ্টা চলছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি আধুনিক, গণমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। অন্ততঃ এতদ্বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে পারে যারা সুপারিশ করতে একটি শিক্ষানীতি, যে শিক্ষানীতি কেবল দক্ষ পেশাদার সৃষ্টি করবে না সত্যিকার আলোকিত মানুষ সৃষ্টি করবে।